ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২০ মে ২০২৫, ২২ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

এক একজন মুক্তিযোদ্ধা এক একটি ইতিহাস

সালেক খোকন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:২৫, ডিসেম্বর ১, ২০১২
এক একজন মুক্তিযোদ্ধা এক একটি ইতিহাস

সাক্ষাৎকার দেওয়া সম্ভব নয়। মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান বেশ অসুস্থ।

প্রচণ্ড জ্বর আর প্রেসারজনিত কারণে কথাও বলতে পারছিলেন না। বয়স তাঁর ৬৫ বছর। কিন্তু এই বয়সের তুলনায়ও দুর্বল হয়ে পড়েছেন বেশ। আমাদের মনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়।

এদেশে এক একজন মুক্তিযোদ্ধা এক একটি ইতিহাস। স্বাধীন দেশে তাঁরা দীর্ঘায়ু লাভ করুন-- এমনটাই কামনা করি মনে মনে। কয়েকটা দিন কেটে যায়। সেলফোনে কথা বলে একদিন অুনমতি মেলে সাক্ষাতের। গর্বিত হই এক বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর সুযোগ পেয়ে।

মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহানের পুরো নাম শাহজাহান লস্কর। তাঁর বাবার নাম আব্দুস সোবহান লস্কর ও মা বটফুল বেগম। শাহজাহান বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার দক্ষিণ কামদেবপুর গ্রামে। মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহানের  শৈশব ও কৈশোর কেটেছে গ্রামের বাড়িতেই।

ছোটবেলায় পছন্দের খেলা ছিল ফুটবল ও হাডু-ডু। এ গ্রাম ওগ্রাম ছুটে বেড়াতেন বন্ধুদের সঙ্গে।   কথায় কথায় বললেন বাল্যবন্ধু আ. রশিদ হাওলাদার ও খলিল জমাদারের কথা। দলবেঁধে খেলা আর মাছ ধরাতেই ছিল তাদের আনন্দ।

শাহজাহানের পড়াশোনা শুরু কামদেবপুর প্রাইমারী স্কুলে। সেখানে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করে ভর্তি হন নাছোবমহাল উচ্চ বিদ্যালয়ে। তিনি লেখাপড়া করেছেন নবম শ্রেণি পর্যন্ত। তবে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্বেই পড়াশোনায় ইস্তফা দেন। এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়েন বাবার সঙ্গে কৃষি কাজে।

রক্ত গরম করা ভাষণ ছিল সেটি
দেশ তখন উত্তাল। নানা বৈষম্য চলছিল। পশ্চিম পাকিস্তানিরা নানাভাবে শোষণ করছিল আমাদের ওপর। এসব খবর পৌঁছে যেত গ্রামে গ্রামে। বড়দের মুখে ও রেডিওর মাধ্যমে নানা খবর জেনে যেত শাহজাহানরা। সে খবরগুলো উদ্দিপ্ত করতো তাকে। এরমদ্যে ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। শাহজাহান লস্কর সে ভাষণ শোনেন রেডিওতে। তার ভাষায়, “রক্ত গরম করা ভাষণ ছিল সেটি। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ ছিল সময়োপযোগী। ”
শাহজাহানদের পরিবার ছিল স্বচ্ছল। জমিজমারও কমতি ছিল না। কিন্তু দেশ যদি পরাধীন থাকে তবে সে জমি বা সম্পদের মূল্য কী থাকে? তাই সবার আগে দেশকে মুক্ত করতে হবে। বাঁচাতে হবে মাতৃভূমিটাকে। এমন চিন্তা থেকেই একরাতে গোপনে বেড়িয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য।  

36-bg2কমান্ডার  ছিলেন মেজর জিয়াউদ্দিন

তার ভাষায়, “তারিখটা ছিল ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ। নিকট আত্মীয় মান্নান মোল্লাসহ আমরা গ্রাম থেকে গোপনে চলে যাই যুদ্ধে যোগ দিতে। খুলনা দৌলতপুর হয়ে আমরা পৌঁছি দিঘলিয়া ইউনিয়নের দিঘলিয়া গ্রামে। বিভিন্ন জায়গা থেকে সেখানে এসে একত্রিত হয়েছেন আরো অনেক যুবক। মেজর জিয়াউদ্দিন ছিলেন সেখানে। আমরা তার গ্রুপে যোগ দিই। সাতদিনের স্বল্প মেয়াদী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় আমাদের। শেখানো হয় গেনেড নিক্ষেপ ও  হালকা রাইফেল চালানো। অতঃপর শুরু করি অপারেশন। ”

