ভারতীয় উগ্র হিন্দুবাদী সংগঠন শিবসেনার সদ্য প্রয়াত প্রধান বাল ঠাকরে তার রাজনৈতিক জীবনে একদিকে যেমন জননন্দিত হয়েছেন, তেমনি নানান কর্মকাণ্ডে ছিলেন বিতর্কিতও। কট্টর হিন্দুত্ব এবং বিশেষ করে মারাঠা বা মহারাষ্ট্রবাদী এই নেতা তার নানান কর্মকাণ্ডে বিতর্কের ঝড় তুলেছেন নিয়মিত।
নিজের সাংবাদিক এবং সম্পাদক পরিচয়কে বিস্মৃত হয়ে প্রায়ই বিভিন্ন পত্রিকার বিরুদ্ধে বিষোদগার করতেন। তার বা সেনা-বিজেপি শাসিত তৎকালীন মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে কিছু লিখলে শুরু হয়ে যেত অ্যাকশন। এমনকি পত্রিকা অফিসে শিবসেনার হামলা, ভাঙচুর, মারপিট ছিল সাধারণ ঘটনা।
যাহোক, পরষ্পরবিরোধী বক্তব্য আর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হুঁশিয়ারি-ধামকিতে ভারতের রাজনীতি ও মিডিয়া দীর্ঘ সময় সরগরম রেখেছেন এই নেতা। বাণিজ্য ও চলচ্চিত্র নগরী মুম্বাইয়ে প্রচণ্ড প্রভাবশালী এই নেতার বিরাগভাজন হয়ে ম্যালা ঝামেলা পোহাতে হয়েছে ভারতের শীর্ষ পর্যায়ের সেলিব্রেটিদেরও। জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে হুমকিতে থাকতে হতো প্রতিপক্ষ অনেককেই। অনেকেই তার কোপে পড়ার ভয়ে থাকতেন তটস্থ। ক্রিকেট বিস্ময় শচীন টেন্ডুলকার থেকে নিয়ে সর্বজন শ্রদ্ধেয় বর্ষীয়ান অভিনেতা দিলীপ কুমার, বলিউড কিং শাহরুখ খান, জয়া বচ্চন এমনকি নিহত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী তনয় রাহুল গান্ধী পর্যন্ত বাল ঠাকরের টার্গেট হয়েছেন। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে ‘হিটলিস্টে’ থাকা সবাইকে। এখানে বিভিন্ন সময়ে ঠাকরে সাহেবের কোপানলে যারা পড়েছেন, তাদের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজনের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হলো।

কট্টর মারাঠি আর হিন্দু জাতীয়তাবাদের অনুসারী শিবসেনা তথা এর প্রধান সদ্য প্রয়াত বাল ঠাকরে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে যান লিটল মাস্টারের ওপর। ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিদের অন্যতম শচীনকে রীতিমত জীবনের হুমকির মুখে পড়তে হয় এ ঘটনায়। পরে দেশজুড়ে প্রচণ্ড নিন্দার ঝড় বইতে থাকলে ঠাকরে সাহেব তথা শিবসেনা তাদের অবস্থান থেকে সরে আসে। প্রভাশালী মহলগুলোর মধ্যস্থতায় দু’পক্ষে সম্পর্কেরও দৃশ্যত কিছুটা উন্নতি হয়, কিন্তু সেই ক্ষতের দাগ নিশ্চয়ই শচীনের মনে এখনও শুকিয়ে যায়নি! যদিও শচীন তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন।


বাস, আর যায় কোথায়! মহারাষ্ট্রের ভাষা মারাঠির মান রক্ষায় এমএনএস আর এসএস (শিবসেনা) হুঙ্কার দিয়ে ওঠে। তারা বলে, জয়ার মুখ থেকে এ ধরনের কথা মহারাষ্ট্রের মানুষ সহ্য করবে না। বাল ঠাকরে জয়াকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে অভিহিত করেন।
