বাংলাদেশ সম্পর্কে গড়পড়তা পাকিস্তানিরা কী ভাবে? আমাদেরকে তারা কোন নজরে দেখে বা মূল্যায়ন করে? এর সহজ উত্তর— দু’একটি ব্যতিক্রম এবং বুদ্ধিজীবী মহলে ৭১’র ঘটনাবলী নিয়ে সত্যভাষণের কিছু চেষ্টা ছাড়া বাংলাদেশি তথা বাঙালিদের ব্যাপারে তারা নেতিবাচক ধারণায় তাড়িত। পাকিস্তানের প্রভাবশালী পত্রিকা ডন.কম এর ভাষায়— “পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের চোখের দিকে তাকাতে রাজি নয়।
পর্ব:২
বাঙালি, ভারতীয়, মুসলিম, গরীব, কৃষক
প্রত্যেক ব্যক্তিসত্তার একাধিক পরিচয় থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। এই একের অধিক পরিচয়গুলোকে নিয়ে আমরা একটির পরিপূরক হিসেবে অন্যটিকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে অথবা একটির সঙ্গে অপরটির দ্বন্দ্ব-বিধূর পরিবেশে থাকতে পারি। এসব আলাদা আলাদা সত্তার পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াটা জটিলই। আর এগুলো যে রাজনৈতিক আবহ সৃষ্টি করে তা জটিলতর, ষড়যন্ত্রমুখর আর প্যাঁচালো। অন্য কথায় বলতে গেলে— আমাদের কারো পরিচয় হতে পারে বাঙালি মুসলিম বা পাঞ্জাবি মুসলিম অথবা মুসলিম কৃষক কিংবা হিন্দু কৃষক বা পাঞ্জাবি কৃষক না হয় বাঙালি কৃষক। এ ধরনের পরিচয়ধারী গ্রুপগুলোর প্রতিটির রাজনৈতিক আকাঙ্খা আর গতিপ্রকৃতি নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে ঐক্য গড়ে তোলে আবার অন্য কোনো বিষয়ে বিপরীতমুখী অবস্থান নেয়। আর রাজনৈতিক দল বা নেতার সাফল্য নির্ভর করে এ ধরনের বহুমুখী রাজনৈতিক স্বার্থ আর উদ্দেশ্যগুলোর সম্মিলন ঘটিয়ে সবাইকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পথে যূথবদ্ধ করার মধ্যে।
আর এই ক্ষণে ঐক্য আর ক্ষণে অনৈক্যর ধারাবাহিকতা চাক্ষুষ করতে চাইলে আপনাকে আমাদের ইতিহাসের পাতায় ঢুঁ মারতে হবে— আপনাদেরকে পরিচিত হতে হবে জনাব আবু কাসিম ফজলুল হকের (আবুল কাশেম ফজলুল হক) সঙ্গে। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ কায়েদ-এ-আযম যখন অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের (এআইএমএল) সাধারণ সভায় তাকে পাকিস্তান প্রস্তাব উপস্থাপনকারী হিসেবে বেছে নিলেন, তখন তিনি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী।
মুসলিম লীগের এই সভায় অংশগ্রহণের জন্য পাঞ্জাব, সিন্ধু, পাখতুনওয়া, বালুচিস্তানসহ ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে লাহোরে জড়ো হওয়া মুসলিম নেতারা সবাই ওই প্রস্তাব সমর্থন করেন যা মুসলিম লীগকে ভারত জুড়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। এই নেতাদের খুব কম সংখ্যকই ১৯৩৬ এর নির্বাচনে এআইএমএল-এর টিকেটে বিজয়ী হয়েছিলেন কিন্তু মুসলিম লীগের জনপ্রিয় কর্মসূচির প্রবক্তা হলেন তারাই।
শের-এ-বাংলা নামে সমধিক পরিচিত ফজলুল হক ওই সময়টায় অবিভক্ত বাংলার কোয়ালিশন সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন। তার কৃষক প্রজা পার্টি (আক্ষরিক অর্থে কৃষকদের দল) ১৯৩৬ এর নির্বাচনে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ওই নির্বাচনে প্রথম স্থান অধিকার করে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস আর দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল মুসলিম লীগ। সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কেউ-ই পায়নি। এ অবস্থায় একমাত্র কোয়ালিশন সরকারই ছিল নিয়তি। হক মুসলিম লীগের ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পছন্দ করেননি এবং নির্বাচনে মুসলিম নবাব আর জায়গিরদারদের এই দলটির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান।
