ঢাকা, সোমবার, ৫ শ্রাবণ ১৪৩২, ২১ জুলাই ২০২৫, ২৫ মহররম ১৪৪৭

ফিচার

হ্যাডেনের সংবাদে ‘টাইম’ স্টাইল

শেরিফ সায়ার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৩০, অক্টোবর ৩, ২০১২
হ্যাডেনের সংবাদে ‘টাইম’ স্টাইল

বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘টাইম’। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত এ পত্রিকাটির জন্য কোটি পাঠকের চোখ অপেক্ষায় থাকে।

এ মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এমনকি এশিয়ার জন্যও তারা বিশেষ সংস্করণ প্রকাশ করছে।

এতে বিশ্বের মানুষের আরো কাছে চলে আসছে টাইম। অথচ টাইম পত্রিকার জনক কে? এ বিষয়টা আলোচনায় খুব একটা বেশি আসে না। জনপ্রিয় এ পত্রিকাটির প্রথম সম্পাদক ব্রিটন হ্যাডেন এবং প্রকাশক হেনরি লুসকে বলা হয় টাইম পত্রিকার জনক।

তবে জনকের দৌড়ে ব্রিটন হ্যাডেনই এগিয়ে। জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যেতে হ্যাডেনের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি কার্যকর। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে হ্যাডেন এবং লুস ছিলেন বন্ধু। বন্ধুর সঙ্গে তিনি এ পত্রিকাটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন।

হ্যাডেন যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকাগুলো ওপর বহুদিন থেকেই নজর রাখছিলেন। ভাবতেন নতুন কনটেন্টের স্টাইলের কথা। সাংবাদিকতার অন্যরকম আনন্দ খুঁজে বেড়াতেন। সেখান থেকেই মাথায় আসে ‘টাইম ম্যাগাজিন’ প্রকাশের ভাবনা।

ব্রিটন হ্যাডেনের জন্ম ১৮৯৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে। স্কুল জীবন থেকে তিনি লেখালিখি করতেন। স্কুল ম্যাগাজিনে তার লেখার প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকতো তার শিক্ষক ও বন্ধুরা। ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে তিনি ‘দ্য ডেইলি গ্লঙ্ক’ নামে হাতে লিখে একটি পত্রিকা বের করতেন।

রাস্তার মানুষদের বন্ধুরা মিলেই এ পত্রিকা বিলি করতেন। এভাবেই তিনি বেড়ে উঠেছেন। তিনি হচকিস রেকর্ড নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় লিখতেন। সেখানেও তার লেখায় মুগ্ধ হতো সবাই। নিজ দক্ষতায় হচকিস রেকর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন হ্যাডেন। ওই সময় হেনরি লুস ছিলেন অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানিজিং এডিটর। হ্যাডেন চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকেই বদলে যায় হচকিসের চেহারা।

ছুটিতে হ্যাডেন এবং লুস ভ্রমণে যান ক্যাম্প জ্যাকসনে। সেখানে যাওয়ার পথে দুজনের আড্ডা জমে ওঠে। আলোচনার পুরোটা সময়জুড়ে ছিল নতুন পত্রিকার ভাবনা। দুজনই চান এমন একটি পত্রিকা যেখানে পাঠককে খুব সহজবোধ্য ভাষায় সংবাদ এবং একইসঙ্গে সামাজিক বিষয়ে সচেতনার বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। পাঠকের অংশগ্রহণ থাকবে পত্রিকার প্রতিটি পাতায়। এ নিয়ে আলোচনা জমে থাকে। মজার বিষয় হলো দুজন তখনও পড়াশোনা শেষ করেননি।

হ্যাডেন ১৯২০ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর যুক্তরাষ্ট্রের আরেক জনপ্রিয় পত্রিকা ‘নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’ হ্যাডেনকে নিয়মিত লেখার জন্য আমন্ত্রণ জানান। পরের বছর হ্যাডেন চিঠি লেখেন লুসকে। লুসকে বাল্টিমোর নিউজে কাজ করার আমন্ত্রণ জানান। আর বলেন, এখানে একসঙ্গে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে নতুন পত্রিকা বের করার বিষয়ে আলোচনা করা যাবে।

অবকাশে দুজনের মধ্যে তর্ক জমে ওঠত। দুজনই কনটেন্ট নিয়ে আলোচনা করেন। বিষয়বস্তু কি হওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মন কি চায় এসব বিষয়ে দুজনের আলোচনা চলে অবিরাম। এটা ১৯২২ সালের ঘটনা। দুজনের বয়স তখন সবে ২৩।

