ঢাকা, বুধবার, ৯ আশ্বিন ১৪৩২, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১ রবিউস সানি ১৪৪৭

ফিচার

খোররামশাহর ক্ষেপণাস্ত্র: ইরানের কৌশলগত অস্ত্রভান্ডার রূপান্তরের ৮ বছর

আশরাফুর রহমান, তেহরান থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:২৩, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৫
খোররামশাহর ক্ষেপণাস্ত্র: ইরানের কৌশলগত অস্ত্রভান্ডার রূপান্তরের ৮ বছর খোররামশাহর ক্ষেপণাস্ত্র সিরিজ ইরানের প্রতিরক্ষা সক্ষমতার এক অনন্য প্রতীক

২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭—এই দিনটি ইরানের প্রতিরক্ষা ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে আছে। সেদিন প্রকাশ্যে সফলভাবে পরীক্ষা চালানো হয়েছিল ‘খোররামশাহর’ নামের একটি মধ্যপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের।

আজ আট বছর পরে ফিরে তাকালে দেখা যায়, এটি কেবল একটি অস্ত্রের পরীক্ষা ছিল না; বরং ছিল ইরানের প্রতিরক্ষা ও অ্যারোস্পেস শিল্পে এক ধারাবাহিক এবং কৌশলগত অগ্রগতির সূচনা।

সেই সময়ের প্রচারিত ভিডিওচিত্রে ধরা পড়ে ক্ষেপণাস্ত্রটির শক্তিশালী উড্ডয়ন ও নোজ-কোন ক্যামেরা থেকে ধারণ করা আকাশযাত্রার দৃশ্য—ইরানের দেশজ প্রযুক্তির আত্মবিশ্বাসকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেওয়া একটি মুহূর্ত। এ ক্ষেপণাস্ত্রকে নাম দেওয়া হয় দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানের খোররামশাহর শহরের নামানুসারে—যা ১৯৮০-এর দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় প্রতিরোধ ও আত্মত্যাগের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। ফলে ক্ষেপণাস্ত্রটি প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পাশাপাশি একটি প্রতীকী অর্থও বহন করে।

উন্মোচন ও প্রথম প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য

২০১৭-এ উন্মোচিত প্রথম খোররামশাহর ক্ষেপণাস্ত্রের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ১৩ মিটার, ব্যাস প্রায় ১.৫ মিটার এবং ওজন আনুমানিক ২০ মেট্রিক টন। এটি একধাপের তরল জ্বালানিচালিত ডিজাইন। নকশাগতভাবে এটিতে বড় ধরনের বেস-ফিন রাখা হয়নি; বরং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ব্যবহার করা হয়েছে থ্রাস্ট ভেক্টর কন্ট্রোল—যা ওজন কমায়, রাডার সিগনেচার ছোট করে এবং মোবাইল লঞ্চার (TEL)-এ পরিবহন সহজ করে তোলে। প্রথম পরীক্ষায় প্রপালশন, গাইডেন্স ও পুনঃপ্রবেশ যান বিচ্ছেদে সাফল্য প্রমাণিত হয়েছিল।

পে-লোড, গতি ও কর্মক্ষমতা

প্রাথমিক মডেলে পে-লোড সক্ষমতা ছিল প্রায় ১,৮০০ কেজি; এতে একক উচ্চবিস্ফোরক, ক্লাস্টার মিউনিশন বা একাধিক পুনঃপ্রবেশ যান (MRV) বহনক্ষমতার কথা উল্লেখ থাকে। পরীক্ষামূলক ফ্লাইট প্রোফাইল অনুযায়ী ক্ষেপণাস্ত্রটি মহাকাশের বাইরে উচ্চগতিতে পৌঁছে (রিপোর্ট অনুযায়ী ম্যাক-১৫ অতিক্রম) এবং সর্বোচ্চ প্রাসঙ্গিক আপোগি (Apogee) আনুমানিক ১২৬ কিলোমিটার।