২০০৮ সালের ওই ঘটনায় শিবসেনা এমপি সঞ্জয় রাউত জয়াকে উদ্দেশ করে বলেন, মুম্বাইতে খ্যাতি-যশ-অর্থবিত্ত বানানোর পর আপনার মুখে এ ধরনের কথা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
আর বাল ঠাকরে’র ভাইপো এমএনএস নেতা রাজ ঠাকরে বলেন, এভাবে মহারাষ্ট্রের লোকজনকে হেয় করার কোনো অধিকার রাখেন না জয়া বচ্চন। তিনি জয়া বচ্চনকে জনসমক্ষে উপস্থিত হয়ে মহারাষ্ট্রবাসীর কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাওয়া দাবি করেন। তিনি হুমকি দেন, অন্যথায় সিনেমা হল থেকে বচ্চন পরিবারের সদস্যদের অভিনীত চলমান সব ছবি নামিয়ে দেওয়া হবে। ওইসময় যেসব সিনেমাহলে অমিতাভ অভিনীত দ্য লাস্ট লিয়ার ছবিটি চলছিল, সেসব প্রেক্ষাগৃহে এমএনএস কর্মীরা হামলা চালানো শুরু করে। শেষ পর্যন্ত জয়ার স্বামী অমিতাভ বচ্চন নিজে দুঃখ প্রকাশ করার পর হলগুলোতে অমিতাভের ছবির প্রদর্শনী ফের শুরু হয়।

চলচ্চিত্রাভিনয় সূত্রে জায়া বচ্চন ও অন্যদের মত বোম্বাইবাসী শাহরুখ এক অনুষ্ঠানে নিজেকে ‘দিল্লিওয়ালা’ অর্থাৎ ‘দিল্লিবাসী’ বলেছিলেন (শাহরুখের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা দিল্লিতেই)। এতে করে বাল ঠাকরে তার পত্রিকা সামনা এবং শিবসেনাসহ উগ্র মারাঠাপন্থিরা অগ্নিশর্মা হয়ে দাঁড়ায় শাহরুখের বিরুদ্ধে। এই ক্ষোভ জয়া বচ্চনের বিরুদ্ধে শিবসেনা-এমএনএস’এর অবস্থানকেও ছাড়িয়ে যায় বহুমাত্রায়। সামনা পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে শাহরুখকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়, যদি তাই হয় তাহলে তিনি মুম্বাই ছেড়ে দিল্লি চলে যান না কেন?
এছাড়া শিবসেনার আপত্তির মুখেও ২০০৮ সালের আইপিএলে শাহরুখ তার মালিকানাধীন কলকাতা নাইট রাইডার্সে পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের খেলানোর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন ৯প্রসঙ্গত, ভারত পাকিস্তান ক্রিকেট সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের পক্ষে ছিলেন শাহরুখ)। এতে চরম ক্ষিপ্ত হন বাল ঠাকরে ও তার দল শিবসেনা। শিবসেনা ঘোষণা দেয়, ওই সময়ে মুক্তির অপেক্ষায় থাকা শাহরুখের আলোচিত মুভি ‘মাই নেম ইজ খান’ এর মুক্তি আটকে দিতে। ক্ষিপ্ত বাল ঠাকরে তার পত্রিকা সামনা’র মাধ্যমে কঠোর শ্লেষ-বিদ্রুপ আর সমালোচনায় বিদ্ধ করতে থাকেন ‘কিং খান’ খ্যাত এই অভিনেতাকে। ঠাকরে বলেন, শাহরুখের পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় পদক নিশান-ই-পাকিস্তান পাওয়া উচিৎ।
শিবসেনার পত্রিকায় এক কলামে বাল ঠাকরে আরও লেখেন, “খান নামের একজন শাহরুখ আমাদেরকে বলছে পাকিস্তানকে ভালোবাসতে। কিন্তু তার এ ধরনের বেঈমানীতে কারও দমবদ্ধ হয়ে আসছে না! বিশ্বাসঘাতকেরা, কংগ্রেসের আশীর্বাদে তোমরা যা ইচ্ছা করে যাও। সেনা তোমাদের কিছু বলবে না...”