হক চেয়েছিলেন বাঙালি পরিচয়টাকে নির্মাণ করতে এবং ভেবেছিলেন তারই মতো সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী নীতির ধারক কংগ্রেস তার সঙ্গী হবে। কিন্তু সম্ভবত কংগ্রেস তার কৃষক-কেন্দ্রিক রাজনীতিকে নিজেদের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় লোহিত বর্ণের (কমিউনিস্ট) হিসেবে বিচার করে। But Congress probably found Haq’s farmer-centered politics too ‘red’ to accommodate. এছাড়া প্রজা পার্টির কিছু নেতাকে কমিউনিস্ট বলে সন্দেহ করা হতো। বাঙালি কৃষকরা জমিদার এবং দাদনদার-মহাজন যাদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু, তাদেরকে নিজেদের প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করতো আর এর বিপরীতে অভিজাত শ্রেণীর ওই হিন্দু রইসদের মাঝে কংগ্রেস খুঁজে পায় তার একনিষ্ঠ অনেক সমর্থককে। সর্বোপরি কংগ্রেসের নীতি ছিল বাঙালি বা পাঞ্জাবি হওয়ার চেয়ে ভারতীয় হওয়ার পক্ষেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া।
আর তাই কংগ্রেস ফজলুল হকের সঙ্গে হাত মেলাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তাকে মুসলিম লীগের দিকে ঠেলে দিল যে সুযোগ লুফে নেওয়ার জন্য মুসলিম লীগ হাত বাড়িয়েই ছিল। এর ফলে (মুসলিম লীগ-কৃষ প্রজা পার্টি) কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠিত হলো। তবে এর এক সপ্তাহের মধ্যেই কৃষক প্রজা পার্টির একটি গ্রুপ দলের বাজেটারি কর্মসূচির বিরোধীতায় স্বপক্ষ ত্যাগ করে কংগ্রেসে যোগ দিল।
অপরদিকে, প্রজাদলের অধিক ‘লালপন্থি’ সদস্যরা ভাবনায় পড়লেন যে তাদের দল নির্বাচনী ইশতেহারের নীতিচ্যুত হচ্ছে। বহুধাবিভক্ত মতভেদের ফলে দলের ভেতর দলাদলির সৃষ্টি হল, ফলে কৃষক প্রজা পার্টি দুর্বল হয়ে পড়লো এবং কোয়ালিশন প্রধান হিসেবে হকের অবস্থানও নড়বড়ে করে দিল। এর ফল হলো বাংলার রাজনীতিকে ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত করণে দৃড়প্রতিজ্ঞ ফজলুল হক ক্রমশ মুসলিম লীগের ওপর উল্টো আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন।
পাকিস্তান প্রস্তাবের কিছুকাল পরে, হক দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধীতায় নামলেন এবং এর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই প্রচারণা শুরু করলেন। তবে ফজলুল হকের এ পদক্ষেপ কোনোমতেই এটা বোঝায় না যে ভারতীয় রাজনীতির নঞ্চে নিজেদের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে মুসলমানদের আবেগের প্রতি তিনি একাত্ম ছিলেন না। বয়সে কায়েদ-এ-আযমের চেয়ে ৩ বছরের বড় ফজলুল হক ১৯১৩ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত প্রাদেশিক বাংলা মুসলিম লীগের সম্পাদক এবং ১৯১৬ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। ১৯২০ এর দশকের গোড়ার দিকে তিনি খেলাফত আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এছাড়া ১৯১৭ সালে কংগ্রেসের যুগ্ন সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন (তখন পর্যন্ত একইসঙ্গে কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের সদস্য হওয়াটা অধর্ম বলে বিবেচিত হয়নি)।
কিন্তু ওই সময়ের অধিকাংশ মুসলিম নেতার মতই, তিনিও বৃহত্তর ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পটভূমিতে মুসলমানদের স্বতন্ত্র পরিচিতির বিষয়টিকে বিচার করতেন। তবে অনেক মুসলিম নেতাই বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় তাদের লক্ষ্যকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যান— তা হচ্ছে ভারতীয় মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা দেশ। কিন্তু এর সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ হন হক।
