ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

ছবি বলবে বিজয়ের কথা: সাব্বির

শেরিফ আল সায়ার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:১১, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৩
ছবি বলবে বিজয়ের কথা: সাব্বির

সাব্বির ফেরদৌস সম্প্রতি ইউপিআই আন্তর্জাতিক আর্ট ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক পেয়েছেন। তবে এটি এ বছরের (২০১৩) প্রথম সাফল্য।

গেল বছর ২০১২ সালে সাব্বির ফেরদৌস ১১টি স্বর্ণপদক ও ১টি সিলভার পদক পাওয়ার গৌরব অর্জন করেন।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে কোনো বাংলাদেশি ফটোগ্রাফারের জন্য এটি সেরা সাফল্য। গেল বছরের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত সপ্তম এমিরাটস ফটোগ্রাফিক প্রতিযোগিতায় সেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করা। সেখানে পুরস্কার হিসেবে স্বর্ণপদক এবং ২০ হাজার দিরহামের চেক পান। বাংলাদেশের ফটোগ্রাফির বিভিন্ন দিক নিয়ে সাব্বির ফেরদৌসের সঙ্গে কথা হয়।

দীর্ঘ আড্ডার বিষয়গুলোর উপর এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

বাংলাদেশে ফটোগ্রাফি জায়গাটি কোথায়?
 
বাংলাদেশের ফটোগ্রাফির জায়গাটিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হচ্ছে জার্নালিস্টিক এবং আরেকটি হচ্ছে প্রফেশনাল বা অ্যামেচার যেটাই আপনি বলেন। সাংবাদিকতার ফটোগ্রাফি তো আপনি জানেন, যে কোনো ইভেন্টের ছবি আপনি তুলছেন। এবং খুব দ্রুততার সঙ্গে সবচেয়ে ভালো ছবিটি বের করে আনতে হবে। ভাবার কোনো সময় সেখানে নেই।

তবে অ্যামেচার ফটোগ্রাফিতে থাকে। কিন্তু ডিমান্ডের জায়গায় তো জার্নালিজম ফটোগ্রাফি এগিয়ে।

অ্যামেচার ফটোগ্রাফিতে শিল্প প্রকাশের যথেষ্ঠ সুযোগ থেকে যায়। একজন শিল্পী তার কাজটি নিয়ে ভাবার সময় পায়। তবে দুই ফটোগ্রাফিরিই ডিমান্ড আছে। পৃষ্ঠপোষকতার বিষয় এখানে সংযুক্ত। যেমন ওয়ার্ল্ড প্রেস সাংবাদিকতা ফটোগ্রাফির উপর যথেষ্ঠ গুরুত্ব দেয়। তা এ নিয়ে কাজও করছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শৈল্পিক কাজে পৃষ্ঠপোষকতা অনেকটাই পিছিয়ে আছে।

তার মানে শিল্পের ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতাই নেই।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বলেছি। বাংলাদেশে শৈল্পিক যে কোনো কাজের ক্ষেত্রেই পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া খুব কঠিন। কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শিল্পের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কাজ হয়। আর্টিস্টিক ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফটোগ্রাফিক আর্ট (এফআইএপি) সংস্থটি প্রায় ৩০-৪০ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে। তারা আর্ন্তজাতিকভাবে বহু ইভেন্ট করে। তারা মূলত আর্ট ফটোগ্রাফিকে প্রমোট করছে।

এফআইএপি সংস্থাটি বিশ্বব্যাপী তাদের নিজস্ব অর্থায়নে অনেক প্রতিযোগীতার আয়োজন করে থাকে। এ সংস্থাটিকে ফুটবলের ফিফার মতো বলা যায়। বিশ্বব্যাপী তাদের শাখা ছড়িয়ে আছে। ফটোগ্রাফির জন্য কাজ করছে।

তাহলে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম হয় না?

এফআইএপি’র প্রতিযোগীতা বাংলাদেশেও হয়েছে। তবে সবে একবার। বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি (বিপিএস) হচ্ছে এ আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। সুতরাং বিপিএসের নিজস্ব উদ্যোগ ছাড়া এফআইএপি’র কোনো কার্যক্রম বাংলাদেশে হবে না। কিন্তু বিপিএস কেনো উদ্যোগ নেয় না, সে আমি জানি না। তারা এতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৬ সাল থেকে এ প্রতিষ্ঠান চলছে। যাইহোক, এধরনের আন্তর্জাতিকমানের ইভেন্ট হলে বাংলাদেশের ফটোগ্রাফি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তো।

যে কোনো আন্তর্জাতিকমানের প্রতিযোগিতা আয়োজনের সুফল কোথায়?

আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা হলে আগ্রহীরাও অনেক তথ্য জানতে পারে। যেমন, আমি নিজেও জানতাম না কীভাবে এধরনের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হয়। শুধু তাই নয়, কারা ফটোগ্রাফি নিয়ে কাজ করছে কিংবা কি ধরনের কাজ করছে সে বিষয়গুলোও প্রতিযোগিতায় উঠে আসে।

আমার শুরুতে অনেক সমস্যা হয়েছে। যেমন, ২০০৭ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হয়। সেখানে অংশ নিতে এন্ট্রি ফি দিতে হবে। বাংলাদেশ থেকে টাকা পাঠানোর সহজ কোনো উপায় নেই। সে জন্য পরে বিদেশে অবস্থান করছে এমন বন্ধুর সাহায্য নিতে হয়েছে।

বাংলাদেশে যদি বছরে একবার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা হতো তবে অনেক সমস্যাই দূর হয়ে যেত।

এবার ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। কীভাবে ফটোগ্রাফির প্রতি আগ্রহ গড়ে ওঠে?

আমি প্রথম এক রোল ছবি তুলি ১৯৮৯ সালে। ঘটনাটা সিলেটের জাফলংয়ে। বাবার একটা ক্যামেরা ছিল। বাবা তখন ক্যামেরাটা দিয়ে বললেন, যাও ছবি তুলো। তখন একরোল ছবি তোলা হয়। বাবা অবশ্য আমাকে দেখিয়ে দিচ্ছিল যে, কীভাবে ছবি তুলতে হয়। তখনই প্রথম ছবি তোলার আগ্রহ শুরু হয়।

এছাড়া ছবি আঁকার প্রতি দূর্বলতা ছিল। ছবি আঁকতাম। তখন আমি ক্যাডেট কলেজে পড়ি। আমাদের মাঠটা ছিল বিশাল বড়। আমরা দেখতাম, সকাল বেলা সূর্য উঠছে, বিকেলে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। রাতের বেলা আকাশের তারা। এসব দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতাম। ভাবতাম এসময়গুলোকে লেন্সে কিভাবে ধরে রাখা যায়। তখন বাসা থেকে ফিল্মের রোল নিয়ে যেতাম। সেটা দিয়ে ভেবেচিন্তে অনেক হিসেব করে একটা একটা করে ছবি তুলতাম। এভাবেই আগ্রহ তৈরি হলো।

ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা শুরু হয় কবে থেকে?  

ডিজিটাল ক্যামেরা কিনেছি ২০০৫ সালে। তখন ছবি তোলার ধারণাই বদলে গেল। এটিতে একটা লাভ হলো ইচ্ছে মতো এক্সপেরিমেন্ট করা যায়। একটা নির্দিষ্ট ছকে বেঁধে রাখতে পারেনি। এরপর আমি ফ্লিকারের সঙ্গে যুক্ত হলাম। অনলাইন কমিউনিটিতে বাংলাদেশের তখন উপস্থিতি খুব কম ছিল। এটা ২০০৭ সালের দিকে ফ্লিকারে আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর ছবি আপ করে দিতাম। তখন থেকেই ডিজিটালের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়।

হাত পাকানোর জন্য তবে কি শুরুতে রোল ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা উচিত?

এটা খুব কঠিন প্রশ্ন। আমার ক্ষেত্রে মনে করি, ফিল্ম ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে হাত পেকেছে। কারণ, ফিল্ম নির্দিষ্ট ছিল। একটা ছবি তুলতে হলে অনেক ভাবনার প্রয়োজন ছিল। আইডিয়ার পূর্ণ প্রকাশ হতো। তারপর ডিজিটাল আসার পর ইচ্ছা মতো এক্সপেরিমেন্ট করতে পারি। তবে একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম। ছবি তোলাটাই হলো আসল।

তাহলে কেউ ফটোগ্রাফার হতে গেলে কি করতে হবে?

ছবি তুলে যেতে হবে। সময়কে ধরে রাখার চেষ্টা থাকতে হবে। উদাহরণ দেই, বাংলাদেশের ধর্মীয় কালচার ছিল সুন্নতে খাতনা। অথচ দেখেন এখন কয়টি পরিবারে আগের মতো উৎসবের ভেতর দিয়ে এ কাজটি করে? কিন্তু ঐসময় যারা ছবি তুলে রেখেছেন তারা কিন্তু অসাধারণ হারিয়ে যাওয়া একটি সময় ধরে রাখতে পেরেছেন।

ছবি মানেই সময় ধরে রাখা। ঐতিহ্য ধরে রাখা। আবার এখনই দেখেন, ঢাকার সব গাড়ির নম্বর প্লেট কালো। এটা এখন ডিজিটাল হওয়ার কারণে আস্তে আস্তে সাদা হয়ে যাচ্ছে। আগামী পাঁচ বছর পর ঢাকায় গাড়ির দিকে তাকালেই আপনি সাদা রঙটা দেখতে পাবেন। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছেন কালো। সময় বদলাচ্ছে। এই বদলে যাওয়া সময় ধরে রাখতে হলে ছবি তুলেই যেতে হবে।

