ঢাকা, সোমবার, ৫ শ্রাবণ ১৪৩২, ২১ জুলাই ২০২৫, ২৫ মহররম ১৪৪৭

ফিচার

ক্ষিপ্র গতির নিকি লাউদা

বাবু আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:৫৯, অক্টোবর ১৭, ২০১২
ক্ষিপ্র গতির নিকি লাউদা

আন্দ্রেয়াস নিকোলাস নিকি লাউদা। জন্ম ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৯।

সাবেক অস্ট্রিয়ান ফর্মুলা ওয়ান রেসার এবং তিনবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। বর্তমান তিনি একটি বিমান কোম্পানির মালিক।

পরিবারের অসম্মতি সত্ত্বেও জনপ্রিয় মিনি কুপারের কোম্পানির প্রথম দিকের গাড়ি ‘মিনি’ দিয়েই নিকির যাত্রা শুরু। কিছুদিন পরে তিনি সেন্ট্রাল ইউরোপে ফর্মুলা ভি’তে রেসিং শুরু করেন। হয়তো তার জীবন থেমে থাকতো সেখানেই; কিন্তু এরপরেই ১৯৭১ সালে মোটা অংকের ব্যাংকলোন নিয়ে ব্রিটিশ ফর্মুলা টু কোম্পানিতে রেসিং ড্রাইভার হিসেবে যোগ দেন।  

নিকির রেসিং পাগলামিতে পরিবারের ছিল ঘোর আপত্তি। পরিবারের সঙ্গে রেসিং ক্যারিয়ার নিয়ে একটি দ্বন্দযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। তবে নিকি পরিবারের কোনো কথাই শুনলেন না। খুব দ্রুতই তিনি মার্চ কোম্পানির হয়ে ফর্মুলা ওয়ানে আত্মপ্রকাশ করেন। একসঙ্গে তিনি ফর্মুলা টু’তেও মার্চের হয়ে রেসিং শুরু করে দিলেন। যদিও ফর্মুলা টু’তে ভালো করছিলেন কিন্তু তারপরেও ফর্মুলা ওয়ান’৭২ এ তার পারফরম্যান্স ছিলো হতাশাজনক।

অন্যদিকে তিনি ব্যাংকলোনের ঋণে ডুবে ছিলেন। বিষয়টি ছিল ক্যারিয়ারের জন্য আত্মঘাতি। এরপরও  ১৯৭৩ সালে আরেকটি ব্যাংকলোন নেন। যোগ দেন ‘বিআরএম’ প্রতিষ্ঠানে। বিআরএম হলো ব্রিটিশ ফর্মুলা ওয়ান কোম্পানি। নিকি ছিলেন দ্রুতগামী কিন্তু তার দল বিআরএম খুবই ধীর।

এরপরেই আসে তার জন্য সবচেয়ে বড় সুযোগ। যখন তার দলের মেট ক্লে রেগাজনী ফেরারিতে আবার যোগ দেয়। ফেরারির মালিক এনজো ফেরারি নিকি সম্পর্কে ক্লেকে জিজ্ঞেস করেন। নিকির পক্ষে ক্লে কথা বলেন এবং এরপরই ফেরারির জন্য চুক্তিতে সই করা হয়। নিকি লাউদার চুক্তি অনুযায়ী তার সমস্ত ঋণ বাবদ আরও অর্থ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

এরপরেই ফেরারির দলটি রেসিংয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। নিকির উপর ফেরারির মালিক অাস্থা করেছিলেন। এর জবাব দিতে তিনি খুব বেশি দেরি করেননি। ফেরারির হয়ে প্রথম রেসেই আর্জেন্টিনা গ্র্যা প্র্যি-তে দ্বিতীয় হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। পরে ফেরারির হয়ে ১৯৭২ সালের পর থেকে প্রথম গ্রাপ্র্যি-তে চ্যাম্পিয়ন হন নিকি লাউদা এবং সে বছরই তিনি শুধুমাত্র ডাচ গ্র্যা প্র্যি জিততে সক্ষম হন।
 
১৯৭৫ এর শুরুর দিকটা খুব একটা ভালো যায়নি নিকি লাউদার। প্রথম চারটা রেসে তিনি পঞ্চম স্থান অর্জন করেন। কিন্তু এরপরের ৫টা রেসের মধ্যে ৪টাই জিতে নেন লাউদা তার ফেরারি 312T দিয়ে। পরে আসে তার প্রথম বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব।

নিকি লাউদা তার সব ট্রফিগুলোর অর্থ দিয়ে দিতেন স্থানীয় গ্যারাজে। কারণ গাড়ি ধোয়া কিংবা সংস্করণ বাবদ ঋণ শোধ করতে হতো।

