মানব সভ্যতার ইতিহাসে পূর্ণ মানুষ হিসেবে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির নাম বলা হয়। এমন বহু বিচিত্র প্রতিভার সম্মেলন সম্ভবত অন্য কোনো মানুষের মধ্যেই দেখা যায়নি।
তিনি চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, গণিতবিদ, গায়ক, প্রকৃতি বিজ্ঞানী, শরীরতত্ত্ববিদ, সামরিক বিশেষজ্ঞ, আবিষ্কারক, দার্শনিক। প্রতিটি বিষয়েই চেয়েছিলেন শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে এবং অনেকাংশে তিনি সফলও হয়েছিলেন। যেমন একদিকে তার জীবনের গৌরব, অন্যদিকে ব্যর্থতা। তবে লিওনার্দো সাফল্যের চূড়ায় উঠেও কখনও তৃপ্তি অনুভব করেননি। মনে হয়েছে তার জীবন এক অসমাপ্ত যাত্রাপথ।
ইতালির রেনেসাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ দ্য ভিঞ্চির জন্ম ১৪৫২ খ্রীষ্টাব্দে। তার বাবার নাম ছিল পিয়েরো এ্যান্টনিও দ্য ভিঞ্চি। পিয়েরো ছিলেন উকিল।
শৈশব থেকেই তার প্রতিভা বিকশিত হয়ে উঠছিল। তার জীবনীকার ভাসারি লিখেছেন, অংকে তার এতো মেধা ছিল যে শিক্ষকরা তাকে পড়াত, তারা মাঝে মাঝেই বিভ্রান্ত হয়ে যেত। লিওনার্দোর অনুসন্ধিৎসা ছিল প্রবল।
সে যুগে চিত্রশিল্পকে কোনো সম্মানীয় পেশা হিসেবে গণ্য করা হতো না। তাছাড়া এতে ছেলের প্রতিভা আছে কিনা সে বিষয়েও পিয়েরো নিশ্চিন্ত ছিলেন না। তাই নিওনার্দো যখন ছবি আঁকা শেখবার অনুরোধ জানাল, সরাসরি তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন।
লিওনার্দো উপলব্ধি করতে পারলেন, বাবার অনুমতি ছাড়া ছবি আঁকা সম্ভব নয়। তাই বুদ্ধি করলেন। একটা বড় কাঠের পাটাতনের উপর গুহার ছবি আঁকলেন। গুহার মধ্যে আধো আলো আধো ছায়ায় এক অপার্থিব পরিবেশ। তার সামনে এক ভয়ঙ্কর ড্রাগনের ছবি, মাথায় শিং। চোখ দুটি আগুনের মত জ্বলছে। ভয়ঙ্কর দাঁতগুলো যেন ছুরির ফলা, নাক দিয়ে বেরিয়ে আসছে আগুনের লেলিহান শিখা।
ছবি আঁকা শেষ হতেই ঘরের মধ্যে ছবিটাকে রেখে সব জানালা বন্ধ করে দিলেন। পিয়েরো কিছু জানেন না। ঘরে ঢোকা মাত্রই সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে আতঙ্কে চিৎকার করে বেরিয়ে এলেন। পিয়েরো শান্ত হতেই লিওনার্দো গম্ভীর গলায় বললেন, আমি মনে হয় আমার যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পেরেছি।
এইবার ছেলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করলেন না পিয়েরো। তিনি ছবি আঁকবার অনুমতি দিলেন। সে সময় ফ্লোরেন্সের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী ছিলেন ভেরক্কিয়ো। চিত্রশিক্ষার জন্যে তার স্কুলে গেলেন লিওনার্দো। তখন তার বয়স আঠারো।
২.
দীর্ঘ আঠারো বছর লিওনার্দো ছিলেন মিলানে। সেখানে মিলানের অধিপতি লুডোভিকোর সঙ্গে থেকে তার প্রতিভার বিকাশ ঘটতে শুরু করে। বহুদিন ধরেই লিওনার্দো কল্পনা করতেন এক আদর্শ শহরের। যে শহর হবে সর্বাঙ্গ সুন্দর, যেখানে মানুষের প্রয়োজনীয় সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থাকবে।
তিনি রচনা করলেন এক আদর্শ শহরের মানচিত্র। সেখানে প্রতিটি পথ হবে প্রশস্ত। দুদিকে বিভক্ত। একদিকে মানুষ, যানবাহন যাবে, অন্যদিকে আসবে। শহর হবে ছোট। তাতে ৫০০০-এর চেয়ে বেশি বাড়ি থাকবে না। ছোট ছোট শহর রক্ষণাবেক্ষণ করা সহজ। শহর বড় হলে লোকসংখ্যা বাড়বে। তখন দেখা দেবে নানান সমস্যা। তাছাড়া শহরের সামর্থ্যের তুলনায় মানুষের সংখ্যা বেশি হলে তা হবে খোঁয়াড়ের মত। অস্বাস্থ্যকর অসুবিধাজনক। শহরের কোন নর্দমাই বাইরে হবে না। প্রতিটি নর্দমা হবে মাটির নীচে। সেখান দিয়ে শহরের সব আবর্জনা শহরের বাইরে নদীতে গিয়ে পড়বে।
লিওনার্দোর এই আদর্শ শহরের পরিকল্পনা সর্বযুগে সর্বকালের প্রযোজ্য। কিন্তু ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও লুডোভিকো লিওনার্দোর এই কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি।
এরপর লিওনার্দো তৈরি করলেন নগরের ক্যাথিড্রালের এক সম্পূর্ণ নক্সা। এই সব কাজের অবসরে তিনি চর্চা করতেন জ্যামিতি, জ্যোতিবির্দ্যা, অংক এবং এসব ক্ষেত্রে বহু মৌলিক চিন্তার প্রকাশ ঘটেছিল।
৩.