দিঘলিয়া ছাড়াও দৌলতপুরের বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করেন মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান লস্কর। এ অঞ্চলটি ছিল ৯ নম্বর সেক্টরের অধীন। তিনি বলেন, “আমাদের কমান্ডার  ছিলেন মেজর জিয়াউদ্দিন আর ইউনিট কমান্ডার আব্দুল মান্নান। ”

মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, খাবার ও পানি দিয়ে সাহায্য করতো গ্রামের সাধারণ মানুষ। আর এ কারণে উন্নত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর কৌশলে গেরিলা আক্রমণ করাটা অপেক্ষাকৃত সহজ হতো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। এসব অপারেশনগুলোতে সহজেই জয় পেত মুক্তিযোদ্ধারা।

তার ভাষায়, “তবে বাঙালিদের কেউ কেউ ছিল পাকিস্তানিদের পক্ষে। তারা আমাদের আপ্যায়নে ব্যস্ত রেখেই খবর দিত হানাদার পাকিস্তানি আর্মিদের। তাই আমরাও খোঁজ খবরের জন্য সাধারণ মানুষের সাহায্য নিতাম। ”

গৌরবমাখা সেই রাত

এমনিভাবে একের পর এক যুদ্ধ করে যান। যুদ্ধের সময় মারাত্মক জখম হন মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান লস্কর। ভয়াবহ সে রাতের কথা উঠতেই তিনি নীরব হয়ে যান। তার জবানিতে শুনি সে গৌরবমাখা কষ্টকর রাতের কথা। তিনি বলেন, “দিঘলিয়া গ্রামে ছিল পাকি সেনাদের একটি ছোট ক্যাম্প। ঠিক হল, সেই ক্যাম্পটি উড়িয়ে দিতে হবে। পরিকল্পনামত ২৯ মে সন্ধ্যার ঠিক পরপরই বের হই ক্যাম্প থেকে। পনের জনের একটি দল ছিল আমাদের। মাটিতে ক্রলিং করে করে পাকি ক্যাম্পের দিকে এগোই গেরিলা যোদ্ধারা।

রাত তখন আটটা। পূর্বেই বলা ছিল, দলের লিডার প্রথম গুলি ছুড়বেন। তাই হলো। সঙ্গে সঙ্গে আমরাও সম্মিলিতভাবে শুরু করলাম। প্রত্যুত্তরে পাকিরা মর্টার শেল ছুড়লো আমাদের অবস্থান লক্ষ্য করে। আশপামে পড়া মর্টার শেলের স্প্লিন্টারগুলো প্রচণ্ডবেগে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।

আমি ছিলাম স্লিপিং পজিশনে। চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দু’একজন সহযোদ্ধা মাটিতে লুটিয়ে পরলেন। স্প্লিন্টারের আঘাতে রক্তাক্ত হল তাদের দেহ। আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মনের মধ্যে মৃত্যুভয় উঁকি দেয়। এরই একপর্যায়ে কখন যে স্প্লিন্টার আমার শরীরেও বিদ্ধ হয়েছে টেরই পাইনি। হঠাৎ মনে হলো ডান হাত ও বুকের বাম পাশটা রক্তে ভিজে যাচ্ছে। টের পেলাম শরীরটা ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়ছে। আমাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে পাশ থেকে সহযোদ্ধা হামিদ চিৎকার দিয়ে ওঠে। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আমার দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়ে আসে। এরপর আর কিছুই মনে নেই। ”

01-bg20কোনো আফসোস নেই

পাকিস্তানিদের মর্টার শেলের স্প্লিন্টারের আঘাতে ডান হাতে কব্জির একাংশ ও তর্জনী উড়ে যায় তার। স্পিন্টার লাগে বুকের পাশে বাম হাতের জয়েন্টেও। প্রথমে ক্যাম্পে প্রাথমিক চিকিৎসা ও পরে খুলনা মেডিকেলে চিকিৎসা চলে গুরুতর আহত মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহানের। শেষপর্যন্ত প্রাণে বেঁচে গেলেও কর্মক্ষমতা হারায় তার একটি হাত।  