১৯৭৬ সালে ৬টি রেসের মধ্যে ৪টিই জিতে নেন এবং বাকি দুইটিতে দ্বিতীয় হন নিকি লাউদা। পঞ্চম জয় হিসেবে যখন ব্রিটিশ গ্র্যা প্র্যি’র ট্রফিটি নিজের হাতে নেন তখন তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দীর সঙ্গে তার পয়েন্টের পার্থক্য ছিলো প্রায় দ্বিগুণ।

১৯৭৬ সালে জার্মান গ্র্যা প্র্যি’র এক সপ্তাহ আগে নিকি লাউদা এক নম্বর রেসার হওয়া সত্ত্বেও রেসটি বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ ছিলো প্রায় ২৩ কিলোমিটার রেস সার্কিটের নিরাপত্তাহীন ব্যবস্থাপনা। বেশিরভাগ চালকই বয়কটের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার ফলে রেসটি হয়।

দ্বিতীয় ল্যাপের প্রথম বাঁকে নিকি লাউদার গাড়ি ট্র্যাক থেকে ছিটকে পড়ে পাশের রেলিংয়ের ওপরে। সঙ্গে সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আবার একটি গাড়ির সামনে এসে পড়ে। ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। অন্যান্য রেসাররা এবং সিকিউরিটি ক্রু’রা আসার আগেই লাউদার মাথার ডানদিক পুড়ে যায় এবং বিষাক্ত গ্যাস তার ফুসুফুস এবং রক্তের সাথে মিশে যায়।

নিকি লাউদার হেলমেটের ফোমগুলো গলে গিয়ে তার পুরো মুখে লাগে। যদিও তখন নিকির জ্ঞান ছিলো এবং দুর্ঘটনার পরপরই নিজের পায়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তিনি কোমায় চলে যান।
 
নিকির ডান কানের সঙ্গে তার মাথার ডানদিকের চুলও হারান এবং সেইসাথে ভুগতে থাকেন পোড়া মাথার অসহ্য যন্ত্রণায়। তার ডান চোখের পাতাও পুড়ে যায় আগুনে। শুধুমাত্র প্লাস্টিক সার্জারির সাহায্যেই তার শারীরিক সব ক্ষতি পুরণ করা যেত কিন্তু তিনি তা করতে রাজি হননি। দুর্ঘটনার পর থেকে তিনি টুপি পড়া শুরু করেন যাতে তার মাথার ডানদিকের ক্ষতচিহ্নগুলো ঢেকে রাখা যায়। পরের সময়ে তার ক্যাপের জন্য স্পন্সরও জোগাড় করে নেন।

নিকি লাউদা মাত্র ছয় সপ্তাহ পরেই এক রেসে ফিরে আসেন। তখনও তার ক্ষতগুলো ব্যান্ডেজে মোড়ানো। ফর্মুলা ওয়ান সাংবাদিক নিগেল রোবাক লাউদাকে দেখেন যে তিনি তার ক্ষত বিক্ষত মাথা থেকে রক্তাক্ত হেলমেট টেনে বের করছেন। রেসের সময় যাতে অস্বস্তিতে ভুগতে না হয়, সেজন্য লাউদার জন্য একটি বিশেষ হেলমেট তৈরি করা হয়। তার অনুপস্থিতিতে হান্ট বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন প্রতিযোগিতায় সঙ্গে তার পয়েন্টের ব্যবধান কমিয়ে আনেন।

নিকি লাউদা ওই রেসেও ২য় ল্যাপ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। কারণ হিসেবে তখনকার বৃষ্টিভেজা ট্র্যাক এবং তার চোখের অসুবিধার কথা উল্লেখ করেন। কিন্তু তারপরও তিনি এক পয়েন্টের ব্যবধানে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হান্টকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন। যা ফেরারির ইতিহাসে সাহসের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

এরপরেই তিনি ফেরারি থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করেন। যোগ দেন ব্রাভামে। দু বছর সাফল্যের পর রেসিং থেকে অবসরে যান। একইসাথে তিনি একটি অ্যায়ারলাইন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন এবং অস্ট্রিয়াতে ফিরে আসেন।

ব্যবসায় যখন নিকির অর্থের প্রয়োজন হয় তখন তিনি আবার রেসিং ট্র্যাকে ফিরে আসেন। কয়েকবছর পর আবার ১৯৮৫ সালের পর সম্পূর্ণভাবে অবসরে যান নিকি লাউদা। সাহসী নিকি বারবার নিজেকে প্রমাণ করেছেন। রেসিং দুনিয়ায় বলা হয়, নিকি লাউডা কখনও ফুরায় না। তার গতি অটুট থাকবে চিরকাল।  

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১২
সম্পাদনা: শেরিফ সায়ার, বিভাগীয় সম্পাদক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।