ধারাবাহিক উন্নয়ন: ‘খোররামশাহর-২’

২০১৯ সালে প্রকাশিত হয় খোররামশাহর-২। এর মূল বৈশিষ্ট্য ছিল হালকা ওয়ারহেড ও বাড়তি পাল্লা। পাল্লা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩,০০০ কিলোমিটার। গাইডেন্স প্রযুক্তিতেও উন্নতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যা নিখুঁত আঘাত হানার ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে।

‘খোররামশাহর-৪’ দ্রুততা ও টিকে থাকার ক্ষমতা

২০২৩-এ উন্মোচিত খোররামশাহর-৪ (যাকে ‘খাইবার’ নামেও ডাকা হয়) ছিল এ পরিবারের সবচেয়ে পরিশীলিত সংস্করণ। ইরানের মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভারী ওয়ারহেডগুলোর মধ্যে একটি এটি। যদিও এর ঘোষিত কার্যকর পাল্লা প্রাথমিক মডেলের মতই অনানুষ্ঠানিকভাবে ২,০০০ কিমির আশপাশে বলা হয়, তবু নির্মাণগত পরিমার্জন এবং ওয়ারহেডকে ১,৫০০ কেজিতে নামিয়ে আনার মাধ্যমে সামগ্রিক কার্যক্ষমতা এবং ট্যাকটিক্যাল ব্যবহারিকতা বাড়ানো হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ছিল লঞ্চ-প্রস্তুতির সময়চক্র নাটকীয়ভাবে কমে আসা। সবচেয়ে বড় অগ্রগতি হলো উৎক্ষেপণ প্রস্তুতির সময় মাত্র ১৫ মিনিটে নামিয়ে আনা, কারণ এতে তরল জ্বালানি ব্যবহার করা হয়েছে। পাশাপাশি বায়ুমণ্ডলের বাইরে ওয়ারহেডের গতিপথ সামঞ্জস্য করার সক্ষমতাও রয়েছে এই ক্ষেপণাস্ত্রটির। ইরানে নির্মিত এর আগের ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর তুলনায় অনেকটাই নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম এটি।

প্রযুক্তিগতভাবে খাইবারের সর্বোচ্চ গতি বায়ুমণ্ডলের বাইরে আনুমানিক ম্যাক ১৬, যা শব্দের গতির ১৬ গুণ এবং এর ভেতরে আনুমানিক ম্যাক ৮। প্রযুক্তিগতভাবে এই ক্ষেপণাস্ত্র এতটাই শক্তিশালী যে প্রচলিত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে এই ক্ষেপণাস্ত্র আটকানো বেশ কঠিন।

৮০টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম ‘খোররামশাহর-৪’

আইআরজিসি অ্যারোস্পেস ফোর্সের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আলী হাজিজাদেহ (১৩ জুন ইসরায়েলি হামলায় শহীদ) ২০২৩ সালের ৩০ মে ‘খোররামশাহর-৪’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সম্পর্কে বলেছিলেন, “মাত্র একটি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করা হয়, কিন্তু যখন এটি লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছায়, তখন এটি একইসঙ্গে ৮০টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। ”

গত ২২ জুন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরান ‘খোররামশাহর-৪’ বা ‘খাইবার’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে বলে আইআরজিসি’র পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

প্রযুক্তিগত উত্তরাধিকার ও পরিণতি

গত আট বছরে দেখা গেছে, ওজন হ্রাস করে পাল্লা বৃদ্ধি, গাইডেন্সে পারদর্শিতা, দ্রুত লঞ্চ-প্রস্তুতি এবং বহুমুখী ওয়ারহেড বিকাশ—এইসব দিক নিয়োজিত থেকে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ধাপে ধাপে পরিণত হচ্ছে। স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকেল (SLV)-এর অভিজ্ঞতা, হাইপারসনিক প্রযুক্তি পরীক্ষণ এবং তরল-প্রসারণ প্রযুক্তিতে অর্জিত দক্ষতা এসবকে ভৌত ভিত্তি দিচ্ছে।

