আসামের রাজধানী গৌহাটিতে রাত ৯টায় গিয়ে পৌঁছালাম। জার্নির ক্লান্তিতে তাই আর দেরি না করে খেয়ে-দেয়ে সটান নিদ্রাদেবীর কোলে আশ্রয় নিলাম।
বাস আঁকাবাঁকা চড়াইপথ ধরে উপরে ওঠার সময় গৌহাটি শহরকে দেখতে পেলাম।
কামাখ্যা গেট থেকে মন্দিরের কাছে যেতে সময় লাগলো প্রায় পাঁচ মিনিট। দেখলাম, মন্দির-সংলগ্ন এলাকাটি বহু মানুষের উপস্থিতিতে সরগরম হয়ে রয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে মন্দির চত্বরে প্রবেশ করলাম। অভিনব স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি কামাখ্যা মন্দিরগুচ্ছকে ঘিরে আছে সুন্দরভাবে বাঁধানো চাতাল।
মন্দিরগাত্রে শোভা পাচ্ছে দেবদেবী এবং নারী-পুরুষের মূর্তি। মন্দির পরিসরে বেশির ভাগ পান্ডা ব্যস্ত তাদের যজমানদের নিয়ে। বাকিরা ছোট ছোট দলে ছড়িয়ে থেকে দিব্যি আড্ডা দিচ্ছে। কামাখ্যার পান্ডাদের পরনে লাল বসন, গলায় একাধিক রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে বড় লাল টিপ।
একজন পান্ডাকে দেখে বেশ ভালোই লেগে গেল। বয়স সতেরো হবে। দেখতে ফর্সা-সিøম বডি। গায়ের রং আপেলের মতো টকটকে। ওর মুখ পানে বারবার তাকিয়ে আছি। এগিয়ে এসে একটু হেসে- মন্দির দেখবেন তো ১০১ টাকার লাইনে দাঁড়ান। তাহলে মন্দিরে প্রবেশ করতে বেশি সময় লাগবে না।
পান্ডা ছেলেটির পিছু পিছু গিয়ে ১০১ টাকার লাইনে দাঁড়ালাম।
এ নিয়ে কামরূপ কামাখ্যা ভ্রমণ আমার ৮ বার হলো। ‘তোমার নাম?’ - ‘প্রদীপ’। ওকে জিজ্ঞাসা, তুমি কী গান জানো? প্রদীপ : এক আধটু জানি। ফিল্মের প্লে¬ব্যাক সিঙ্গারদের মতো অতোটা ভালো গাইতে পারবো না ...।
প্রদীপ মন্দির সংলগ্ন সৌভাগ্যেকুন্ডে গিয়ে কুন্ডের জল আমার গায়ে ছিটিয়ে দিল। প্রদীপের হাত ধরে এবার মন্দির অভ্যন্তরে প্রবেশ করলাম। ভেতরে ঢোকামাত্র এক অদ্ভুত পরিবেশের মধ্যে গিয়ে পড়লাম। ধূপের গন্ধ, ফুলের সৌরভ, নিভে যাওয়া মোমবাতি এবং প্রদীপের কটু গন্ধ, ভক্তদের দেবী বন্দনা, পান্ডাদের মন্ত্রপাঠ, দলবিচ্ছিন্ন মানুষদের ডাকাডাকি, চেঁচামেচি- সব মিলিয়ে মনে হয় এ যেনো সম্পূর্ণ এক অন্য জগৎ।
প্রদীপ এ মন্দির সম্পর্কে জানালো, প্রাকৃতিক এক রহস্যময় গুহাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এই কামরূপ কামাখ্যা মন্দির। ওই যে দেখুন, সিংহাসনে আসীন অষ্টধাতুর কামাখ্যা দেবীর বিগ্রহ।
প্রদীপকে বললাম, এবার মন্দিরের বাইরে কোথাও গিয়ে বসি। মন্দিরের বাইরে এলাম। দু’জনে পায়ে হেঁটে পূর্ব দিকে এগিয়ে চললাম। প্রদীপ বললো, প্রকৃতি আর নৈসর্গিক শোভা বুঝি খুব পছন্দ আপনার। ‘হ্যাঁ’ বলতেই কৃষ্ণ বুকে জড়িয়ে- এ এক আনন্দময় পথচলা।
