ঢাকা: চিংড়ি চাষে বিপ্লব আনবে প্রো-বায়োটিক( রোগ প্রতিরোধক ব্যাকটেরিয়া)। নব আবিষ্কৃত এ প্রো-বায়োটিক ক্ষতিকারক ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ও বিভিন্ন রোগবালাইয়ের প্রকোপ থেকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাতকে সুরক্ষা দেবে এমনই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন চিংড়িচাষ সংশিষ্ট বিজ্ঞানী ও গবেষকরা।
প্রাকৃতিক এ উপাদানের ব্যবহার সম্ভাবনাময় শিল্পটির মানসম্পন্ন উৎপাদন বৃদ্ধিতে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বহির্বিশ্বে রফতানিকৃত বাংলাদেশি চিংড়ির ইমেজ বৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তারা।
এছাড়া মড়কের ফলে সম্প্রতি অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়া চিংড়ি শিল্পে প্রো-বায়োটিকের ব্যবহার এ শিল্পে আবারও নতুন প্রাণ সঞ্চার করবে, এমনটাই আশা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রাণীদেহে রোগ-প্রতিরোধের ক্ষেত্রে প্রো-বায়োটিকের ব্যবহার নতুন না হলেও এক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
অপরদিকে, দেশের বাইরে থেকে আনা প্রো-বায়োটিক বেশির ভাগই আমাদের দেশে ব্যবহার উপযোগী নয়। ফলে ব্যবহারেও তেমন একটা সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
এমন প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ উপযোগী প্রো-বায়োটিক তৈরির জন্য বর্তমানে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. এম মঞ্জুরুল করিম । প্রাথমিকভাবে তার এ গবেষণার লক্ষ্য চিংড়ির রোগবালাই দমন ও প্রতিরোধে প্রো-বায়োটিকের উদ্ভাবন এবং তার উপযুক্ত প্রয়োগ।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি রিসার্চ সেন্টার যৌথ ভাবে এ গবেষণায় অর্থসংস্থান করছে।
সম্প্রতি ড. করিম তার গবেষণার বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেন বাংলানিউজের সঙ্গে।
প্রতিবেদকের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতার তিনি বলেন, “বিভিন্ন রোগবালাই, বিশেষ করে ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ দেশে চিংড়ি উৎপাদনের বড় অন্তরায়। চিংড়ির মড়কে উদ্বিগ্ন চাষিরা রোগবালাই দমনে কার্যকর এমন কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ও কেমিক্যাল ব্যবহার করেন যা ক্যান্সারের মত ঝুঁকিপূর্ণ রোগ সৃষ্টির ক্ষমতা রাখে। উদাহরণ স্বরূপ নাইট্রোফিউরান, ম্যালাকাইট গ্রিন ইত্যাদির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এ ধরণের উপাদানের অস্তিত্ব শনাক্তযোগ্য, যা আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ি রপ্তানির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ”
মঞ্জুরুল করিম আরোও বলেন, “২০০৯-১০ সালে চিংড়ি রপ্তানিতে ধস নামার পরবর্তী সময়ে বিষয়টি নিয়ে অনেক পরীক্ষানীরিক্ষা চালানো হয়। বর্তমানে সেই নেতিবাচক ধারণা বহুলাংশে কেটে গেলেও চিংড়ি উৎপাদনে রোগবালাইয়ের প্রকোপ একটি বড় সমস্যা হিসেবেই থেকে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে একটি বিজ্ঞান সম্মত পরিত্রাণের জন্য দেশে ব্যবহারের উপযোগী প্রো-বায়োটিক উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা শুরু করি। ’’
