ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২০ মে ২০২৫, ২২ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

একজন রাজাকার সব সময়ই রাজাকার: সাদেক আলী

সালেক খোকন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:৪৭, নভেম্বর ২১, ২০১২
একজন রাজাকার সব সময়ই রাজাকার: সাদেক আলী

“যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছার কথা শুনে মা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। ছেলেকে তিনি কিছুতেই ছাড়বেন না।

যুদ্ধে গিয়ে জীবন নিয়ে ফিরবে আদরের সন্তান! এই তার ভয়। মা আমাকে চোখে চোখে রাখলেন। যদি পালিয়ে যুদ্ধে চলে যাই। মাকে শান্ত করতে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেই, না, কখনোই যুদ্ধে যাব না। ”

বুড়িতলা আমাদের পাশের গ্রাম। একদিন দিনাজপুর শহর থেকে হানাদার পাকিস্তানি খানরা ঢুকে পড়ে সেখানে। ভয়ে গ্রামবাসী লুকায় খেত-খামারে। কাউকে না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয় পাঞ্জাবি খানরা। জ্বালিয়ে দেয় গোটা গ্রাম।
আশপাশের গ্রামের সবাই তখন ভয়ে তটস্থ। অন্যদের সঙ্গে পরিবারসহ আমরাও একদিন উতরাইল গ্রাম ছাড়ি। বনতারা ও খানপারের মাঝামাঝিতে ছিল ভারতীয় সীমান্ত। তা পেরিয়ে আমরা চলে আসি ভারতের ফকিরগঞ্জে। সেখানে এক আত্মীয়র বাড়িতে আশ্রয় নেই।

খানিক দীর্ঘশ্বাস। অতঃপর আবার বলতে থাকেন সাদেক আলী।

হানাদার পিশাচ খানদের ভয়ে দেশ ছেড়ে আমরা ভিন দেশে। এভাবে আর কতদিন? দেশটাকে তো মুক্ত করতে হবে। জানটা না-হয় যাবে। তাতে কী! নানা চিন্তা ঘুরপাক খায় মনে। এভাবে কত দিন বসে থাকব! মনে মনে যুদ্ধে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিই। মাকে জানাই না। দেশের টানেএক দুপুরে লুকিয়ে বেরিয়ে পড়ি। তবে কেউ না জানলেও মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সব পরিকল্পনার কথা জানতেন আমার বাবা মাঈনুদ্দিন সরকার।

প্রথমে ‘হিট অ্যান্ড রান’ এরপর ‘ফ্রন্ট ফাইট’

ট্রেনিং শেষে আমরা আসি ৭নং সেক্টরের বড়গ্রাম ক্যাম্পে। আমাদের ছিল ৩৮জনের একটি দল। কমান্ডার বসাদ মাস্টার। আমাদের ওপর অপারেশন নির্দেশনা ছিল ‘হিট অ্যান্ড রান’। ঊর্ধ্বতন কমান্ডারদের নির্দেশ মত বড়গ্রাম ক্যাম্প থেকে আমরা অপারেশন চালাই দাইনর, পাতইলশাহ, হাকিমকুড়ি, বড়গ্রাম, ত্রিশুলা, মোহনপুর এলাকায়।

অক্টোবর মাস শেষ প্রায়। যুদ্ধ চলছে পুরোদমে। একটা সাকুর্লার জারি হলো। এখন আর ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতির গেরিলা আক্রমণ নয়। ফ্রন্ট ফাইটে অর্থা‍ৎ সম্মুখ সমরে যেতে হবে। প্রথম প্রথম কিছুটা ভয় পেতাম। মায়ের কথা খুব মনে পড়ত। আদরের একমাত্র বোন মনোয়ারার কথা মনে হলে বুকটা হু হু করে উঠত।  
সাদেক আলীর গম্ভীর কন্ঠ একটু বিরতি নিল। তার কথার সুর আমাদের নিয়ে গিয়েছে ৪১ বছর আগের ঘটনাগুলোতে। দম নিয়ে ফের বলা শুরু করলেন--

৬ নভেম্বর, ১৯৭১। পরিকল্পনা হয় মোহনপুরের ত্রিশুলায় পাকিস্তানি ক্যাম্প আক্রমণের। ইন্ডিয়ান আর্মিসহ আমরা ২০০জন। কমান্ডে ছিলেন ফজলুর রহমান স্যার (যিনি পরবর্তীকালে বিডিআর মহাপরিচালক হয়েছিলেন) এবং ইন্ডিয়ান আর্মির ক্যাপ্টেন এসএস বাট। বড়গ্রাম ক্যাম্প থেকে আমরা বনতারা সীমান্ত দিয়ে ঢুকে পড়ি। পরিকল্পনামতো ফকিরগঞ্জ থেকে ত্রিশুলার দিকে আর্টিলারি শেল (গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণ) চালানো হলো। এই ফায়ার সাপোর্টে ভর করে আমরা অগ্রসর হলাম লক্ষ্যের দিকে।

