ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

দুই অতৃপ্তি নিয়েই চিরবিদায় নিলেন সুনীল

সোহেল রহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:৩১, অক্টোবর ২৯, ২০১২
দুই অতৃপ্তি নিয়েই চিরবিদায় নিলেন সুনীল

ঢাকা : আমার সম্পর্কে অনেক ভাল ভাল কথা শুনলাম। শুনতে শুনতে আমার মনে হচ্ছিল যে, অন্য কোনো লোক সম্পর্কে বলা হচ্ছে, আমার সম্পর্কে না... মরার পর এসব কথা বললে খুব ভাল হয়... কিন্তু মরার পর বলবে না বোধ হয়, মরার পরে আমার সম্পর্কে এত ভাল ভাল কথা কেউ বলবে না।

 

মৃত্যুর পাঁচ বছর (০৪ নভেম্বর, ২০০৭) আগে ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘কবিতা সংক্রান্তি’ প্রদত্ত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সংবর্ধনার প্রতিক্রিয়ায় একথাগুলো বলেছিলেন কবি ও সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
 
ওই অনুষ্ঠানে নিজের লেখালেখি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সত্যি কথা বলতে কী আমি লেখার ব্যাপারে খুব একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী কোনোদিনই ছিলাম না। লিখে কিছু একটা করবো, অমুক করবো, তমুক করবো এসব কিছুই না। এমনি যখন যা লিখতে ইচ্ছা করেছে লিখে গেছি। অনেক বেশি লিখে ফেলেছি। ”
 
এটা ঠিক যে, জীবিকার প্রয়োজনে ও দায়ে পড়ে অজস্র লিখেছেন সুনীল। কিন্তু অজস্র লিখলেও নিজের লেখা নিয়ে বরাবরই এক ধরনের অতৃপ্তি ছিল তাঁর। “নিজের কোনো লেখাই আমার ভাল লাগে না” বলে এসময় ঢাকার এক পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন তিনি।

নিজের অজস্র লেখালেখি প্রসঙ্গে ইতোপূর্বেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করেছেন সুনীল। এরমধ্যে ১৯৯৭ সালে ‘সানন্দা’র সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমি অনেক লেখাই লিখেছি যা না-লেখাই ভালো ছিল। এখন মনে হয় যে, আরও ধৈর্য্য ধরে, আরেকটু ভাল করে লেখা উচিত ছিল। লেখার ক্ষেত্রে অনেক তাড়াহুড়ো করেছি, অনেক এলেবেলে লিখেছি। এখন নিজেকেই প্রশ্ন করি, কেন লিখেছি? কী দরকার ছিল?”
 
একই সাক্ষাৎকারে সুনীল আরো জানান, একজন লেখক হিসেবে তার মনের মত লেখাটি তিনি এখনো লিখতে পারেননি। কখনো লিখতে পারবেন কি না তা-ও জানেন না।
 
একজন লেখক হিসেবে অতৃপ্তির পাশাপাশি ভালোবাসার জন্য ভীষণ একটা কাঙালপনাও ছিল সুনীলের মধ্যে। বলা যেতে পারে, এ দুই অতৃপ্তি নিয়েই চির বিদায় নিলেন সুনীল।
সুনীলের প্রিয় বা কাঙ্ক্ষিত মৃত্যুস্থান ছিল-- নেপোলিয়নের বাসভবন। একবার এক সাক্ষাৎকারে এ কথা জানিয়েছিলেন তিনি।
 
১৯৯০ সালে লন্ডনে একবার সুনীলের কাছে জানতে চাওয়া হয় যে, কবিতা লেখার ক্ষেত্রে তাঁর প্রিয় থিম কোনটি?

এর জবাবে তিনি বলেন, “ব্যর্থ প্রেম। ”
 
আবার প্রশ্ন করা হয়, জীবন থেকে নেওয়া?

সুনীল বলেন, “হ্যাঁ, সব সময় মনে হচ্ছে ব্যর্থ, সবকিছু ব্যর্থ। একটু ভালোবাসা চেয়েছিলুম, কেউ দিল না। ”
 
একই প্রসঙ্গে আরো অনেক পরে সানন্দা’র সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সুনীল বলেন, “ওটা (ভালোবাসা) পুরোপুরি পাওয়া যায় না। এ কষ্টটা থেকে যাবে। এছাড়া আর কী? আর সবই তো পেয়েছি। ”
 
সুনীল লেখালেখি শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে। জীবিকার তাগিদে টিউশনি থেকে শুরু করে মুদির দোকানের খাতা লিখে দেওয়া, অন্যের দরখাস্ত ইংরেজিতে অনুবাদ, সরকারি অফিসের কেরানিগিরি-- সবই করেছেন তিনি। পরে এক সময় জীবিকার প্রয়োজনে গদ্য লেখা শুরু করেন। প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে। সুনীলের মতে, “উপন্যাস মেয়েদেরই ভালো লেখা উচিত। কারণ তাদের পর্যবেক্ষণ শক্তি বেশি। ”
 
সুনীলের কবিতায় ‘নীরা’ এক রহস্যময় নারী। তিনি তাকে আড়ালেই রেখেছেন সারাজীবন।

নীরা প্রসঙ্গে যতবারই জানতে চাওয়া হয়েছে তিনি বলেছেন, “কবিতায় যা বলেছি এর বেশি বলতে চাই না। কবিতার মধ্যে যেমন সে আছে, সেভাবেই সে থাক। প্রত্যেক পাঠকেরও নিশ্চয়ই একজন নীরা আছে। কোনো পাঠকের কল্পনায় যদি কোনো নীরা থাকে, তাহলে সে তাকে তার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারে। ”