মুসলিম লীগ ‘মুসলমানদের নিজের দেশ’ ধারণাকে তাদের সব রোগের ঔষধ হিসেবে উপস্থাপনে সফল হল— আইডিয়াটি জনসমর্থনও পেল। অপরদিকে, ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে হকের প্রজা পার্টি মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়লো— তারা পেল মাত্র ৪টি আসন যার দু’টি ছিল হকের নিজের। এর বিপরীতে মুসলিম লীগের স্বপ্ন পূরণ হলো— বাংলায় সংরক্ষিত ১১৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে তারা পেল ১১০টি।
মুসলিম লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি সরকার গঠন করলেন বাংলায়। ১৯৪৬ সালের আগস্টে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাঁধলো। সাম্প্রদায়িক ওই দাঙ্গার রক্তস্রোত যেসব জায়গায় বইলো তার সবখানেই হিন্দু-মুসলিম সীমানার সূচনা করলো। ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বরে হক মুসলিম লীগে যোগ দিলেন এবং দেশ বিভাগের পর ঢাকায় চলে এলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অ্যাডভোকেট জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করলেন।
হক তার পছন্দের রাজনৈতিক আকাঙ্খাগুলোকে যূঁথবদ্ধ করতে ব্যর্থ হলেন এবং এর ফলে অন্যসব নেতাদের কূট-কৌশলের জোয়ারে তলিয়ে গেলেন। মুসলিম লীগ তার পছন্দের ধর্মীয় ধারায় চলমান রাজনৈতিক সংলাপকে নিজের মুঠিতে নিয়ে নিল এবং তার মূল উদ্দেশ্য হাসিলে সক্ষম হল। তবে এই দলটি তাদের প্রতি বাঙালিদের সমর্থণকে ভুল মূল্যায়ন করলো।
প্রকৃতপক্ষে বাঙালিরা এটা ভাবে নাই যে মুসলমান হতে গেলে তাদেরকে বাঙালিয়ানা ছাড়তে হবে অথবা পাকিস্তানি হতে গেলে তাদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে হিন্দুয়ানি ত্যাগ করতে হবে। *
স্বাধীনতার কয়েক মাস পরেই, উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা ঘোষণার প্রতিবাদে বাঙালি ছাত্ররা আন্দোলনে নামলো এবং দাবি জানালো তাদের মাতৃভাষাকেও একই মর্যাদা দিতে হবে। হক এ আন্দোলনে যোগ দিলেন এবং পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হলেন।
অপরদিকে, আইনসভার অধিবেশন পৌনঃপুনিক অচলাবস্থায় ঘুরপাক খেতে থাকলো। বাঙালিরা বলছিল না যে, অন্য সবাই তাদের কাছে নত হোক। তারা শুধুমাত্র তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো দাবি করছিল— তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির সম্মান দিতে হবে, তাদের সম্পদ তাদের অধিকারেই থাকবে, জনসংখ্যানুপাতে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল থেকে ন্যায্য পাওনা তাদের দিতে হবে।
কিন্তু ‘নীল-রক্তের মুসলিম লীগ নেতৃত্ব’ ভেবেছিল, ধর্মের তুরুপ-তাস দিয়ে তারা সবগুলো বাজী জিতে যাবে। আর সে মতে, যদি কেউ মাতৃভূমির অধিকার আদায়ের দাবি তোলে, তাকে চটকদার বিশ্ব-মুসলিম ভ্রাতৃত্বের আদর্শ বিরোধী সংকীর্ণ প্রাদেশিকতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যদি কেউ তার দেশের সম্পদে নিজ অধিকার দাবি করার সাহস দেখায় তাকে অভিযুক্ত করা হয় ইসলামি জাগরণ প্রতিরোধকারী হিসেবে আর যদি কেউ তার মাতৃভাষার মর্যাদা দাবি করে তবে নিশ্চিতভাবে সে চিহ্নিত হযে যায় একজন বিশ্বাসঘাতক আর ভারতীয় দালাল হিসেবে।
বাংলা কোনো করদ রাজ্য (banana state) ছিল না আর মুসলিম লীগও কোনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ছিল না। এ পরিস্থিতিতে বাঙালিরা মনস্থির করলো, এর দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে।