ঠাকরে তার লেখায় শাহরুখকেও ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, শহরুখের মনে রাখা উচিৎ মুম্বাইতে ২৬/১১-এর হামলাকারীদের অধিকাংশই ছিল পাকিস্তানি।
জবাবে শাহরুখ জানান, তিনি শিবসেনার সঙ্গে বাগযুদ্ধে শামিল হতে চান না। ঠাকরে সাহেবকে একজন ‘বর্ষীয়ান ভদ্রলোক’ উল্লেখ করে কিং খান জানান, তার সঙ্গ তিনি উপভোগ করেন। তিনি বলেন, তিনি মুরুব্বীশ্রেণীর ভদ্রলোক। তার মন্তব্যের জবাবে আমিও কিছু বললে তিনি কষ্ট পাবেন। আমি তার সঙ্গে আগে অনেকবার দেখা করেছি। তিনি একজন শিল্পী এবং আমি তার সঙ্গ উপভোগ করেছি।
এ অবস্থায় সবাই ধারণা করেছিলেন অন্যদের মত শাহরুখও বাল ঠাকরের বাড়ি মাতশ্রীতে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে ক্ষমা চাইবেন বা বিষয়টির ফয়সালা করবেন।
কিন্তু এখানে শাহরুখ বেঁকে বসেন। তিনি তার বক্তব্যে অটল থাকেন এবং বলেন, আমি এমন কিছু বলিনি যা জাতি বিরোধী বা ভারত বিরোধী। আমি যা বলেছি তাতে অটল আছি এবং আমার ধারনা তারা (শিবসেনা) আমাকে ভুল বুঝছে। আমি এমন কিছু বলিনি যার জন্য আমার দুঃখিত হওয়া উচিৎ। ‘ঠাকরের সঙ্গে সমঝোতা করতে তার বাড়িতে যাবেন কি না’ প্রশ্নের জবাবে শাহরুখ বলেন, আমি সেখানে অনেকবার গিয়েছি। হ্যাঁ, আমি সেখানে আবারও যেতে চাই এবং তার সঙ্গে বসে চা-নাস্তা খেতে চাই। কিন্তু এই প্রসঙ্গে আমি সেরকম কোনো কারণ দেখি না...সেখানে গিয়ে তার কাছে... চাওয়ার কোনো কারণ দেখি না। তবে আমার অবস্থান বিষয়ে কাউকে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ার বিষয় থেকে থাকলে— আমি এটা এরই মধ্যে করেছি। আমি মনে করছি না এটা কোনো ইস্যু হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, অনেক সময়ে আমরা কট্টরপন্থি (মৌলবাদী) হয়ে পড়ি এবং ক্ষিপ্ত হই, আমরা তখন এতটাই আগ্রাসী হয়ে পড়ি যে অন্য পক্ষের যুক্তিটি কী তা গ্রাহ্য করি না। আমি মনে করছি, এক্ষেত্রে শিবসেনা আমার দৃষ্টিভঙ্গিটা বুঝতে পেরেছে।
তবে শেষ পর্যন্ত শিবসেনা শাহরুখের ছবি মাই নেম ইজ খান-এর মুক্তিতে বাধা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অবশ্য এর পেছনে পর্দার অন্তরালে ভারতীয় ক্ষমতাবলয়ের অনেক রথি-মহারথীকেই কলকাঠি নাড়তে হয়, মেলাতে হয় অনেক যোগ, বিয়োগ, গূণ, ভগের ফল।
যাহোক, বাল ঠাকরে সাহেবের মৃত্যুতে শাহরুখও শোক প্রকাশ করেছেন এবং মৃত্যুর আগে তার সঙ্গে দেখা করতে না পারার জন্য নিজেকে অপরাধী অনুশোচনা প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৭ ঘণ্টা, ২০ নভেম্বর, ২০১২
একে