শাহজাহান চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে থাকেন প্রায় ছয় মাস। অতঃপর নভেম্বরের প্রথম দিকে তিনি ফিরে যান নিজ গ্রাম কামদেবপুরে। ওইসময় গ্রামটি হানাদার মুক্ত ছিল। শাহজাহানের ভাষায়, “মা ভেবেছিল আমি মরে গেছি। আমাকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে কাঁদছিলেন। আশপাশের গ্রাম থেকে অনেকেই এসেছিল আমাকে দেখতে। ”

দেশের জন্য রক্তাক্ত হয়ে কোন আফসোস হয় কিনা? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “কোনো আফসোস নেই। জখমের কারণে ডান হাত দিয়ে কোনো কাজ করতে পারি না। তবুও গ্রামের মানুষের সম্মান আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ”

দেশ স্বাধীনের পর শাহজাহান চাকুরি নেন জিপিওতে। অবসরে যান ২০০৭ সালে। যুদ্ধাহত ও অবসর ভাতা থেকে যা পান তাই দিয়ে চলে পরিবার। বর্তমানে তিনি কামদেবপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার।

মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে সম্মান অনুভব করি

চার মেয়ের জনক এই মুক্তিযোদ্ধা। ছোট মেয়ে পড়ছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে নিয়ে তিনি গর্বিত। বললেন, “মাঝে মধ্যে ক্লাসে কোনো শিক্ষক কিংবা সহপাঠীরা যখন জানতে চায় আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবার কথা। তার আহত হওয়ার ঘটনাটি। তখন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আমি অন্যরকম সম্মান অনুভব করি। ”

চৌদ্দ নম্বর মুক্তিযোদ্ধা
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা এখনও হচ্ছে। বাড়ছে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যাও। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা বির্তক। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম এসেছে অনেক অ-মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতা বিরোধীদের। এ প্রসঙ্গে  মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান লস্কর বলেন, “এগুলো ঠিক হচ্ছে না। মুক্তিযোদ্ধারাও চৌদ্দ নম্বর হয়ে যাচ্ছে। ওই যে টাকা-টুকা খায় আর তালিকা ভাঙ্গাচুড়া করে। ”

একটু থেমে মুচকি হেসে ফের বলেন, “এখন সুবিধা লাভের জন্যই চলছে সব। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য ছাড়া কি মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায়?”

চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের বিচার চলছে আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার, আলবদর, আল শাম্‌সদের বিচার প্রসঙ্গে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা অকপটে বলেন, “এদের বিচার আরো আগেই করা উচিত ছিল। যারা অন্যায় করেছে তাদের বিচার না হলে এ জাতি কলঙ্কমুক্ত হবে না। ” একইসঙ্গে তিনি বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা প্রসঙ্গেও নিজের অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, “তাদেরও ক্ষমা করা উচিত হয়নি। ছোট অপরাধীরা ক্ষমা পেয়েছিল বলেই বড় রাজাকাররা ভেবেছে তাদেরও ক্ষমা করা হবে। আর সে সুযোগে একচল্লিশ বছরে এরা ফুলে ফেঁপে কলাগাছ হয়েছে। ”

একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বাধীনদেশের কী ভালোলাগে? জানতে চাইলে বলেন, “দেশ যদি ভালোভাবে চলে তবেই তো ভালো লাগে। ”

ধনীরা নিজেদের ভগবান ভাবছেন
কোন সময় খারাপ লাগে? এমন প্রশ্নে তিনি নিশ্চুপ থাকেন। অতঃপর দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলেন, “দেশের অধিকাংশ স্থানেই দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। সবাই নিজের উন্নতিতে ব্যস্ত। দেশের উন্নতির চিন্তা কেউ করছে বলে মনে হয় না। স্বাধীন দেশে গরীব আরো গরীব হচ্ছে। ধনীরা নিজেদের ভাবছেন ভগবান। এমন দেশটা তো চাইনি আমরা। ”

শত হতাশার মধ্যেও পরবর্তী প্রজম্মকে নিয়ে স্বপ্নে বিভোর হন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার আশা, এদেশ একদিন অনেক এগিয়ে যাবে। তার ভাষায়, “আমরা রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি। আর পরবর্তী প্রজম্ম দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এদেশে থাকবে না কোনো হানাহানি, কাটাকাটি। ”

সালেক খোকন: লেখক ও গবেষক                                                            
contact@salekkhokon.me

বাংলাদেশ সময়: ১৫০৮ ঘণ্টা, ০১ ডিসেম্বর, ২০১২
একে eic@banglanews24.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।