২০২৫ সালের ১৬ জুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সের (সাবেক টুইটার) এক ব্যবহারকারী একটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই-নির্মিত ছবি শেয়ার করেন। ছবিটিতে দেখা যায়, নির্বাসিত ইরানি শাহের পুত্র রেজা পাহলভি সিংহাসনে বসে আছেন, আর পোস্টে লেখা—তিনি ইরানে স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধি আনবেন!
রেজা পাহলভির পিতা মোহাম্মদ রেজা শাহ, তাঁর শাসনামলে দু’বার ইরান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
পাহলভি বংশের প্রতিষ্ঠাতা রেজা খানও তেমন ভাগ্যবান ছিলেন না। ১৯৪১ সালে মিত্রবাহিনী ইরানে আক্রমণ চালিয়ে দেশ দখল করার পর তাঁকেও নির্বাসনে পাঠানো হয়। সে সময় ব্রিটিশ ও সোভিয়েত বাহিনী ইরানের খাদ্য মজুত দখল করে নেয়, যার ফলে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ লাখ ইরানির মৃত্যু ঘটে।
কিন্তু ২০২৫ সালে, যখন ওই এক্স ব্যবহারকারী তথাকথিত ‘পাহলভি যুগের স্বর্ণালি দিন’ নিয়ে কথা বলছিলেন, তখন এসব অন্ধকার ও বেদনাদায়ক ইতিহাস সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত হয়। তিনি ইরানিদের আহ্বান জানান—যুদ্ধাপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে হাত মেলাতে এবং ইরানজুড়ে দাঙ্গা সৃষ্টি করার সময় ইসরায়েল যেন দেশটিতে বোমাবর্ষণ করে।
আরেকটি পোস্টে, তিনি সাবেক শাহের নাতনির ছবি শেয়ার করে জিজ্ঞেস করেন, “আপনারা কি চান না —এমন এক ‘সুন্দরী রাজকন্যা’ ভবিষ্যতের রানি হোক?” কিন্তু ওই ‘রাজকন্যা’ ফার্সি ভাষা পর্যন্ত জানেন না। তাঁর সামাজিক মাধ্যমের পেইজ সমুদ্রতীর, ক্লাব ও বিলাসবহুল ভিলায় তোলা ছবিতে ভরপুর।
ওই ব্যবহারকারীর পোস্টে প্রতিক্রিয়া দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়। প্রথমত, তাঁর মতো আরও কিছু অ্যাকাউন্ট তাঁকে ‘সাহসী’ ও ‘বুদ্ধিমতী’ বলে প্রশংসা করে। এদের অনেকেই পাহলভি পরিবারের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রচার চালায় এবং তারা ইসরায়েলের ইরানের ওপর ১২ দিনের আগ্রাসনের সময় হঠাৎ করেই সক্রিয় হয়ে ওঠে। অথচ এর আগে তারা দীর্ঘ সময় নিষ্ক্রিয় ছিল।
দ্বিতীয় শিবিরে থাকা ইরানিরা হতবাক হয়ে প্রতিক্রিয়া জানান, কেউ কেউ অশালীন ভাষায়ও প্রতিবাদ করেন। তারা লেখেন, “ইরানকে কে শাসন করে সেটা ইসরায়েলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়; তারা ইসলামি প্রজাতন্ত্র থাকুক বা না থাকুক, ইরানকে টুকরো টুকরো দেখতে চায়। ” কেউ কেউ ব্যবহারকারীকে ‘ইসরায়েলি এজেন্ট’ বলে অভিযোগ করেন।
এক প্রতিক্রিয়ায় লেখা হয়, “তুমি কেমন করে এমন এক হত্যাকারীর পাশে দাঁড়াতে পারো, যে হাজারো ফিলিস্তিনি শিশুকে হত্যা করেছে এবং তোমার দেশেও তাই করতে চায়? তুমি নিজেকে কীভাবে ইরানি বলো?”