পাকিস্তানের তৎকালীন রাজধানী করাচীর গদিনশীনরা সম্ভবত বাংলায় কী ঘটছে তা ভালই জানতেন। ১৯৪৬ সালে নির্বাচিত পাঞ্জাব, সিন্ধু, পাখতুনওয়া এবং বাংলার আইন পরিষদের মেয়াদ ১৯৫১ সালে শেষ হওয়ার পথে ছিল। এ সময়ের মধ্যে দেশের আইন পরিষদ নয়া রাষ্ট্রটির জন্য বৃহত্তর আঙ্গিকের একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতেও ব্যর্থ হয়। আর নয়া পদক্ষেপের অনুপস্থিতিতে পুরনো আইন পরিষদকেই কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছিল।
১৯৫১ সালের মার্চে পাঞ্জাব অ্যাসেম্বলির নির্বাচন হয় আর পাখতুনওয়ায় (তকালীন এনডব্লিউএফপি) নির্বাচন হয় একই বছরের দ্বিতীয়ার্ধে। ১৯৫৩ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে, ১৯৫১ সালে সিন্ধুতে গভর্নরের শাসন চালু করা হয়। আর সবগুলো নির্বচানেই মুসলিমল লীগ জিততে সক্ষম হয়। এই দলটি ১৯৪৬ সাল থেকে পূর্ব বাংলায়ও ক্ষমতাসীন ছিল।
এ পটভূমিতে দেশের রাজনৈতিক আবহ সবকিছু পরিষ্কার বলে দিচ্ছিল, আর মুসলিম লীগ তাদের স্বার্থে যা করতে পারতো তা হচ্ছে পরবর্তী নির্বাচনকে যতটা সম্ভব প্রলম্বিত করা।
যাহোক, শেষ পর্যন্ত ঘোষণা করা হলো পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের নির্বাচন হবে ১৯৫৪ সালের মার্চে।
এরমধ্যে ১৯৪৯ সালের শুরুতেই পূর্ব বাংলার বিক্ষুব্ধ মুসলিম লীগ নেতাদের বৃহৎ একটি অংশ দল ত্যাগ করেছে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি, মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমানসহ অপরাপর নেতারা গঠন করেছেন অল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। শুরু থেকেই ভাষা আন্দোলনের সমর্থক ফজলুল হকও ১৯৫৩ সালে গঠন করেছেন নয়া দল শ্রমিক কৃষক পার্টি। এ দু’টি দল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়ে ৫৪’র নির্বাচনে লড়ার সিদ্ধান্ত নিল এবং ফজলুল হককে জোটের নেতা হিসেবে বেছে নিল।
যুক্তফ্রন্ট হিসেবে পরিচিত এই জোট ২১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করলো। দফাগুলোর মধ্যে ছিল— বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান, জনসংখ্যার ভিত্তিতে পার্লামেন্টে বাঙালিদের জন্য আসন বরাদ্দের বিরোধীতাকারী খসরা সংবিধান প্রত্যাখ্যান, দেশের জন্য একটি সংবিধান রচনার স্বার্থে পুরনো অ্যাসেম্বলি বাতিল করে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত নয়া অ্যাসেম্বলি গঠন প্রভৃতি।
মুসলিম লীগ সংকট উত্তরণে পাগলের মত কোনো কিছু একটা ধন্বন্তরির সন্ধানে ছিল। নির্বাচনী প্রচারণায় অনুকূল আবহ আনতে তারা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র বোন ফাতেমা জিন্নাহকে পূর্ব বাংলায় এক ঝটিকা সফরে পাঠালো। কিন্তু ইতোমধ্যে বাঙালিদের যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গেছে। তাই ফাতেমা জিন্নাহ মুসলি লীগের প্রত্যাশা মত সেখানে কোনো যাদু-ই দেখাতে পারলেন না। ৩০৯ সদস্যের পার্লামেন্টে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ পেল নগন্য ১০টি আসন মাত্র। অন্যদের মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেলেন ৩টি, খিলাফত-ই-রব্বানি ১টি আর যুক্তফ্রন্ট পেল ২২৩ আসন! এরচেয়ে বড় গণরায় আর কিছু হতে পারে না।
কিন্তু জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত পরিষদকে পুরনো আইন পরিষদের স্থলাভিষিক্ত করতে যুক্তফ্রন্টের দাবি অগ্রাহ্য করে রাজধানী করাচীর কেন্দ্রীয় সরকার বাঙালিদের কাছে কোনোমেতই গ্রহণযোগ্য নয় তেমন একটি সংবিধান রচনা ও অনুমোদনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
পাকিস্তানের তথাকথিত সরকার (establishment) জানতো— বাঙালিদের টলানো যাবে না। আর তাই তারা নানা বাহানায় পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠান ঝুলিয়ে রাখলো দীর্ঘ ১৬টি বছর। আর ১৯৭০ সালে সেই নির্বাচন যখন অনুষ্ঠিত হলো তাতে দেখা গেল, ৩০০ আসনের জাতীয় পরিষদে পূর্ব বাংলার জন্য বরাদ্দ ১৬২ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ১৬০টি আসন। এবারও গণরায় ছিল উচ্চকিত আর পরিষ্কার। কিন্তু তথাপি বাঙালিরা ফের দেখলো কেন্দ্রীয় সরকারের রাজধানী করাচীর গদীনশীনরা কেউ তাদের আওয়াজ শুনছে না।