লেখালেখির ক্ষেত্রে নিজের জীবনকে অনেক বেশি ব্যবহার করেছেন সুনীল। লেখার বহু উপাদান তিনি নিয়েছেন জীবনের টুকরো টুকরো ঘটনা থেকে। তবে এগুলো পুরোপুরি আত্মজীবনী নয়। তার কথায়, “নিজের জীবনের ওপর ভিত্তি করেই লেখা, কিন্তু আত্মজীবনী নয়। এর মধ্যে অনেক কল্পনা আছে, অন্যান্য চরিত্রও মিশে গেছে। কিন্তু মূল কাঠামোটা হয়তো নিজের জীবনভিত্তিক। ”
 
কিন্তু নিজের জীবন নিয়ে আর কত লিখবেন সুনীল? কত আর নিজেকে খুঁড়ে খুঁড়ে বের করবেন? এ চেতনা থেকেই ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস লেখার দিকে ঝুঁকেন তিনি। এ ধারার প্রথম উপন্যাস ‘আমিই সে’। পরবর্তী সময়ে তাঁর হাত দিয়ে বেরোয় ‘সেই সময়’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’ ও ‘প্রথম আলো’র মতো আলোচিত উপন্যাস।

এ রচনাগুলো প্রসঙ্গে সুনীল বলেন, “এ উপন্যাসগুলো লেখার সময়ে টাইম ফ্রেমের দিকে বিশেষ সতর্ক থাকতে হয়েছে। কোনো ঘটনা যাতে নির্দিষ্ট সময়সীমার বাইরে চলে না যায়। তবে পুরো গল্পটা কখনোই মাথায় থাকে না। ”

১৯৯৯ সালে ‘অর্ধেক জীবন’ নামে দেশ প্রত্রিকায় ধারাবাহিক আত্মজীবনী লেখা শুরু করেন সুনীল। লেখার শুরুর দিকে এ প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, “নিজের আত্মজীবনী না-লেখারই বা কী আছে! আত্মজীবনী তো শুধু মহাপুরুষ বা মহাকবিরাই লেখেন না, অবসরপ্রাপ্ত সেনানী বা ছাড়পোকারাও লেখে। ”

পাঠক সুনীল : পাঠক হিসেবে সুনীল ছিলেন আগ্রাসী। হাতের কাছে যা পেতেন সবই পড়তেন। লেখালেখির শুরুর দিকে তিনি পড়েছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখের লেখা। এছাড়া গোয়েন্দা কাহিনী প্রচুর পড়েছেন তিনি। আগাথা ক্রিস্টির ৮০টি বইই তার পড়া। তার নিজেরও বিশ্বাস ছিল যে, গোয়েন্দা কাহিনী তিনি ভাল লিখতে পারবেন। কিন্তু সচেতনভাবেই তিনি সেদিকে যাননি। পরিণত বয়সে ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনীর (মিথ) প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট হন তিনি। এছাড়া বিদেশি সাহিত্যিকদের মধ্যে টি এস এলিয়ট, বোদলেয়ার, দস্তয়েভস্কি, ফ্রানৎজ কাফকা, শেক্সপিয়র প্রমুখের লেখার খুব ভক্ত ছিলেন তিনি।

রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ : রবীন্দ্র-পরবর্তী সময়ে লেখালেখির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রবলয় ও রবীন্দ্র কেন্দ্রিক লেখক-সাহিত্যিক চক্র থেকে বেরিয়ে আসার একটা প্রবণতা সেই সময়ের তরুণ লেখকদের মধ্যে দেখা গিয়েছিল। এসময় কট্টর রবীন্দ্রবিরোধী ছিলেন তারা। এ দলে নাম লিখিয়েছিলেন সুনীলও। ষাট দশকের গোড়ার দিকে নিজের লেখা এক কবিতায় সুনীল লেখেন, “তিন জোড়া লাথির ঘায়ে রবীন্দ্ররচনাবলী লুটোয় পাপোষে। ”

এর চল্লিশ বছর পর ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার এবং পুনরাবিষ্কার’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে সুনীল লেখেন, “পঙক্তিটি রচনার মতন দুষ্কর্ম আমারই, কিন্তু যেহেতু ছ’খানা পায়ের উল্লেখ আছে, তাই সমবেত কণ্ঠস্বরও বলা যেতে পারে’। আধুনিকরা সংখ্যালঘু এবং সংখ্যালঘু দলগুলো সাধারণত বেশি উগ্রপন্থি হয়। আমাদের রবীন্দ্রবিরোধী কথাবার্তা ও লেখায় অনেক সময় বাড়াবাড়ি রকমের উগ্রতা প্রকাশ পেয়েছে। ”
 
এ লেখার শেষে তিনি লেখেন, “কোনো নবীন লেখক যদি সূচনাপর্বে রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করে নিজস্ব ভাষা সন্ধানের চেষ্টা না করে রবীন্দ্রনাথেই আপ্লুত হয়ে থাকে, সে অতি মূর্খ। আর পরিণত বয়সেও যদি কোনো লেখক রবীন্দ্রনাথ থেকে দূরে সরে থাকে, তাঁকে জীবনযাপনের সঙ্গী করে না নেয়, তাহলে সে আরো বড় মূর্খ। ”  

বাংলাদেশ সময় : ১৪০০ ঘণ্টা, ২৯ অক্টোবর, ২০১২
সম্পাদনা: একে; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর jewel_mazhar@yahoo.com 

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।