এখন পরিষ্কার, যারা ইসরায়েলের হামলার সমর্থনে ইরানিদের আহ্বান জানাচ্ছিল, তারা কেবল অ-ইরানি নয়, সম্ভবত মানুষও নয়।
টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সিটিজেন ল্যাব’-এর গবেষণা অনুযায়ী, ৫০টি ভুয়া এক্স প্রোফাইল এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে জুন মাসে ইসরায়েলের ইরানবিরোধী যুদ্ধের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি প্রচারণা-অভিযান চালায়। এর লক্ষ্য ছিল ইরানি জনগণকে সরকারবিরোধী বিদ্রোহে উসকে দেওয়া। গবেষকরা বলেন, এই অভিযান পরিচালনা করেছে ইসরায়েলি কোনো গোপন সংস্থা অথবা তাদের ঘনিষ্ঠ তত্ত্বাবধানে থাকা কোনো ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। এসব অ্যাকাউন্ট রেজা পাহলভিকে ইরানের বর্তমান নেতৃত্বের বিকল্প হিসেবে প্রচার করছিল।
২০২৩ সালের ১৮ এপ্রিল পূর্ব জেরুজালেমে ওয়েস্টার্ন ওয়াল পরিদর্শন করেন রেজা পাহলভি
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে, ২৪ জুন প্যারিসে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন রেজা পাহলভি।
৬৪ বছর বয়সী এই স্বঘোষিত যুবরাজ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান, তারা যেন তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে পুনরায় কূটনৈতিক আলোচনা শুরু না করে ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে ‘জীবনীশক্তি’ না দেয়। তিনি দাবি করেন, ইরানের বর্তমান শাসনব্যবস্থা পতনের দ্বারপ্রান্তে এবং বলেন, “এটাই আমাদের বার্লিন প্রাচীর ভাঙার মুহূর্ত। ”
তিনি জনগণকে রাজপথে নামতে ও সেনাবাহিনীকে পক্ষত্যাগ করতে আহ্বান জানান। কিন্তু তাঁর এই আহ্বান ইরানজুড়ে কোনো সাড়া পায়নি; বরং বিদেশি হামলার মুখে অনেক ইরানি, এমনকি সরকারবিরোধীরাও জাতীয় পতাকার তলে ঐক্যবদ্ধ হন।
ফ্রান্সে দেওয়া বক্তৃতায় যিনি নিজেকে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির স্থলাভিষিক্ত হতে প্রস্তুত বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি বাস্তবতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।
ইরানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং Treacherous Alliance: The Secret Dealings of Israel, Iran and the United States গ্রন্থের লেখক ত্রিতা পার্সি বলেন, “ইসরায়েল ইরানে ব্যাপক বোমাবর্ষণ চালিয়ে ৯৩৫ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করলেও পাহলভি নিন্দা জানাননি। এতে তিনি যে সামান্য জনপ্রিয়তাও পেয়েছিলেন, তাও হারিয়েছেন। ”
ত্রিতা আল–জাজিরাকে আরও বলেন, “ইসরায়েল যখন আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে বোমা ফেলে সাধারণ মানুষ হত্যা করছিল, তখন তিনি টিভিতে এসে তাদের পক্ষ নিয়ে বক্তব্য দিলেন। এতে তিনি ‘শাহ’ নামের ব্র্যান্ডটাই ধ্বংস করে ফেলেছেন। ”
পাহলভি পরিবার (মোহাম্মদ রেজা শাহ'র স্ত্রী শাহবানু ফারাহ, তার ছেলে রেজা পাহলভি এবং তার নাতনিরা)
তেহরান টাইমস জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও কিছু ইউরোপীয় দেশ ২০২২ সালের শেষ দিক থেকে একই ধরনের প্রচারণায় অর্থায়ন করছে, যেখানে ইরানি জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে ওঠার আহ্বান জানানো হয়। তবে এই প্রচারণাগুলোর প্রস্তাবিত ‘বিকল্প’ সবসময় এক নয়। কেউ কেউ প্রচার করছে কুখ্যাত সন্ত্রাসী সংগঠন মুজাহেদিন-ই-খালক (এমইকে)-কে, আবার কেউবা ইরানের বিভিন্ন প্রদেশ বিচ্ছিন্ন করার আহ্বান জানাচ্ছে।
ইরানের দৈনন্দিন জীবনে এসব পশ্চিমভিত্তিক বিরোধী গোষ্ঠী বা তাদের কল্পনাপ্রসূত পরিকল্পনা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয় না। সাম্প্রতিক এই গবেষণার খবরও সাধারণ জীবনে তেমন প্রভাব ফেলেনি, তবে সামাজিক মাধ্যমে তা ক্ষোভ ও উপহাসের ঢেউ তুলেছে। ইরানিরা এক্স ও ইনস্টাগ্রামে বিরোধীদের প্রশ্ন করছে, “তোমরা এবং পশ্চিমারা আর কতদিন নিজেদেরই বোকা বানাবে?”