খোররামশাহর-৫ এবং আইসিবিএম প্রসঙ্গ

সম্প্রতি ইরানের প্রেসটিভিসহ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘খোররামশাহর-৫’ নামের একটি নতুন আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম) ঘিরে ব্যাপক আলোচনা চলছে। বিভিন্ন পোস্ট ও প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ১২ হাজার কিলোমিটার, গতি শব্দের ১৬ গুণ (ম্যাক ১৬)। এটি দুই টন ওজনের ওয়ারহেড বহনে সক্ষম।

যদি সক্ষমতার তথ্য সত্য হয়, তবে খোররামশাহর-৫ যুক্তরাষ্ট্রসহ উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চলে আঘাত হানতে সক্ষম হবে। এতে ইরান বিশ্বের হাতেগোনা আইসিবিএম থাকা দেশগুলোর (যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, উত্তর কোরিয়া ও ভারত) কাতারে উঠে আসতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ক্ষেপণাস্ত্রের দুই টন পেলোড বহনক্ষমতা মার্কিন স্টিলথ বোমারু বিমান বি-টু স্পিরিটের বোমা বহনক্ষমতার সমতুল্য। তবে বি-টু বিমানকে শত্রুর আকাশ প্রতিরক্ষা অতিক্রম করে মিশন সম্পন্ন করতে হয়, আর খোররামশাহর-৫ একক শটে সেই ধ্বংসক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারে।

‘খোররামশাহর-৫’-কে ঘিরে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো একদিকে যেমন ইরানের প্রযুক্তিগত সক্ষমতার নতুন অধ্যায় শুরু করার ইঙ্গিত দিচ্ছে, তেমনি এ-ও স্পষ্ট করছে যে ইরান এখন এক বৈশ্বিক বার্তা দিতে চায়।

স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণযান (SLV) প্রোগ্রামের অভিজ্ঞতা, হাইপারসনিক প্রযুক্তিতে অগ্রগতি এবং বহুপদক্ষেপ প্রপালশন ব্যবস্থা আয়ত্ত করা—ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, খোররামশাহর-৫ বাস্তবে রূপ নিতে পারে।

একটি আইসিবিএম তৈরি করা অবশ্য কেবল প্রযুক্তিগত নয়, বরং কৌশলগত সিদ্ধান্তের বিষয়। এটি ইরানের প্রতিরোধ নীতিকে আঞ্চলিক সীমারেখা ছাড়িয়ে বৈশ্বিক পর্যায়ে নিয়ে যাবে।

কৌশলগত অর্থ ও আন্তর্জাতিক প্রভাব

খোররামশাহর সিরিজের আট বছরের এই যাত্রা কেবল প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়; এটি ইরানি প্রতিরক্ষা শিল্পের ধারাবাহিকতা, কৌশলগত আত্মনির্ভরতা ও রাজনৈতিক সংকেত প্রেরণের একটি সমন্বিত অর্জন। এই ক্ষেপণাস্ত্রের উদ্ভাবন এবং সম্ভাব্য আইসিবিএম-সংক্রান্ত খবরগুলো ইরানের প্রতিরক্ষা কৌশলকে পুনরায় রূপায়ণ করছে এবং স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে, দেশটি কেবল আঞ্চলিক প্রতিরোধেই সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না, বরং তার কৌশলগত ব্যাপ্তি ও প্রতিরোধ ক্ষমতা বিস্তৃত করতে চাইছে। এমনকি যদি খোররামশাহর-৫ সংক্রান্ত দাবিগুলো বাস্তবে রূপ পায়, তবে তা আঞ্চলিক শক্তি, পশ্চিমা নীতিনির্ধারক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা পরিমণ্ডলে নিঃসন্দেহে নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।