খুব কাছ থেকে দেখেছি সহযোদ্ধার মৃত্যুযন্ত্রণা

রাত ২টা। ত্রিশুলা ক্যাম্পের চারপাশে আমরা পজিশন নেই। আতংকিত পাকি খানরা আমাদের দিকে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়ছে। কিন্ত আমাদের চর্তুমুখী আক্রমণের কাছে টিকতে পারে না। ক্যাম্পের প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে পালানো শুরু করে কাপুরুষের দল। ভোরের দিকেই আমরা তাদের ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিই। কিন্ত সে অপারেশনে বুকে গুলি লেগে শহীদ হন প্রফুল্ল নামে এক মুক্তিযোদ্ধা। খুব কাছ থেকে দেখেছি তার মৃত্যুযন্ত্রণা। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল। তখনও জানি না কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য!

মোহনপুরে ছিল পাকিস্তানিদের আরেকটি শক্তিশালি ঘাঁটি। ত্রিশুলা দখলের দিনই পরিকল্পনা হয় সেখানটায় আক্রমণের। ক্যাম্পে ফিরেই আমরা আক্রমণের সব কৌশল জেনে নিই।

দেখলাম, ডান পায়ের একটি অংশ নেই

৭ নভেম্বর ১৯৭১। বড়গ্রাম ক্যাম্প থেকে আমরা যখন আবার ত্রিশুলা ক্যাম্পে পৌঁছাই, তখন রাত প্রায় ২টা। ত্রিশুলা থেকে মোহনপুর যাওয়ার একমাত্র রাস্তাটি ছিল কাঁচা। রাস্তার এখানে সেখানে বড় বড় গর্ত। পাকি হানাদররা সেখানে বিছিয়ে রেখেছে অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন। কিন্ত তবুও সে পথেই আমাদের এগোতে হবে। আমরা এগোই। হঠাৎ আমাদের সামনে একটি গর্ত পড়ে। সবাই লাফিয়ে পার হয় সেটি। আমি ছিলাম মাঝের সারিতে। গর্ত পাড় হতেই আমার পা পড়ে একটি উঁচু জায়গাতে। অমনি বিকট শব্দ। আমি ছিটকে পড়ি। সবাই শুয়ে পজিশন নেয়। আমি তখনো কিছুই বুঝতে পারিনি। দাঁড়াতে যাব, কিন্ত ডান পা ফেলতে পারছিলাম না। খেয়াল করে দেখলাম, ডান পায়ের একটি অংশ নেই। পায়ের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে যাই। ওই অংশটুকু উড়ে গেছে। আজও পায়ের দিকে তাকালে সেনিকার সবকিছু চোখের সামনে যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে।

কেন যুদ্ধে যাবেন?
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথার পিঠে কথা চলছে। প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে দিনাজপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যালয়ে ৩ নভেম্বর ২০১১ তারিখ দুপুরে কথা বলতে এসেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সাদেক আলী।

মাঈনুদ্দিন সরকার ও শমিরুন্নেছার পুত্র সাদেক আলীর বাড়ি দিনাজপুরের কোতোয়ালি থানার গোদাগাড়ী ইউনিয়নের উতরাইল গ্রামে। বর্তমানে বয়স ৬২ বছর। কিন্ত ১৯৭১-এ ছিলেন উদরানি স্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্র। ফুটবল খেলতে পছন্দ করতেন। আজও তার মনে পড়ে বাল্যবন্ধু শাহজাহান, কিরন, কালীসহ অনেকের কথা। যুদ্ধাহত ভাতা আর ঢাকার ফুটপাতে কাপড়ের ব্যবসা করে যা পান, তা দিয়েই চলে তার সংসার।

ফকিরগঞ্জ রিক্রুটিং ক্যাম্পে সাদেক আলীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল “কেন যুদ্ধে যাবেন?” একই প্রশ্ন আমরাও করি। উত্তর ছিল-- দেশকে বাঁচাতে যুদ্ধ করতে চাই। দেশ না বাঁচলে তো আমরা বাঁচব না!

প্রথম প্রাণসাগরে সাতদিন লেফট-রাইট অতঃপর শিববাড়ী, রায়গঞ্জ, তরঙ্গপুর হয়ে শিলিগুড়ির পানিঘাটায় সাদেক আলী ট্রেনিং নেন ২৮দিনের। ১৪৮৭ ছিল তার এফএফ নং।

মেয়েগুলোর শরীর সিগারেটের আগুনে ঝলছে দেওয়া হয়েছিল সেসময়কার দেশের অবস্থা নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেন এই যোদ্ধা।   “মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদেরকে মুড়ি, চালভাজা, পানি আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নানা খবরাখবর দিয়ে সাহায্য করতো সাধারণ মানুষ। খবর পেতাম রাজাকাররা লুটতরাজ করছে, মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে খানদের ক্যাম্পে। ত্রিশুলা ক্যাম্প থেকে আমরাও উদ্ধার করি বিবস্ত্র অবস্থায় তিনজন মেয়েকে। তাদের সারা শরীর সিগারেটের আগুনে ঝলছে দেওয়া হয়েছিল। ”