এবার তারা অবশ্যই বুঝতে পারলো— ঘুমন্ত কাউকে ডেকে তোলা যায়, কিন্তু ঘুমের ভান করে শুয়ে আছে এমন কাউকে জাগিয়ে তোলা অসম্ভব।
*[লেখকের এই মতটি (or being Pakistani compelled them to quit being Hindu) কিছুটা বিভ্রান্তিকর এবং বিশদ ব্যাখ্যার দাবি রাখে। এতে মনে হচ্ছে তিনি ধারণো করছেন, পূর্ব বাংলা বা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ সবাই একই সঙ্গে হিন্দু এবং মুসলমান]
পর্ব-৩
যদি তারা বিশ্বাসঘাতকদের নির্বাচন করেই, তাতে দোষের কী
এবং তারা (বাঙালিরা) নির্বাচিত করলো। শুধু একজন নয়, দু’জন নয়, বিশ্বাসঘাতকে পূর্ণ পুরো একটি আইনসভা তারা নির্বাচিত করলো!পাকিস্তান আসলে নিজে একটি জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে থেকেই বিশ্বাসঘাতক চিহ্নিত করার কাজটা শুর করে। জন্মের পর থেকে এমন সময় খুব কমই গেছে যখন তাকে দ্বিধা-দ্বন্ধ-দ্বৈরথ-সংকটে কাটাতে হয়নি। এধরনের সময়গুলোতে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়াগুলো অর্থহীন চেঁচামেচি বই ছিল না।
পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনরা খুব ভালই জানেন তারা ঠিক কী ধরনের রাষ্ট্র আর সরকার চান। তারা এটাও চান যে নির্বাচনমুখী গণতন্ত্র তাদের পরিকল্পনাগুলোকে শুধু আইনগত ভিত্তি দিয়ে যাবে। তবে প্রশাসনের সব ধরনের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পাকিস্তানের দুর্বল গণতন্ত্র নৈতিক সক্ষমতা অর্জন করেনি।
তাদের মনোবাসনা ছিল প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ফল পাওয়ার জন্য গণতন্ত্র বার বার তাদের জন্য ইতিবাচক কাজ করে যাবে। তবে এটা কোনো কাকতাল নয় যে, জনগণ পাকিস্তানের কথিত সব বিশ্বাসঘাতক বা সন্দেহভাজন বিশ্বাসঘাতকদের নিছক জোশের বশেই তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে ফেললো।
এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ১৯৪৯ সালের ৭ মার্চ লিয়াকত আলী খান জাতীয় পরিষদে প্রস্তাবিত সংবিধান উত্থাপন করে এটি পাস করানোর চেষ্টা করেন। করাচিতে আয়োজিত ওই অধিবেশন ছিল ২০ মাস বয়সী জাতীয় পরিসদের ৫ম অধিবেশন। সেদিন অধিবেশনের প্রথম দিন বিকাল ৪টায় প্রস্তাব উপস্থাপন করে লিয়াকত আলী দীর্ঘ এক বক্তৃতা দেন।
তার বক্তব্যেরে পরপর বিরোধীপক্ষের নেতারা বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের হিন্দু সদস্যরা আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং ব্যাপক প্রতিবাদ জানান ওই প্রস্তাবনার। তারা অভিযোগ করেন, প্রধানমন্ত্রী বুলডোজার চালিয়ে সংবিধানকে ধ্বংস করতে চাইছেন।
জাতীয় পরিষদের সেদিনকার বিতর্কের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি (এগুলো পার্লামেন্টের অফিসিয়াল ডকুমেন্ট):
“মি. শ্রীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেন— পূর্ব বাংলায় আমাদের বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি সবিস্তারে বোঝার জন্য আমাদের সময় প্রয়োজন।
তিনি আরো বলেন, বাস্তবিক অর্থে এবার আমরা যখন বাংলা থেকে রওনা করি, এখানে যে এ ধরনের একটি প্রস্তাব পাস করা হবে— সে ধরনের কোনো ধারণাই ছিল না। আমাদেরকে পাঠানো অধিবেশনের আলোচ্যসূচিতে এর কোনও ইঙ্গিতই ছিল না। এখন বাজেট অধিবেশন প্রায় শেষের পথে। অধিবেশনে উপস্থিত সদস্যের সংখ্যাও খুবই কম এখন। আমার প্রদেশের অনেক সদস্য, যেমন মুখ্যমন্ত্রী (পূর্ব বাংলার) যিনি উপস্থিত থাকলে আমাদেরকে খুব ভাল পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিতে পারতেন এ ব্যাপারে— তারা ইতোমধ্যেই হাউস ত্যাগ করেছেন। আমি বুঝতে পারছি, এ বিষয়ে তারা কোনোভাবেই ওয়াকিবহাল ছিলেন না। কিছু সদস্য আছেন যারা অধিবেশনে একেবারেই যোগ দেননি। এ ধরনের একটি প্রস্তাবের বিষয়ে সঠিকভাবে তাদেরকে নোটিশ দিয়ে জানালে তারা নিশ্চয়ই এর ওপর বিতর্কে অংশ নিতে এখানে উপস্থিত হতেন।