এক ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী, যার কৌতুকভিত্তিক পেজে ৪০,০০০ এর বেশি অনুসারী রয়েছে, তাঁর স্টোরিতে লিখেছেন— “বিশ্বাসই হচ্ছে না, ইসরায়েল আর পশ্চিমারা এখনও এসব লোককে আমাদের বিকল্প হিসেবে চালান করার চেষ্টা করছে। ” পরের স্টোরিতে তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, “আমি ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ভক্ত নন, কিন্তু কখনোই এমন বিশ্বাসঘাতকদের জন্য সরকার পতন চাই না, যারা বিদেশিদের নিজের দেশ আক্রমণ করতে অনুরোধ করে। ”
পশ্চিমে বসবাসরত বহু ইরানবিরোধী নেতা ইসরায়েলের ইরানবিরোধী যুদ্ধকে ‘মুক্তির সুযোগ’ হিসেবে বর্ণনা করেন। কিন্তু এ অবস্থান তাঁদেরকে আরও অজনপ্রিয় করে তুলেছে, কারণ ইরানের সাধারণ মানুষ তখন নিজেদের ও প্রিয়জনদের ওপর হামলার ভয়ে আতঙ্কিত ছিল।
ইরানের পার্স নিউজ এজেন্সি সাম্প্রতিক এই ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে লিখেছে— “পশ্চিমা নীতিনির্ধারকরা এখনও সেসব বিরোধীদের তথ্য ও বয়ানের ওপর নির্ভর করছেন, যারা বহু বছর ধরে ইরানি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং দেশের সামাজিক বাস্তবতা বোঝার সক্ষমতা হারিয়েছে। সময় যত যাচ্ছে, ততই পরিষ্কার হচ্ছে— এই বিরোধীদের আসলে কিছুই নেই। তাদের দেশে কোনো জনসমর্থন নেই, তারা নিজেদের বিশ্বাসের জন্য লড়াইও করে না। তারা পশ্চিমা অর্থে বিলাসবহুল জীবনযাপন করে এবং বট ব্যবহার করে মিথ্যা প্রচার চালায়। ”
বটবাহিনীর বিপ্লব নয়, মানুষের ঐক্যই ইরানের শক্তি
ইরানের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দিয়েছে— বিদেশি প্রভাব, প্রযুক্তিনির্ভর প্রচারণা বা বট-চালিত কৃত্রিম বিপ্লব কোনোভাবেই বাস্তব জনসমর্থন তৈরি করতে পারে না। রেজা পাহলভির ভার্চ্যুয়াল ‘বিপ্লব’ হয়তো বটদের দুনিয়ায় সাড়া ফেলেছিল, কিন্তু বাস্তব ইরানে তা নিছক হাস্যরসের উপাদান। ইরানের জনগণ আজও জানে— স্বাধীনতা কখনো সফটওয়্যার দিয়ে আসে না, আসে আত্মত্যাগ ও বাস্তব সংগ্রামের মাধ্যমে।
১২ দিনের যুদ্ধে ইরানি জনগণ আবারও প্রমাণ করেছে যে, বিদেশি চাপ, যুদ্ধ, কিংবা প্রচারণা নয়, দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করবে তারাই। যখন আকাশে বোমা পড়ে, তখন ইরানের সাধারণ মানুষ রাজনীতি নয়, বাঁচার লড়াই বেছে নেয়— আর সেই মুহূর্তেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, নির্বাসিত নেতাদের আহ্বান নয়, মানুষের ঐক্যই ইরানের প্রকৃত শক্তি।
এমজেএফ