এতো কম বয়সে তাদের স্বপ্ন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা প্রকাশ করার। দুজন কনটেন্ট স্টা‌ইলকে ভিন্ন ফরমেটের দিকে লক্ষ্য করা শুরু করলেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত সব পত্রিকা নিয়ে গবেষণা করছিল হ্যাডেন। তাই তার এসব বিষয়ে জানা।

অবশেষে সেই স্বপ্নের মুহূর্ত দুজনের হাতেই ধরা দিল। ৩ মার্চ, ১৯২৩। প্রকাশিত হলো টাইম ম্যাগাজিনের প্রথম সংখ্যা। হ্যাডেন হলেন সম্পাদক। প্রকাশক এবং বিজনেস ম্যানেজার লুস। প্রতিবছর প্রেসিডেন্ট পদটি দুজনই অদল-বদল করেন। প্রথম চার বছর হ্যাডেনই পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন। ধীরে ধীরে পত্রিকাটির জনপ্রিয়তাও বাড়তে থাকে। পাঠকের মনের কথাই যেন বলা শুরু করে সময়সেরা টাইম ম্যাগাজিন।

ভালো সময় খুব বেশিদিন থাকে না। হ্যাডেন হুট করেই অসুস্থ হয়ে গেলেন। ১৯২৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি হ্যাডেন মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন। কিন্তু মৃত্যুর আগে টাইম পত্রিকায় হ্যাডেন তার শেয়ার মা এবং পরবর্তী ৪৯ বছর পর্যন্ত তার পরিবারের ভোগ করার উইল করে যান।

অত্যন্ত দুঃখের হলেও সত্যি, হ্যাডেনের মৃত্যুর পর লুসের নতুন চরিত্র বের হয়। যে বন্ধুকে নিয়ে হ্যাডেন বিখ্যাত পত্রিকা প্রকাশের দৌড়ে নেমেছিলেন। সেই বন্ধুই অবশেষে হ্যাডেনের করা উইল সিন্ডিকেট তৈরি করে বাতিল করে দেন।

এমনকি টাইমের ইতিহাস থেকে ব্রিটন হ্যাডেনের নাম মুছে ফেলারও চেষ্টা করেন লুস। বলা হয়, হ্যাডেনের মৃত্যুর পর লুস দীর্ঘ সময় সম্পাদক ছিলেন। এ সময় তিনি একক ক্ষমতা প্রদর্শন শুরু করেন। লুসকে দেখানো ছাড়া একটা নিউজও ছাড়া যেত না।

এমনকি প্রকাশের ফাইনাল কপি লুস দেখার আগে কারও দেখার অনুমতি ছিল না। হ্যাডেন চলে যাওয়ার পর লুস পরবর্তী ৩৮ বছরে প্রায় ৩০০ টির ওপর বক্তৃতা দেন। সেখানে মাত্র চারটি বক্তৃতায় খুব সংক্ষেপে হ্যাডেনের কথা বলেন।

একক নিয়ন্ত্রণে নাস্তানাবুদ হলেও হ্যাডেনের তৈরি করা ভিন্ন স্টাইলেই লুস ‘টাইম’ পত্রিকাটি প্রকাশ করতে থাকেন। লুসের এমন আচরণ সংবাদপত্রের ইতিহাসের জন্য ধিক্কারজনক। হ্যাডেনের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করার জন্য এখন অনেকেই টাইম পত্রিকার জনক হিসেবে হাডেনের নামই উল্লেখ করেন। হ্যাডেনের তৈরি স্টাইলই এখন ‘টাইম স্টাইল’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত।

বন্ধুর এসব আচরণ হ্যাডেন দেখে যাননি। কারণ তিনি তখন না ফেরার দেশে। হয়ত জীবিত থাকা অবস্থাতেই দুবন্ধুর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কিন্তু তা প্রকাশ্য ছিল না। লুস একবার হ্যাডেন সম্পর্কে বলেন, আমাদের আগ্রহ কখনই এক ছিল না। তারপরও আমরা একসঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। আমরা একটা পত্রিকা দাঁড় করে ফেলেছিলাম। জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া ফেলে শুধু পত্রিকা নিয়ে ভেবেছি। সব কিছু ছেড়েছিলাম। শুধু আমরা দুজন একসঙ্গে ছিলাম। এজন্যই টাইম ম্যাগাজিন অটুট আছে।

প্রসঙ্গত, হ্যাডেন বেঁচে ছিলেন মাত্র ৩১ বছর। এতো কম বয়সে বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে শীর্ষে উঠে আসা মোটেও সহজ যুদ্ধ ছিল না। কিন্তু তা বাস্তব করেছেন হ্যাডেন। তবে হঠাৎ এ চলে যাওয়া টাইমের সমৃদ্ধ ইতিহাসের জন্যই থমকে যাওয়া এক ঘটনাই ছিল।

বাংলাদেশ সময়: ২১২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৩, ২০১২
সম্পাদনা: সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।