বাস্তবে তাদেরকে কোনও নোটিশই দেওয়া হয়নি।
...তাই আমি এ ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়ার স্পর্ধা দেখাচ্ছি যে, এ ধরনের একটি গুরুতর বিষয়ের বিবেচনায় এ নিয়ে আলোচনা পরবর্তী অধিবেশন পর্যন্ত স্থগিত করা হোক। সংবিধানের প্রস্তাবনাটি জনমত যাচাইয়ের জন্য প্রকাশ করা হোক। এরপর পরবর্তী অধিবেশনে এ নিয়ে আলোচনা করা হোক বা এজন্য একটি বিশেষ অধিবেশন ডাকা হোক...
চট্টোপাধ্যায় সাহেবের বক্তব্যের জবাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মি. লিয়াকত আলী খান বলেন, আমি বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, প্রস্তাবনাটি জনসমক্ষে প্রকাশের দাবি করে মাননীয় সদস্যের উপস্থাপিত বক্তব্যে বেশ কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। অসঙ্গতিগুলোর অন্যতম একটি হচ্ছে, অধিবেশনে উপস্থিত সদস্যের সংখ্যা খুবই কম যেহেতু অধিকাংশ সদস্যই চলে গেছেন, অনেকেই এখানে নেই এবং তাদের হাতে পর্যাপ্ত সময় নেই। আমার মাননীয় বন্ধুর দল সম্পর্কে যতটুকু জানি, একজন ছাড়া সেই দলের প্রত্যেকে এখানে উপস্থিত আছেন, তিনি দুর্ভাগ্যজনক কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তবে তিনি করাচিতেই আছেন। আর তাই সদস্যদের অনুপস্থিতি সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, আমি মনে করি এটা সত্যিকারার্থে গুরুত্বপূর্ণ কোনো যুক্তি নয়।
লিয়াকত আলী খানের বক্তব্যের জবাবে চট্টোপাধ্যায় বলেন, আমার কিন্তু কোনো দল নেই। আমি আসলে প্রত্যেকের সঙ্গেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলবো।
জবাবে লিয়াকত আলী বলেন, আমি ‘দল’ (পার্টি) শব্দটি দিয়ে এই হাউজের অমুসলিম সদস্যদের কথা বুঝিয়েছি এবং আমি আবারো বলছি, তাদের প্রত্যেকে এখানে উপস্থিত আছেন...”
অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল উপস্থাপনের সময় অধিবেশনে অপরাপর মুসলিম সদস্যদের উপস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায়ই আনেননি। আসল কথা হচ্ছে, তিনি চাননি তারা কোনও বিতর্ক করুক এ নিয়ে কিংবা খোদা মাফ করুন, তারা যাতে কোনো বিরোধীতা তৈরি করতে না পারে, তিনি এই চেষ্টাই করেছিলেন।
তাদের কাছে প্রত্যাশা করা হয়েছিল, (পাকিস্তানের মসনদধারীদের যে কোনো ইচ্ছায়) বিয়ের আসরে জবরজং বেনারশীর জগদ্দলে চাপা পড়া কনেরা উকিল বাবার সামনে যেমনটি করে থাকে, (বাঙালিরা) শুধু মাথা নেড়ে সেরকম ‘কবুল’ বলবেন অন্যরা।
তাদের ধারণা ছিল, ইসলামের নামে করা যে কোনো কিছুর (এমনকি আইনও) বিরোধীতা কোনো ‘সাচ্চা মুসলমানের’ পক্ষে ভাবাও অচিন্ত্যনীয়। কিন্তু অবিরাম নিজেদের অধিকারের দাবিতে সোচ্চার পূর্ব বঙ্গে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ‘সাচ্চা মুসলমানদের’ সরবরাহে ঘাটতি ছিল।
তারা চাইছিল এমন একটি সংবিধান যা প্রণয়ন করবে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সংসদ।
তারা চাইছিল পাকিস্তান হবে এমন একটি রাষ্ট্রজোট (যুক্তরাজ্য) যেখানে এর সবগুলো অংশ সমতা ও ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে শাসিত হবে।
তারা চেয়েছিল সর্বোচ্চ প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন এবং অর্থেনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে কার্যকর রক্ষা কবচ। তারা চেয়েছিল তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা।
