ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২০ মে ২০২৫, ২২ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

‘বাম হাতে তাবিজ আছে তা দেখে আমার লাশ নিও...’

সাজ্জাদ হোসেন বাপ্পি, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৩১, নভেম্বর ২৭, ২০১২
‘বাম হাতে তাবিজ আছে তা দেখে আমার লাশ নিও...’

রংপুর: বাবা আমাকে বিশটা টাকা দাও। আমার কাছে টাকা নাই!

কারখানার উদ্দেশ্যে বের হওয়ার আগে এই ছিল বাবা রফিকুলের সঙ্গে ছেলে পলাশের শেষ কথা।

বাবা ২০টি টাকা দিয়েওছিলেন ছেলেকে।

জীবিকার তাগিদে মা-বাবাসহ গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসা পলাশ কাজ করতো সাভারের আশুলিয়ার বিভিন্ন পোশাক কারখানায়। সর্বশেষ কর্মস্থল ছিল তাজরীন। শনিবার ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগার পর মৃত্যুফাঁদ থেকে বাঁচার আঁকুতিতে মা-বাবার সঙ্গে মোবাইল ফোনে বারবার যোগাযোগ করেছে। ছেলের ফোনে পাগলিনি হয়ে মা ছুটেও এসেছেন তাজরিন ফ্যাক্টরিতে। কিন্তু আগুনের ভয়াবহতায় দমকলকর্মীরাই কাছে ঘেঁষতে পারছিল না, সেখানে তিনি যান কী করে। কিছুই করতে পারেননি মা গোলাপী বেগম। চরম অসহায়ত্বের পদতলে মাথা কুটেছেন। আর ওদিকে ছেলে কয়েক গজ দূরে ধোঁয়ায় দম আটকে পুড়ে পুড়ে মরছে!

একপর্যায়ে পলাশ তার মাকে ফোনে বলে, “মা আমাকে বাঁচাও! আমাকে বাঁচাও মা!”

পরে বলে, “আমাকে বাঁচাতে না পারলে আমার বাম হাতে তাবিজ বাঁধা আছে। আর কোমরে বাঁধা আছে কালো গেঞ্জি, এর সঙ্গে বাবার দেওয়া বিশ টাকা পকেটেই আছে, খরচ করিনি। এখন আমি একটা বাথরুমে আছি, মারা গেলে এখান থেকে আমার লাশ বাড়িতে নিও। ’’

এই বলে মা গোলাপী বেগম হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন সাংবাদিকদের সামনে। একমাত্র ছেলেহারা মায়ের কান্নায় আকাশ বাতাস যেন নিথর নিস্তব্ধ। মঙ্গলবার দুপুরে রংপুরের মিঠপুকুর উপজেলার লতিবপুর ইউনিয়নের বড়বাড়ি গ্রামের এ দৃশ্যে পাষাণেরও বুঝি অন্তর ভিজেছে লোনা পানিতে।

পলাশের বাবা শারীরিক অসুস্থতার কারণে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন কিছুদিন আগে। মাও কাজ-কাম তেমন একটা করতে পারছিলেন না। ফলে একমাত্র ছেলের আয় দিয়েই চলছিল তাদের চারজনের সংসার। কিন্তু তাজরিনের আগুন কেড়ে নিল তার সব। সত্যিকার অর্থেই পঙ্গু হয়ে গেল পরিবারটি।

গোলাপী বেগম জানান, যখন ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগে তখন পলাশ বাইরে আসার জন্য বার বার চেষ্টা করেছে। কিন্তু গেটের দারোয়ান আর অফিসের লোকজন তাকে বের হতে দেয়নি বলে আমাকে মোবাইলে জানায়।

ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল। শেষে না পেরে বাথরুমে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল পলাশ।

মা বলেই চলেন, “মুই মোর বাবাক কং বাবা দজ্জা ভাঙ্গি তুই মোর কাছত চলি আয়, বাবা মোর কথা শুনলো না, তুই মোক একলায় থুইয়া চলি গেলু বাবা। ”

মায়ের কথা ফুরায় না, “বাবাকে প্যান্ট-শার্ট গাত দিলে কাইও কবার নয় সে গরীব মানসের ছৈল । সে এত ভালো ছিল (ছেলে দেখতে এত সুন্দর ছিল যে প্যান্ট-শার্ট পরলে গরীব মানুষের ছেলে বলে মনেই হতো না)। আল্লাহ তুই তাকে ক্যান নিলি। তাকে বাদ দিয়ে আমাকে ক্যান নিলি না। ’’

আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর ওই বাথরুম ভেঙ্গে পলাশের লাশ উদ্ধার করা হয়। তার কথা মত বাম হাতে তাবিজ, কোমরে বাঁধা কালো গেঞ্জি আর পকেটে বাবার দেওয়া ২০টাকা সব ঠিকঠাক মতই পাওয়া গেছে। এ যেন পল্লী কবির কবর কবিতার সেই হৃদয় ভাঙ্গা বয়ান— সেই সোনামুখ গোলগাল হাত সকলি তেমন আছে/ কি জানি সাপের দংশন পেয়ে মা আমার চলে গেছে।

জানা গেছে, পলাশের মৃতদেহ মোটামুটি অক্ষত পাওয়া গেছে। ধারনা করা হচ্ছে আগুনের ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে মূলত তার মৃত্যু হয়েছে।

পলাশের বাবা রফিকুল ইসলাম বলেন, “পলাশ ছিল পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস। গ্রামের বাড়িতে যা ছিল সব বেঁচে দিয়ে ৬ বছর আগে ঢাকায় চলে যাই। একমাত্র মেয়েকে বাড়ি রেখে যাই। তখন পলাশ ছোট ছিল। মারা যাবার আট মাস আগে সে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে চাকরি নেয়। তার আয় দিয়েই চলছিল আমাদের সংসার। গ্রামের বাড়িতে কবর দেওয়ার মতো-ও জায়গা নেই। এখন আমাদের সংসার কিভাবে চলবে... দিকভ্রান্ত উদভ্রান্তের মত বকতে থাকেন রফিকুল। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে থাকি ধরা পড়ে যাওয়া অপরাধীর মত। আমাদের কাছে রফিকুল-গোলাপীকে সান্তনা দেওয়ার কোনো ভাষা বা অন্য কিছু নেই। গার্মেন্ট মালিকদের কেউ, সরকারের কেউ বা নেতা-নেত্রীদের কারও কাছে কি আছে!

বাংলাদেশ সময়: ২১২৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০১২
সম্পাদনা: আবু হাসান শাহীন, নিউজরুম এডিটর/একে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।