বর্তমান প্রজন্মের ফটোগ্রাফি নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

বর্তমান প্রজন্মের হাতে ক্যামেরা চলে আসছে ঠিকই কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোনো প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা এখনও গড়ে ওঠেনি। দুই একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও তা পর্যাপ্ত নয়। এছাড়াও সেন্ট্রাল কোনো কিছুই নেই। সবকিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একসঙ্গে কাজ করার মতো কোনো সংগঠন সেভাবে গড়ে ওঠেনি। ধরুন, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে এমন দিক নির্দেশনা দেওয়ার মতো কেউই তো নেই।

এসব কারণে তরুণ প্রজন্ম খুব স্ক্যাটার্ড। তবে উদ্যোমের কমতি নেই। তরুণদের মধ্যে অসম্ভব প্রতিভা আছে। প্রতিভা কখনও প্রশিক্ষণের অভাবে বসে থাকে না। সে এগিয়ে যাবে তার নিজস্ব গতিতে।

ক্যারিয়ার হিসেবে ফটোগ্রাফির জায়গা কি গড়ে উঠেছে?

খুব চ্যালেঞ্জিং। তবে বাংলাদেশে ধীরে ধীরে ক্যারিয়ার হিসেবে গড়ে উঠছে। এখন তো বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে ফটোগ্রাফি করে অনেকেই ক্যারিয়ার গড়ে নিচ্ছে। তবে শিল্পের দিক থেকে বাংলাদেশে ক্যারিয়ার অনেক কঠিন। তবে ভবিষ্যতে প্রডাক্ট ফটোগ্রাফি একটা বড় জায়গা তৈরি করে নেবে। তখন প্রডাক্ট ফটোগ্রাফার দরকার হবে।

এছাড়া পৃষ্ঠপোষকতার অভাবও আছে। আমি যদি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যেতে চাই তখন ফান্ড পাবো কোথায়? ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো এবিষয়ে খুব যে আগ্রহ দেখায় তা নয়। তাদের বোঝানো অনেক কঠিন। এ জায়গাটা তৈরি করতে হবে। শুধু যে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া তা নয়; বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, ওয়ার্কশপ, প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে এগুবে কিভাবে?  

আবার মিডিয়া সাপোর্টও দরকার। দেখুন, আজ পর্যন্ত কোনো মিডিয়াতে দেখিনি ফটোগ্রাফির বিভিন্ন সংবাদ নিয়ে আলাদা আয়োজন করতে। হয়ত বিচ্ছিন্নভাবে নিউজ আসে। কিন্তু এ জায়গাটা তো এখন বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সুতরাং মিডিয়ারও এখন পাশে এসে দাঁড়ানো উচিত। বাংলাদেশের অনেক তরুণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাচ্ছেন। কিন্তু মিডিয়াতে আসছে না। বাংলাদেশের মানুষই জানতে পারছে না ফটোগ্রাফিতে কি পরিমাণ এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।  

ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা কি?

আবুধাবিতে যখন আমি পুরস্কার পাই তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সেখানে আসেনি। অথচ যারা দ্বিতীয়, তৃতীয় হয়েছেন তাদের দেশের রাষ্ট্রদূতরা বড় করে অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেছেন। আর আমি গোল্ড মেডেল পেলাম। সরকারি পর্যায়ে একটা মানুষও সেখানে আমার কোনো খোঁজ নেননি। খোঁজ নিয়েছে ওই ফাইভস্টার হোটেলের সাধারণ কর্মচারিরা। সেখানে অসংখ্য বাঙালি শ্রমিকরা আছেন। তারা দৌড়ে এসেছেন, জড়িয়ে ধরেছেন। সবাইকে বলছেন, এ ছেলে আমার দেশের। এ অনুভূতিটাই আসল। মানুষের ভালোবাসাটই আসল।

আমি স্বপ্ন দেখি আমার ছবি দেশের মানুষের স্বপ্নের কথা বলবে, বিজয়ের কথা বলবে। আমাদের দেশের বন্ধনের গল্প বলবে। যে গল্প হবে গর্বের। এভাবেই নিজের দেশের নাম সুউচ্চে পৌঁছে দিয়ে মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে চাই।

সাব্বির ফেরদৌসের ফেসবুক লিংক: https://www.facebook.com/ShabbirFerdousPhoto

আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সময়সূচি জানতে পারবেন: http://www.entryforms-fiap.net/2013.html

বাংলাদেশ সময়: ১৫০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।