কিন্তু আমাদের এস্টাবলিশমেন্টের কাছে এসবের কোনোটাই গ্রহণযোগ্য ছিল না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যখনি গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এদেশে, জনগণ বাঙালিদের সব গণতান্ত্রিক দাবিকেই স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দিয়েছে।
আর তাই, সিকি শতাব্দীকাল যাবত, আমাদের শাসকরা তাদের ইচ্ছার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গণতন্ত্রের চেহারা-সুরৎ পাল্টানোর চেষ্টা করে গেছে।
কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। পাকিস্তানের বেসামরিক-সামরিক শাসকচক্র ১৯৬৯ সালের মধ্যে তাদের পক্ষে মন খারাপ করা সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য হলেন— বাঙালিদের কিছু দাবি অন্ততপক্ষে মেনে নিতে হবে।
আর তাই সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হলো, একজন এক ভোট নীতি গ্রহণ করা হলো এবং জনগণ সরাসরি জাতীয় পরিষদের সদস্যদের নির্বাচন করবে(জেনারেল আইয়ুবের পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতির বিরুদ্ধে)— তাও মেনে নেওয়া হলো। জাতীয় পরিষদে পূর্ব বাংলাকে তার জনসংখ্যার অনুপাতে আসনও দেওয়া হলো। সে সূত্রে তারা ৩০০ আসনের জাতীয় পরিষদে ১৬২ আসনের অধিকারী হলো আর নারীদের সংরক্ষিত ১৩টি আসনের মধ্যে পেল ৭টি। ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল আর এতে ফলাফল যা হলো তা ছিল এরকম:
শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ দু’টি ছাড়া পূর্ব বাংলার সব আসনে জয় পেল। এটা নিশ্চিতভাবেই ছিল সম্ভাব্য সর্বোচ্চ পর্যায়ের গণরায়। এটা আওয়ামী লীগের অনুসৃত কর্মসূচিকে সর্বোচ্চ স্তরের আইনি ভিত্তি দিল। দলটির নেতারা বিজয়ী হলেন এবং একই সঙ্গে প্রমাণিতও হলেন জনগণের কাছে। তারা কঠিনতর এক লড়াই উল্লসমুখর পরিমণ্ডলে জিতে গেলেন।
নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনের দিন থেকে ১২০ দিনের মধ্যে সংবিধানের একটি খসড়া তৈরি করার কথা ছিল। জেনারেল ইয়াহিয়া অধিবেশন আহ্বান করলেন ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ আর আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি কমিটি ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করে সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো।
যেহেতু পার্লামেন্টে দলটি সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, তাই সংবিধানের মূল নীতিগুলো নির্ধারণে তাদেরকে বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।
এসব ঘটনাপ্রবাহ সমগ্র পাকিস্তানে না হলেও কমপক্ষে পূর্ববঙ্গে, পাকিস্তানি শাসকচক্রের খবরদারির কার্যকর একটা যবনিকা টানতে পারতো। কিন্তু ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের উদ্ভোধনী অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলেন আর মুজিব-ভূট্টোর সঙ্গে অর্থহীন আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। জেনারেল সাহেব সহসাই গণতান্ত্রিক ফ্রন্টে বাঙালিদের কাছে তার পরাজয় মেনে নিলেন কিন্তু অন্য ফ্রন্টে তাদের চ্যালেঞ্জ করে বসলেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার একটি প্রদেশে যুদ্ধ ঘোষণা করলো।
এর মাধ্যমে মুক্তচিন্তার মানুষ যারা নিজেদের রায় প্রকাশে ছিলেন নির্ভীক, তাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানিদের তীব্র ঘৃণাত্মক কর্মকাণ্ডের অজস্র অগণন প্রমাণ তারা রেখে গেল। এসব ঘটনা থেকে আপনাদের সঙ্গে একটি শেয়ার করছি।