চলুন দূরে ব্রহ্মপুত্রের তীরে গিয়ে বসি। হেঁটেই চলছি, দেখি প্রতিটি বাঁকেই দৃশ্যপটের পরিবর্তন ঘটছে। পাহাড়ের ওপর থেকে ব্রহ্মপুত্রের প্রবহমান পথ, নদী-তীরবর্তী বিভিন্ন ঘাট এবং গৌহাটি শহরের অনেকটা অংশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দু‘জনে এক বটবৃক্ষের তলে এসে বসলাম।
প্রদীপ আমার হাতে হাত রেখে বললোÑ আমরা পান্ডা, সারাজীবন ভক্তদের মন্দির দর্শন করিয়ে যাবো। এই কাজ নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে। মন্দির দর্শনার্থী হিসেবে নয়, আপনাকে কেন জানি ভালো লেগে যাওয়ায় বহুদিন পরে এলাম এই ব্রহ্মপুত্রের তীরে।
তা আপনি কোথায় উঠেছেন? বললাম, গৌহাটি শহরে পর্যটনের মোটেলে, এটি রেল স্টেশনের কাছেই। তুমি যাবে? প্রদীপ বললো, খুউব ইচ্ছে হয়। প্রদীপ একটু হেসে বললো- মনে হয়, এ জীবনে এই প্রথম আপনাকেই বন্ধু হিসেবে পেলাম। আপনি যেখানে উঠেছেন ওখানে কী দু’ একদিন থাকা যায় না? বললাম, কেন নয়? প্রদীপ হাসলো- বিকেলের দিকে যাবো। এবার চলুন খেয়েদেয়ে নিই।
একটা আশ্রমে ঢুকতেই দেখি, কয়েকজন পান্ডা বসে গল্প করছে। এক সন্ন্যাসী বসে আছে ‘সাপ‘ নিয়ে। বিরাট এক কালনাগিনী দেখেতো ভয়ে আঁতকে উঠলাম। প্রদীপ আমাকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে বললো, সাপ দেখে ভয় পাচ্ছেন কেন। আমরাতো সাপ নিয়ে খেলাধূলা করি ...। এই বলে কৃষ্ণ সাপটা হাতে নিয়ে নিজ বুকে জড়িয়ে ধরলো। তখন তো শুধু তাকিয়ে থাকা।
আখড়ায় খাওয়া-দাওয়া করে নিলাম দু’জনে। প্রদীপ বললো, চলুন শ্মশানঘাটের পরে এক জঙ্গল রয়েছে- এ জায়গায় গেলে কামরূপ কামাখ্যা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবেন। আর ওখানেইতো জাদুটোনা হয়। আর এ জন্যইতো এই কামরূপ কামাখ্যাকে বলা হয় জাদুটোনার দেশ।
শ্মশানঘাটের পাশ থেকে আমরা দু’জনে হেঁটে চলছি। প্রদীপ বললো, সন্ধ্যা হওয়ার আগেই এ পথে কেউ আর আসতে চায় না। বললাম, কেন?
প্রদীপ : শ্মশানে বসে কারা যেনো ভয়ভীতি দেখায়। তাদের চেহারা বড়ই বিদঘুটে।
কেমন জানি ভয় ভয় লাগলো। ওকে বললাম, জাদুটোনা দেখবো না। চলো গৌহাটিতে ফিরে যাই।
প্রদীপ ও আমি এবার কামাখ্যা ছেড়ে চললাম গৌহাটির দিকে। প্রদীপ জানালো, প্রতিবছর আষাঢ় মাসের প্রথমদিকে অম্বুবাটি উৎসব হয় এই কামাখ্যায়। ওই উৎসবের সময় কয়েক লাখ ভক্তের আগমন ঘটে এই কামাখ্যায়। তখন এলে সব ধরনের আনন্দ করা যায়। আসবেন তো!
