প্যারিসের লেফট ব্যাংকের রাস্তায় টানা ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে হাঁটছেন আলি আকবর—বগলে সংবাদপত্র, ঠোঁটে সদ্য বেরোনো শিরোনাম। তিনি শুধু ফ্রান্সেরই নয়, সম্ভবত গোটা ইউরোপের শেষ সংবাদপত্র ফেরিওয়ালা!
ফরাসি সংস্কৃতিতে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে দেওয়া হচ্ছে দেশের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ সম্মাননা ‘অর্ডার অব মেরিট’।
আলি আকবর বলেন, আমি যখন ১৯৭৩ সালে শুরু করি, তখন প্যারিসে অন্তত ৩৫-৪০ জন ফেরিওয়ালা ছিল। এখন আমি একাই আছি। সবকিছু ডিজিটাল হয়ে গেছে। মানুষ এখন খবর পড়তে ফোনই দেখতে চায়।
এখন ফ্যাশনেবল সেইন্ট জার্মেই এলাকার ক্যাফেগুলো ঘুরে আলি আকবর গড়ে ৩০ কপি লা মোঁদ পত্রিকা বিক্রি করেন। বিক্রির অর্ধেক দাম তাঁর হাতে আসে, কিন্তু অবিক্রিত কপির জন্য কোনো দাম ফেরত মেলে না।
ইন্টারনেট যুগের আগে বিকেলের সংস্করণ প্রকাশের পর প্রথম ঘণ্টাতেই তিনি ৮০ কপি বিক্রি করে ফেলতেন।
“আগে মানুষ ভিড় করত খবরের কাগজ নিতে। এখন উল্টো আমাকে ক্রেতাদের পেছনে ছুটতে হয়,” বলেন প্যারিসের একমাত্র সংবাদপত্র বিক্রেতা।
তবে ব্যবসার মন্দা তাঁকে কষ্ট দেয় না। তিনি বলেন, “আমি আনন্দের জন্যই করছি। আমি খুশি মানুষ, আর আমি স্বাধীন। এই কাজে আমাকে কেউ নির্দেশ দেয় না—এটাই আমার ভালো লাগার কারণ। ”
৭২ বছরের প্রাণবন্ত আলি আকবর পাড়ার সবার কাছে চেনা মুখ। এক স্থানীয় বলেন, “আমি ৬০-এর দশকে এখানে এসেছি, আলির সঙ্গে বড় হয়েছি। সে আমার ভাইয়ের মতো। ”
“সে সবাইকে চেনে, আর খুবই আনন্দমুখর মানুষ,” বলেন আরেক প্রতিবেশী।
পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে জন্ম নেওয়া আলি আকবর ৬০-এর দশকের শেষ দিকে ইউরোপে আসেন। প্রথমে যান আমস্টারডামে, যেখানে ক্রুজ জাহাজে কাজ পান।
আলি আকবর পাড়ায় সবার কাছে পরিচিত এবং সবার প্রিয়
১৯৭২ সালে জাহাজ ফ্রান্সের রুয়াঁ বন্দরে ভিড়লে তিনি নামেন, আর পরের বছর চলে আসেন প্যারিসে। ৮০-এর দশকে পান স্থায়ী নাগরিকত্ব।
“আমি তখন হিপি ছিলাম না, তবে অনেক হিপির সঙ্গে পরিচয় ছিল,” হাসি মুখে আলি আকবর বলেন।
তিনি বলেন, “আফগানিস্তানে থাকার সময় একদল আমাকে গাঁজা খাওয়াতে চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম, দুঃখিত, আমার জীবনের মিশন এটা নয়—কাবুলে একমাস ঘুমিয়ে থাকা আমার পরিকল্পনায় নেই!”
সাবেক বুদ্ধিজীবী কেন্দ্র সেইন্ট জার্মেই তিনি অনেক লেখক, শিল্পী, তারকার সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। এলটন জন একবার ব্রাসেরি লিপ-এ তাঁকে দুধ-চা খাওয়ান। মর্যাদাপূর্ণ সায়েন্স-পো বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পত্রিকা বিক্রি করতে গিয়ে পরিচয় হয়েছে বহু প্রজন্মের ভবিষ্যৎ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে—যার মধ্যে আছেন ফ্রান্সের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ।
সেই সময় আর এখনকার মধ্যে পার্থক্য কী? “আগের সেই আবহ আর নেই,” তিনি বলেন। “তখন প্রকাশক, লেখক, অভিনেতা, সঙ্গীতশিল্পী—সবাই এখানে ভিড় করত। জায়গাটির প্রাণ ছিল। এখন শুধু পর্যটকদের শহর। ”
প্রাণ হারিয়ে গেছে, তিনি বলেন—তবে কথা শেষ করেন এক চিলতে হাসি দিয়ে।
সূত্র: বিবিসি
এমজেএফ