সেনা অভিযান দিন কয়েকের মধ্যেই তা একটি পরিপূর্ণ গৃহযুদ্ধে রূপ নিল যেহেতু বাঙালিরা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিল। ১৯৭০ সালে নির্বাচিত আইনসভা অধিবেশনে বসতে পারেনি। পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে এবং তার ১৬০ জন নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্যের মধ্যে বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিয়ে ৭৬ জনকে অযোগ্য ঘোষণা করে। এর ফলে ৩১৩ জনের জাতীয় পরিষদে ১৬৭ সদস্য নিয়ে নেতৃত্বের আসনে থাকা আওয়ামী লীগকে কেটে মাত্র ৮৪ সদস্যের শক্তিতে নামিয়ে আনা হলো।
এই সংখ্যাটা জাতীয় পরিষদে পাকিস্তান পিপল্স পার্টির (পিপিপি) ৮১ আসন (পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে পাওয়া) সংখ্যার কাছাকাছি। অর্থাৎ ব্যবস্থাটা এমন হলো যে— একটি বিভক্ত আর ঝুলন্ত পার্লামেন্ট ‘সর্বদাই জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে’।
যাহোক, বাস্তবে জেনারেল সাহেব বোকার স্বর্গে বাস করছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি তার এলএফও (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার) সংশোধন করেন পূর্ব বাংলার ‘খালি হওয়া’ আসনগুলোতে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে। কিন্তু ওই সময়টায় অবস্থা এমন পর্যায়ে ছিল যে পাকিস্তান সরকারের পক্ষে বাংলায় নির্বাচন অনুষ্ঠান ছিল অসম্ভব।
তবে ওই অরাজক আর হজবরল পরিস্থিতিতে ধর্মাশ্রয়ী দলগুলো যেন সুযোগ পেয়ে গেল। জামায়াতের নেতৃত্বে এ ধরনের ৬টি দল, ওই আসনগুলোতে যৌথ প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। বেআইনি এই নির্বাচনে অন্য কোনও দল অংশ নেবে না আর সে সুযোগে তাদের প্রার্থীরা বিনা বাধায় জয়ী হয়ে আসবে বুঝতে পেরে তারা এ পদক্ষেপ নেয়।
আর তাই, নভেম্বরের ১১ তারিখে নির্বাচন কমিশন ওই আসনগুলোর মধ্যে ৬৩টি আসনে একজন করে মাত্র প্রার্থী পেল। তারা সবাই বিনা প্রতিদ্বন্ধীতায় বিজয়ী বলে ঘোষিত হল।
এই আসনগুলোতে দলগত অবস্থান ছিল নিম্নরূপ:
জামায়াতে ইসলামী ১৫
পাকিস্তান ডেমেক্রেটিক পার্টি ১২
পাকিস্তান মুসলিম লীগ-কাউন্সিল ৭
নেজাম-এ-ইসলামী ৬
পাকিস্তান মুসলিম লীগ-কনভেনশন ৬
পাকিস্তান মুসলিম লীগ-কাইয়ুম ৫
পাকিস্তান পিপল্স পার্টি ৫
প্রথমদিকে পিপিপি উপ-নির্বাচনের বিরুদ্ধে সমালোচনামুখর হলেও পরে হরিলুটের মাল হিসেবে এসব আসনের লোভ সামলাতে পারেনি এবং এতে অংশ নেয়। ৬৩টি আসনের ভাগ্য নির্ধারিত হল এভাবে এবং নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিল বাকি আসনগুলোতে নির্বাচন হবে পরের মাসে অর্থাৎ ডিসেম্বরের ৭ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে।
কিন্তু এই রঙ্গমঞ্চে পর্দা পড়ে গেল পশ্চিম রণাঙ্গণে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ায়। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন বাদবাকি আসনগুলোর উপ-নির্বাচন স্থগিত করলো। ঢাকায় পাকিস্তান সেনাববাহিনীর আত্মসমর্পণের ৪ দিন পর অর্থাৎ ২০ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভূট্টো একইসঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত হলেন। জামায়াতের জীবনকালের সেরা নির্বাচনী বিজয়ের আনন্দে বিষাদ ঢেলে দিয়ে ২৩ ডিসেম্বর ভূট্টো (নভেম্বরে অনুষ্ঠিত) উপ-নির্বচনগুলো বাতিল বলে ঘোষণা করলেন।
তাহির মেহেদি: পাঞ্জাব লোক সুযোগ নামে একটি গবেষণা ও প্রচার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। প্রতিষ্ঠানটি গণতন্ত্র ও শাসন ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করে
ভাষান্তর: আহ্সান কবীর, ashan.akraza@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৭ ঘণ্টা, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১২