ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

আতাউস সামাদ: আমার প্র্যাকটিক্যাল টিচার

পলাশ মাহবুব, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:০৫, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১২
আতাউস সামাদ: আমার প্র্যাকটিক্যাল টিচার

সাল ২০০০। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে সবেমাত্র ভর্তি হয়েছি।

সাংবাদিকতার রোমান্সে পড়েই এই বিভাগে ভর্তি হওয়া।

ক্লাশ তখনো শুরু হয়নি। দৈনিক মানবজমিনের দাপটের যুগে তখন আরেকটি ট্যাবলয়েড পত্রিকা বাজারে আসি আসি করছে- ‘দৈনিক মাতৃভূমি’। সম্পাদক শওকত মাহমুদ আর উপদেষ্টা সম্পাদক আতাউস সামাদ। পরের নামটি খুব চেনা চেনা। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের রোল মডেলে পরিণত হওয়া আতাউস সামাদের নামটি নানা কারণেই মাথার ভেতরে ছিলো। বিবিসিখ্যাত আতাউস সামাদকে ছেলে-বুড়ো সবাই চেনে।

সবকিছু নিয়ে প্রবল আগ্রহের সেই বয়সে জানতে পারলাম আতাউস সামাদ আর শওকত মাহমুদ দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন- একজন শিক্ষক হিসেবে অন্যজন ছাত্র। এই একটিমাত্র সূত্রকে পুঁজি করে দেখা করলাম তাদের সঙ্গে- সরাসরি চেয়ে বসলাম চাকরি। দুজনই অবাক- আমার বয়স কম তার ওপরে সবেমাত্র ভর্তি হয়েছি ফার্স্ট ইয়ারে। কিন্তু আমি দমবার পাত্র নই, দেখালাম সঙ্গে নিয়ে যাওয়া প্রকাশিত বেশকিছু গল্প ও ছড়া। আতাউস সামাদ স্যার বললেন, গল্প লেখা আর সাংবাদিকতা এক জিনিস নয়। আর তুমি তো স্টুডেন্ট, চাকরি করবে কিভাবে? আমি তখন সাহস করে বলে ফেলেছিলাম, স্যার, থিওরি পড়বো ইউনিভর্সিটিতে আর প্র্যাকটিক্যাল এখানে। এক পর্যায়ে আতাউস সামাদ স্যার কিছুটা রাজি হলেন। কিন্তু শর্ত একমাস আমাকে টেস্ট করা হবে।

সেই থেকে শুরু। ২০০০ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত টানা কাজ করেছি আতাউস সামাদ স্যারের সাথে। মাঝে অনেক ঝড়-ঝাপ্টা গেছে কিন্তু স্যার আমাদের আগলে রেখেছেন। সাংবাদিকতার যতটুকু শিখেছি তার প্রায় পুরোটাই স্যারের কাজ থেকে শেখা।

তিনিই প্রথম শিখিয়েছেন কিভাবে ইন্টারভিউ নিতে হয়। একদিন হঠাৎ বললেন, একটা ইন্টারভিউ নিতে হবে, সাংবাদিক নির্মল সেনের। প্রথমে বেশ উৎফুল্ল হলেও নির্মল সেন নামটি শুনে আমি খানিকটা চুপসে যাই। প্রথমত নির্মল সেন একজন জাঁদরেল সাংবাদিক তার ওপরে শুনেছি মুখের ওপর সত্য কথা বলতে তিনি কাউকে ছাড়েন না। সেই নির্মল সেনের ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে কি বিপদেই না পড়ি। মনের মধ্যে ভয়। সামনে-পেছনে কিছুই তো জানি না।
 
স্যার আমার বিষয়টা আঁচ করতে পেরেছিলেন। তিনি বললেন, `ঠিক আছে চলো, আমিও তোমার সাথে যাবো, অনেকদিন দাদার সঙ্গে দেখা হয় না। সেদিনের সেই ইন্টারভিউ পুরোটাই স্যার নিয়েছিলেন। আমি শুধু অনুলিখন করে গেছি। কিন্তু পত্রিকায় নাম ছাপা হয়েছে আমারই। ``