কোথায় চিকিৎসা নিলেন? সাদেক আলীর উত্তর, “প্রথম ভাবিনি বেঁচে যাব। আমার পাশেই ছিল বগুড়ার ইসহাক, সাবের মৌলভী, রহমান সোনাহার। একটি কাঠের তক্তায় করে তারা আমাকে তুলে নিয়ে পৌঁছে দেয় বড়াহার ক্যাম্পে। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে রায়গঞ্জ হাসপাতাল, শিলিগুড়ি আর্মি হাসপাতাল, উত্তর প্রদেশের এমএস খিরকী হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে কৃত্রিম পা সংযোজনের জন্য আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় পুনা হাসপাতালে। সেখানেই দেড় মাস থেকেছি কর্নেল তাহের স্যারের সঙ্গে। ”

খাওয়ার সময় সবাইকে কাছে ডেকে বসাতেন কর্নেল তাহের

কর্নেল তাহেরকে কেমন দেখেছেন?

“অসাধারণ মানুষ। অনেক বড় মনের মানুষ ছিলেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর থেকে ভালোবাসতেন। তিনি ছিলেন অফিসার্স কেবিনে। কিন্তু খাওয়ার সময় সবাইকে কাছে ডেকে বসাতেন। উৎসাহ দিতেন। দেশের কথা বলতেন। দেশ স্বাধীনের খবরের দিন তিনি বলেছিলেন, “চলো, দেশে ফিরে যাই; যে দেশের জন্য তোমরা ত্যাগ স্বীকার করেছ। ” আমি কর্নেল স্যারকে বলতাম, দেশ তো স্বাধীন হলো স্যার, কিন্ত আমাদের তো পা নেই। আমাদের কী দাম আছে। বিয়ের জন্য তো মেয়েও দেবে না কেউ। ” কথা শুনে তিনি শুধু হাসতেন।
দীর্ঘনিঃশ্বাস!

স্বাধীন দেশের অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করতেই সাদেক আলী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন। তার ভাষায়, দেশ তো স্বাধীন করলাম। কিন্তু এ কোন দেশ দেখছি! আমরা তো আগাতে পারছি না। দেশের মধ্যে যত দুর্নীতি, এ দেশকে কি ভালোবাসা যায়?”

কী করলে দেশ এগোবে? এমন প্রশ্ন করতেই তিনি দৃঢ় কন্ঠে বলেন, “দেশের স্বার্থে সবাইকে একতাবদ্ধ হতে হবে। ঝড়গাঝাটি, মারামারি, হানাহানি রেখে দেশের জন্য সবাই এক হয়ে কাজ করলে দেশটা অন্য রকম হবে। ”
রাজাকারদের প্রসঙ্গে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “একজন রাজাকার সব সময়ই রাজাকার। স্বাধীন দেশে এদেরই তো সবার আগে বিচার হওয়া প্রয়োজন ছিল। ”

মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, “এখন তো রাজনৈতিক ফায়দার জন্য বছর বছর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে। ” তার মতে, তালিকা তৈরির উপযুক্ত সময় ছিল বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলে। সেসময় ক্যাম্পে ক্যাম্পে ছিল সব তথ্য। ফলে সহজেই মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা তৈরি করা যেত।
মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে বিভক্ত হওয়া প্রসঙ্গে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সাদেক আলী বলেন, “এটি ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। এতে সত্যিকার অর্থে মুক্তিযোদ্ধাদের মেরুদণ্ডই ভেঙ্গে পড়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি আর একতা নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে আজ আর আমরা জাতির কাছে দাঁড়াতে পারছি না। ”

স্বাধীন দেশে ভালো লাগার অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, “দেশটা স্বাধীন, এটাই তো সুখ!”

সাদেক আলীর নাতি সাব্বির হোসেন। ক্লাস এইটের ছাত্র সে। মাঝে মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধা দাদাকে ঘিরে ধরে সে। শুনতে চায় মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সব কথা। সাদেক আলীও আনন্দভরা মন নিয়ে স্মৃতির ভাণ্ডার উজার করে দেন। মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনে সাব্বির গর্বিত হয়। বলে, “দাদা এত কষ্টে আমরা দেশ পেয়েছি!” সাদেক আলীও তখন নাতির উদ্দেশ্যে বলেন, “আমরা মুক্তিযোদ্ধারা একদিন থাকব না। কিন্তু ভবিষ্যতে তোমরাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিবে সবার কাছে। ”

দেশে আছে নানা সমস্যা তবুও তো কারও গোলাম নই আমরা। তাই মুক্তিযোদ্ধা সাদেক আলী শত আশায় বুক বাঁধেন। পরবর্তী প্রজন্ম কখনো ইতিহাসভ্রষ্ট হবে না। এমনটাই তার বিশ্বাস।

সালেক খোকন : লেখক ও গবেষক

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, ২১ নভেম্বর, ২০১২
সম্পাদনা: একে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।