ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৯ জুলাই ২০২৫, ০৩ সফর ১৪৪৭

ফিচার

ইরান কি আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র যুগে প্রবেশ করছে?

আশরাফুর রহমান, তেহরান থেকে  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:৪৫, জুলাই ২৮, ২০২৫
ইরান কি আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র যুগে প্রবেশ করছে?

সম্প্রতি ইরানের কয়েকটি সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (বিশেষ করে ফেসবুক ও এক্স-এ) ‘খোররামশাহর-৫’ নামের একটি সম্ভাব্য নতুন আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম) ঘিরে ব্যাপক আলোচনা চলছে। বিভিন্ন পোস্ট ও প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ১২ হাজার কিলোমিটার, গতি শব্দের ১৬ গুণ (ম্যাক ১৬)।

এটি দুই টন ওজনের ওয়ারহেড বহনে সক্ষম।

যদি সক্ষমতার তথ্য সত্য হয়, তবে খোররামশাহর-৫ যুক্তরাষ্ট্রসহ উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চলে আঘাত হানতে সক্ষম হবে। এতে ইরান বিশ্বের হাতে গোনা আইসিবিএম থাকা দেশগুলোর (যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, উত্তর কোরিয়া ও ভারত) কাতারে উঠে আসতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ক্ষেপণাস্ত্রের দুই টন পেলোড বহনক্ষমতা- মার্কিন স্টিলথ বোমারু বিমান বি-টু স্পিরিটের বোমা বহনক্ষমতার সমতুল্য। তবে বি-টু বিমানকে শত্রুর আকাশ প্রতিরক্ষা অতিক্রম করে মিশন সম্পন্ন করতে হয়, আর খোররামশাহর-৫ একক শটে সেই ধ্বংসক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারে।

সরকারি ঘোষণা নেই

ইরানের বড় সামরিক অর্জনগুলো সাধারণত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বা আইআরজিসি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে থাকে। কিন্তু ‘খোররামশাহর-৫’-এর বিষয়টি এসেছে বেসরকারি উৎস থেকে। কিছু সংবাদমাধ্যম ২০২৩ সালের পুরোনো ‘খোররামশাহর-৪’ পরীক্ষার ফুটেজ ব্যবহার করে দাবি করেছে যে, নতুন মডেলটির পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। তবে, প্রযুক্তিগতভাবে এই ক্ষেপণাস্ত্র ইতোমধ্যেই প্রস্তুত—এই ধারণা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে ইরানের প্রতিরক্ষা শিল্প যে গতিতে এগিয়েছে, তাতে এটি বাস্তবসম্মত বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।

ইরানের স্বঘোষিত সীমা কি পরিবর্তিত হচ্ছে?

২০১৫ সালে ইরানের শীর্ষ সামরিক ও রাজনৈতিক নেতারা বারবার বলেছেন, দেশটির ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি প্রতিরক্ষামূলক এবং স্বেচ্ছায় দুই হাজার কিলোমিটারের সীমা মেনে চলছে। আইআরজিসির কমান্ডাররাও দাবি করে আসছিলেন, এতেই ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন ঘাঁটিগুলোকে প্রতিহত করা সম্ভব। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী তৎপরতার প্রেক্ষাপটে সেই প্রতিরক্ষা নীতিতে পুনর্বিবেচনা হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আইসিবিএম কী, কেন এবং কতটা ভয়াবহ?

আইসিবিএম হলো এমন এক ধরনের দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, যার ন্যূনতম সীমা সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার। ওয়ারহেডের ওজন কমিয়ে কিছু আইসিবিএম-এর সর্বোচ্চ পাল্লা ১৬ থেকে ১৮ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ানো যায়, যা পৃথিবীর প্রায় সব স্থানকে আওতায় নিয়ে আসে। এ শ্রেণির ক্ষেপণাস্ত্র মূলত পরমাণু বা অন্যান্য ধ্বংসাত্মক ওয়ারহেড বহনে ব্যবহৃত হয়।

বহুস্তরবিশিষ্ট এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সাধারণত ২০–৩০ মিটার লম্বা ও দুই-তিন মিটার প্রশস্ত হয়। কিছু উন্নত মিনি-আইসিবিএম তুলনামূলকভাবে ছোট আকৃতির হলেও একই রকম কার্যক্ষমতা রাখে। এগুলো সাইলো, মোবাইল লঞ্চার বা সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপণ করা যায়। বায়ুমণ্ডলের বাইরে গমন করে প্যারাবলিক গতিপথে ছুটে যায় এবং ম্যাক ২০+ (২৪,০০০ কিমি/ঘণ্টা) গতিতে বহু ওয়ারহেড বা ডিকয় বহন করে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে পারে।