আতাউস সামাদ স্যারের কাছেই শিখেছি কিভাবে কলাম লিখতে হয়। তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘এখন’ পত্রিকায় আমি জীবনের প্রথম কলাম লিখি তাও আবার ধারাবাহিকভাবে। একদিন আমাকে ডেকে বললেন, শোনো, তোমাকে একটা সুযোগ দিতে চাই। এখন থেকে নিয়মিত একটা কলাম ছাপবো, নগর ডায়েরি। পারবা?

তখন সবকিছুতে `হা` বলার বয়স। থার্ড ইয়ারে পড়ি। মাথা নাড়ালাম।

``বুইঝো কিন্তু, এই নামে আগে আরও একজন কলাম লিখতেন, দৈনিক বাংলার সম্পাদক আহমেদ হুমায়ুন। ``

এবার ঘাবড়ানোর পালা।

কিন্তু স্যার-ই আবার সাহস যোগালেন এবং নিয়মিত প্রকাশ করলেন আমার লেখা কলাম।
আতাউস সামাদ স্যার তখন নিয়মিত কলাম লিখতেন দৈনিক প্রথম আলোতে। আমি তখনো ইউনিভার্সিটির ছাত্র। স্যারের একটি কলামে প্রসঙ্গক্রমে আমার কথা এক কি দুই লাইন লিখেছিলেন। সেখানে আমার নামের আগে তিনি লিখেছিলেন ‘সাংবাদিক পলাশ মাহবুব’।

সেদিনের কথা এখনো মনে পড়ে। ক্লাসের সহপাঠীদের কাছে আমার আলাদা কদর, আতাউস সামাদের কলামে আমার নাম! অফিসের সহকর্মীদের কেউ কেউ কিঞ্চিত ঈর্ষান্বিত। ডিপার্টমেন্টের স্যারদের দু-একজন নিশ্চিত হতে চান, আমিই সেই পলাশ মাহবুব কিনা। আর আমার মধ্যে সার্টিফিকেট পাওয়ার আনন্দ। কারণ স্যার তাঁর নিজের হাতে আমার নামের আগে সাংবাদিক শব্দটি ব্যবহার করেছেন। গুরুর কাছ থেকে শিষ্যের এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে।

আতাউস সামাদ ছিলেন অনুকরণ করার মতো পূর্ণাঙ্গ একটি প্যাকেজ। আগাগোড়া সাংবাদিক এবং সাদা মনের একজন মানুষ। খ্যাতির চূড়ায় থেকেও তার মতো নির্লোভ, নিরহংকার এবং নির্বিবাদি মানুষ এই সমাজে বিরল। কখনো কাউকে আঘাত করে কিংবা অসম্মান করে কিছু বলতে শুনিনি, লেখার তো প্রশ্নই আসে না। তার মধ্যে তারার ঔজ্জ্বল্য যেমন ছিলো তেমনি ছিলো শিশুর মতো সুন্দর শুভ্রতা। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের রোল মডেল। সত্যিকারের কিংবদন্তি। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষায় সমানতালে লিখে যাওয়া তাঁর মতো সাংবাদিক বিরল।

গণমাধ্যম বিস্তারের এই যুগে আরও অনেক পত্রিকা আসবে। টেলিভিশন আসবে। আসবে নতুন নতুন অনলাইন সংবাদপত্রসহ নানান কিছু।

কিন্তু একজন আতাউস সামাদ?

পলাশ মাহবুব : সাহিত্যিক ও নাট্যকার। প্রোগ্রাম ম্যানেজার- বৈশাখী টেলিভিশন।
এমএমকে; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর jewel_mazhar@yahoo.com 



বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।