১৪৯৯ খ্রীষ্টাব্দে ফরাসী সম্রাট মিলান আক্রমণ করলেন। লিওনার্দো মিলান ত্যাগ করে পালিয়ে এলেন ভেনিসে। ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দে মিলান সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়ে ফরাসী অধিকারে চলে গেল। লিওনার্দো আশা করেছিলেন যুদ্ধ মিটে গেলে আবার মিলানে ফিরে যাবেন। কিন্তু যখন সেই আশা পূর্ণ হল না, তিনি ভেনিস ত্যাগ করে রওনা হলেন মাতৃভূমি ফ্লোরেন্সের দিকে।
এরই মধ্যে তিনি একটি ছবি এঁকে আলোচিত হয়ে গেলেন। ভার্জিন অব দ্য রকস্। ঝুলে পড়া এক পর্বত। তার মধ্যে ফুটে উঠেছে চিরন্তন মানব আত্মার এক রূপ।
এই সময় লিওনার্দো আঁকলেন তার জগৎ বিখ্যাত মোনালিসা। এই ছবিটি আঁকতে তার সময় লেগেছিল তিন বছর।
কে এই মোনালিনা? এ বিষয়ে ভিন্নমতের অভাব নেই। কয়েকজনের অভিমত মোনালিসার প্রকৃত নাম ছিল লিজা। তিনি ছিলেন ফ্লোরেন্সের এক অভিজাত ব্যক্তির স্ত্রী। ভিন্নমত অনুসারে মোনালিসা ছিলেন জিয়োকান্ত নামে এক ধনী বৃদ্ধের তৃতীয় পত্নী। নাম মাদোনা এলিজাবেথ।
চিত্রশিল্পী হিসাবে লিওনার্দোর খ্যাতি জগৎ বিখ্যাত হলেও তার মৃত্যুর পর পাওয়া গিয়েছিল পাঁচ হাজার পাতার হাতের লেখা পাণ্ডুলিপি। এই পাণ্ডুলিপিতে তিনি সমস্ত জীবন ধরে যে সব পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, পরীক্ষা করেছিলেন, তারই বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। এই পাণ্ডুলিপি লেখা হয়েছিল ইতালিয়ান ভাষায় এবং সমস্ত পাণ্ডুলিপি লেখা হয়েছিল উল্টো। ফলে সোজাসুজি পড়া যেত না। পড়তে হত আয়নার মাধ্যমে। প্রতিটি লেখার সঙ্গে থাকত অসংখ্য ছবি।
তার এই পাণ্ডুলিপিতে অসংখ্য বিষয় নিয়ে লেখা হয়েছে। প্রাচীন উপকথা, মধ্যযুগীয় দর্শন, সমুদ্রস্রোতের কারণ, বাতাসের গতি, তার চাপ, পৃথিবীর ওজন। নিশাচর পাখির গতিপ্রকৃতি। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব। উড়ন্ত যান। সাঁতার কাটবার যন্ত্র। আলোর প্রকৃতি, যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রের নক্সা। সুগন্ধ সেন্ট তৈরির ফর্মুলা। বিভিন্ন পাখি জন্তু-জানোয়ারদের আচার-আচরণ, বিভিন্ন গাণিতিক সূত্র।
তার বৈজ্ঞানিক ভাবনা এতো গভীর ছিল যে গোপনে বেশকিছু মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করে দেখেছিলেন দেহের গঠন। তার এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বেশ কিছু শরীরতত্ত্বের ছবি এঁকেছিলেন। সেই ছবি এতো নির্ভুল ছিল, পরবর্তীকালে চিকিৎসকরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন।
আধুনিক উড়োজাহাজ তিনিই প্রথম নক্সা আঁকেন। তার পাণ্ডুলিপির এক জায়গায় লিখেছেন একদিন মানুষ আকাশে উড়বেই। লিওনার্দো মারা যান ১৫১৯ সালে। ৬৭ বছর বয়সে বিদায় নিলেন ইতালির রেঁনেসার সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৫ ঘণ্টা, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১২
সম্পাদনা: শেরিফ সায়ার, বিভাগীয় সম্পাদক