বললাম, কেন আসবো না। তুমি যে আমার বন্ধু।
কথাটা বলতেই প্রদীপ গান ধরলো : ‘তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে এসো গন্ধে বরণে, এসো গানে! এসো অঙ্গে পুলকময় পরশে, এসো চিত্তে অমৃতময় হরষে, এসো মুগ্ধ মুদিত দু’নয়নে ...।
সন্ধ্যার কিছু সময় পরে এসে পৌঁছলাম গৌহাটিতে। রিকশা নিয়ে প্রদীপ আর আমি এলাম মোটেলে।
ম্যানেজারকে বলে দ্বি-শয্যাবিশিষ্ট ঘর নিলাম। টেলিভিশনটা অন করে দিতেই দেখি প্রদীপ অবাক। দু’নয়ন ভরে দেখছে। প্রদীপ বললো, বাহ আপনিতো বেশ মজার মানুষ। বাংলাদেশে নিয়ে যাবেনতো আমাকে?
বললাম, কেন নয়? প্রদীপ হাসলো। দুইদিন হোটেলে থাকলো, বেড়ালো আমার সঙ্গেই। চলে যাওয়ার কথা বলতেই প্রদীপ বললো, আপনাকে বঙ্গাইগাঁও পর্যন্ত পৌঁছে দেবো। বঙ্গাইগাঁওতে আমার পিসির বাড়ি, ওখানে কয়েকদিনের জন্য যাবো।
পরদিন সকাল ১১টায় ট্রেন ছাড়লো গৌহাটি রেল স্টেশন থেকে। কামাখ্যা স্টেশনে থামিয়ে আবার চলতে শুরু করলো। চলমান ট্রেন থেকেই যেসব পাখি চোখে পড়ল তার মধ্যে উল্লে¬খযোগ্য হলো- মাছরাঙা, কোচবক, পানকৌড়ি, শামুকখোল, চিল, শঙ্খচিল।
প্রদীপ বললো, ওই যে দেখুন ‘দীপর বিল’। এই বিলে রয়েছে রকমারি গাছপালা, জলজ উদ্ভিদ। বাইরের শোভা দেখতে দেখতে একে একে পেরিয়ে গেলাম আজারা, মিরজা, ধুপধাড়া স্টেশন। ‘পঞ্চরতœ’ নামে একটি স্টেশন দেখলাম।
এখানে চোখে পড়ল চা বাগান- আর দেখলাম শাল গাছের ছড়াছড়ি।
ব্রহ্মপুত্র নদ পার হতেই প্রদীপ বললো, দেখুন- দেখুন ব্রহ্মপুত্রকে। ওই যে নদীর ওপরে ভেসে বেড়াচ্ছে কত না জেলে নৌকো। ব্রহ্মপুত্র ছাড়িয়ে ট্রেন এগিয়ে চলছে। বারবার চোখে পড়ছিল অসংখ্য গোলাপি রঙের শাপলা ফুল কচুরিপানার আবরণ ভেদ করে মাথা তুলে রয়েছে। আরও দেখলাম সবুজ কৃষি জমি, পুকুর, সবজি বাগান, সুপারি গাছে ঘেরা টিনের ছাদ বিশিষ্ট গৃহস্থ বাড়ি ...।
একসময় ট্রেন এসে বঙ্গাইগাঁওয়ে কাছে আসতেই প্রদীপ জড়িয়ে ধরে বললো- ‘আষাঢ় মাসের প্রথমদিকে অম্বুবাচী উৎসবের সময় আসবেন কিন্তু। ’ কথাগুলো শুনে প্রদীপের পানে তাকিয়ে রইলাম। মনে মনে ভাবলাম, আমি কে, ও কেÑ এ কথা কেন ভাবছে না প্রদীপ ।
দেখি প্রদীপ চলে যাচ্ছে....। ততোখণে বঙ্গাইগাঁও রেল স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে চলে গেছে। আজও প্রশ্নÑ কামাখ্যার প্রদীপের সঙ্গে আর কী কোনদিন দেখা হবে?
(লেখক লিয়াকত হোসেন খোকন একজন ভ্রমণ পিপাসু। কর্মজীবনে তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন)
বাংলাদেশ সময় : ০৮০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১২
সম্পাদনা : সুকুমার সরকার, কো-অর্ডিনেশন এডিটর