ওয়ারহেডগুলো ১৫ হাজার–২৪ হাজার কিলোমিটার/ঘণ্টা গতিতে নেমে আসে, তাপরোধী আবরণে সুরক্ষিত থাকে। ইনিশিয়াল নেভিগেশন ও জিপিএস-এর মতো নির্ভুল গাইডেন্স সিস্টেম লক্ষ্যে সঠিক আঘাত হানে। পূর্ণ পাল্লার ফ্লাইট সময় সাধারণত ৩০–৪০ মিনিট।

বিশ্বের পরমাণু শক্তিধর দেশগুলো তাদের পরমাণু ত্রয়ীর (নিউক্লিয়ার ট্রায়াড) অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে আইসিবিএম ব্যবহার করে আসছে। যদিও কিছু আইসিবিএমে পারমাণবিক অস্ত্রের পরিবর্তে সাধারণ ওয়ারহেড বা হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল (এইচজিভি) যুক্ত করা হয়।

খোররামশাহর-৫: সম্ভাব্য গঠন ও ক্ষমতা

গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে আগেই বলা হয়েছে যে, খোররামশাহর-৫-এর সর্বোচ্চ পাল্লা ১২ হাজার কিলোমিটার। এটি পূর্ববর্তী খোররামশাহর-৪ (চার হাজার কিলোমিটার) এর তুলনায় অনেক বড় অগ্রগতি। এ ছাড়া, ইরানের স্যাটেলাইট বাহক রকেট ‘সিমোর্গ’ ও ‘সোরোশ-১/২’ কে আইসিবিএম-এ রূপান্তর করা হলে এই পাল্লা অর্জন সম্ভব। তবে এসব সিভিলিয়ান রকেট আকারে বড় ও ধীরগতির হওয়ায় যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ব্যবহার অনুপযুক্ত হতে পারে।

ইরান এরইমধ্যে ‘ফাত্তাহ’ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে এমন প্রযুক্তির সক্ষমতা দেখিয়েছে, যার গতি ছিল ম্যাক-১৫ এবং যার কাঠামো বিশেষ তাপ প্রতিরোধী উপাদান দিয়ে তৈরি এবং জটিল গাইডেন্স সিস্টেমসম্পন্ন।
যদিও খোররামশাহর-৫ তরল জ্বালানিচালিত বলে ধারণা করা হচ্ছে, এটি যদি ফাত্তাহ হাইপারসনিক মিসাইলের প্রযুক্তি ব্যবহার করে, তাহলে এর গতি ও নিখুঁত লক্ষ্যে আঘাতের ক্ষমতা অনেক বেশি হবে।

মিডিয়া দাবি করছে, এই ক্ষেপণাস্ত্র ২ টন পেলোড বহনে সক্ষম—যা আমেরিকার জিবিইউ-৫৭ বাংকার বাস্টারের সমতুল্য। তবে পেলোড ও পাল্লা সাধারণত বিপরীতভাবে কাজ করে—যত বেশি পেলোড, তত কম রেঞ্জ।

প্রযুক্তি না বার্তা?

ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আজিজ নাসিরজাদে গত জুন মাসে জানান, তারা ২ টন ওয়ারহেড হাইপারসনিক গতিতে সফলভাবে পরীক্ষা করেছে। তবে সেটিকে আইসিবিএম হিসেবে উল্লেখ করেননি—বরং মিড রেঞ্জ বা ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ মিসাইল হিসেবে উল্লেখ করেন।

‘খোররামশাহর-৫’-কে ঘিরে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো একদিকে যেমন ইরানের প্রযুক্তিগত সক্ষমতার নতুন অধ্যায় শুরু করার ইঙ্গিত দিচ্ছে, তেমনি এ-ও স্পষ্ট করছে যে ইরান এখন এক বৈশ্বিক বার্তা দিতে চায়।

এই বার্তা শুধু সামরিক নয়, বরং কৌশলগত অবস্থান পুনঃনির্ধারণেরও প্রতিফলন—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে প্রতিরোধের সক্ষমতা বিশ্বকে জানিয়ে দেওয়ার কৌশল। এই ক্ষেপণাস্ত্র যদি সত্যিই একটি আইসিবিএম হয়ে থাকে, তাহলে তা শুধু ইরানের প্রতিরক্ষা নয়, বরং আঞ্চলিক ভূরাজনীতি ও বৈশ্বিক কৌশলগত ভারসাম্যে একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে।

আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।