নিজের গবেষণা পদ্ধতির বিভিন্ন বিষয় ব্যাখা করে তিনি বলেন, “আমাদের প্রকৃতিতে শতকরা ৯৯ ভাগ অণুজীবই (ব্যাকটেরিয়া) উপকারী। মাত্র শতকরা এক ভাগ অণুজীব প্রাণীদেহের জন্য ক্ষতিকারক। প্রো-বায়োটিক হচ্ছে এমন এক ধরণের উপকারী ব্যাকটেরিয়া, যা প্রাণীদেহে অপকারী রোগজীবাণুর বিপরীতে শুধু প্রতিষেধক নয়, বরং প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করবে। ”
গবেষণার অংশ হিসেবে মঞ্জুরুল করিম ও তার টিম চলতি বছরের মে-জুন মাসে চিংড়ির মড়কে আক্রান্ত উপকূলীয় জেলা খুলনা ও সাতক্ষীরার বেশ কিছু চিংড়ি ঘের পরিদর্শন করে সেখান থেকে বেশ কিছু নমুনা সংগ্রহ করেন। এর মধ্যে রয়েছে মৃত চিংড়ি মাছ, ব্যবহার করা খাবার ও ঘেরের পানি। সংগৃহীত এসব নমুনা গবেষণাগারে নিবিড় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ভিব্রিও ও সিগেলা নামের প্রধানত দু’ধরণের প্যাথোজেন (ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া) শনাক্ত করতে সক্ষম হন তারা।
গবেষক দল পরবর্তীতে ক্ষতিকারক এ দুই প্যাথজেন প্রতিরোধী উপাদান শনাক্তের জন্য নিরন্তর গবেষণা চালান। গবেষণার ধারাবাহিকতায় মড়ক কবলিত এলাকা থেকে তারা ১৮ প্রকারের প্রতিরোধী ল্যাকটোবেসিলাস ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করতে সক্ষম হন।
মঞ্জুরুল করিম জানান, এই ১৮ প্রকারের ব্যাকটেরিয়া এমন কিছু পদার্থ নিঃসরণ করে যা ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া ভিব্রিও ও সিগেলাকে প্রতিরোধ করার জন্য যথেষ্ট। অপরদিকে, মানুষ ও চিংড়ি চাষ; সার্বিক ভাবে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য মোটেও ঝুঁকিপূর্ণ নয় এসব ল্যাকটোবেসিলাস।
তবে উপকারী ল্যাকটোবেসিলাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করাটাই এই মুহূর্তে গবেষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মন্তব্য করেন ড.মঞ্জুরুল করিম।
‘এ গবেষণায় কার্যকর ফল মিলবে’ এমন আশাবাদের কথা জানিয়ে ড. মঞ্জুরুল করিম বলেন, “শনাক্ত করা ল্যাকটোবেসিলাসের প্রতিরোধের সক্ষমতা আরো কিভাবে বৃদ্ধি করা যায় তা নিয়ে আরো অধিকতর গবেষণা চলছে। ৫ বছর আগে শুরু করা এ গবেষণার পূর্ণাঙ্গ ফল পেতে আরো অন্তত এক বছর সময় লেগে যেতে পারে। ”
দেশের বাইরের প্রো-বায়োটিক ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমাদের দেশের গাছ যেমন অন্য দেশের প্রকৃতিতে খাপ খাওয়ানো অনেকাংশেই সম্ভব হয় না, তেমনি অন্য দেশের প্রোবায়োটিক দেশে ব্যবহারের ক্ষেত্রেও ফলাফল অনুরুপ। ”
বিদেশ থেকে আনা প্রোবায়োটিক অনেক ক্ষেত্রেই কাজে দিচ্ছে না বলে জানান তিনি। তাই দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ এবং এখানকার প্রাণীদের রোগ প্রতিরোধী সক্ষমতা বিবেচনা করেই প্রোবায়োটিক তৈরি করতে হবে, যাতে তা সহজেই দেশের প্রকৃতি ও আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খেতে সক্ষম হয়।
দেশের উপযোগী এ প্রোবায়োটিক তৈরি সম্ভব হলে চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বলে উল্লেখ করে ড.করিম। বিশেষ করে, আন্তর্জাতিক বাজারে যখন প্রোবায়োটিকের ব্যবহার অনেকটা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে।
যে ভাবে দেখছে মৎস্য বিভাগ
দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত চিংড়ি শিল্পের উন্নয়নে, বিশেষত উৎপাদন বৃদ্ধি ও রোগ বালাই নিয়ন্ত্রণে দেশের উপযোগী প্রোবায়োটিক তৈরির গবেষণাকে অত্যন্ত ইতিবাচক ও সময়োপযোগী হিসেবে দেখছে বাংলাদেশের মৎস্য বিভাগ। এ গবেষণায় সাফল্য অর্জিত হলে তা চিংড়ি শিল্পের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে দাবি করেছে কর্তৃপক্ষ।
মৎস্য অধিদপ্তরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিত্য রঞ্জন বিশ্বাস এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, “গবেষণা ছাড়া কোন কার্যকর উন্নয়ন হয় না। ভাল ফলাফল আনতে গবেষণার বিকল্প নেই। চিংড়ি চাষে রোগবালাই দমনে দেশের উপযোগী প্রোবায়োটিক তৈরির গবেষণা অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এ গবেষণায় সফলতা আসলে তা চিংড়ি শিল্পের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। বিদেশ থেকে প্রোবায়োটিক কিনে আনার খরচ থেকেও রক্ষা পাওয়া যাবে। ”
মাছ চাষে ক্ষতিকারক অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বন্ধ করতে মৎস্য বিভাগ ইতোমধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি চালু করার পাশাপাশি এবং নিয়মিতভাবে মনিটরিং করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এর ফলে অ্যান্টিবায়োটিকের কন্টামিনেশন পর্যায়ক্রমে কমে আসছে। ’
এছাড়া গত বছর সারা দেশ থেকে সংগৃহীত মৎস নমুনায় অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রা শতকরা ৬.২৫ ভাগ থাকলেও এক বছরের ব্যবধানে অ্যান্টিবায়োটিকের এ মাত্রা শতকরা ২.৯৮ ভাগে নেমে এসেছে বলে দাবি করেন তিনি।
পাশাপাশি মড়কের কারণে চিংড়ি রপ্তানিতে বহির্বিশ্বে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিলো তা অনেকাংশেই পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছে উল্লেখ করে নিত্য রঞ্জন বিশ্বাস বলেন, ‘‘ চিংড়ির মড়ক মানেই ভাইরাস সংক্রমণ-প্রচলিত এমন ধারণা মোটেও ঠিক নয়। এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হওয়া জরুরী। ২০০৯ সালে বেলজিয়ামের একটি ল্যাবরেটরিতে আমাদের দেশ থেকে রপ্তানি হওয়া গলদা চিংড়িতে অ্যান্টি রেসিডিও থাকা সংক্রান্ত যে খবর ছড়িয়ে পড়ে তা প্রকৃতপক্ষে সঠিক ছিলো না। এ প্রচারণায় ফলেই ২০০৯-১০ সালের মে মাস পর্যন্ত রপ্তানি বন্ধ ছিলো, এছাড়া ফেরত আসে বিদেশ থেকে রপ্তানিকৃত চিংড়ির ৫৪টি চালান। ’’
তিনি বলেন, “বেলজিয়ামের ল্যাবে পাওয়া সেমি কার্বাজয়েড নামক উপাদানটি মূলত চিংড়ির খোসায় থাকে। তবে এ উপাদানটি প্রাকৃতিক ও অ্যান্টি বায়োটিকের প্রয়োগ-এ দু’ভাবেই সৃষ্ট। কিন্তু রপ্তানির সময় আমরা খোসা ফেলেই প্যাকেটজাত করি। তাই এ সংক্রান্ত প্রচারণাটি সঠিক ছিলো না। এমনকি একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক অসংখ্য সেমিনারের মাধ্যমে তা আমরা প্রমাণ করতেও সক্ষম হয়েছি। ’’
নিত্য রঞ্জন বিশ্বাস আরো বলেন, “সরকারের এসব তৎপরতার ফলেই ২০১১-১২ অর্থ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে ৯২ হাজার ৪শ’ ৭৯ মেট্রিক টন, আর এর মাধ্যমে আয় হয়েছে ৪ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা। ”
বাংলাদেশ সময়: ২০০৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১২
এআই/সম্পাদনা:রাইসুল ইসলাম,নিউজরুম এডিটর eic@banglanews24.com