প্রতি অঙ্গ কাঁদে তব প্রতি অঙ্গ - তরে
প্রাণের মিলন মাগে দেহের মিলন
হৃদয়ে আচ্ছন্ন দেহ হৃদয়ের ভরে
মুরছি পড়িতে চায় তব দেহ -` পরে
তোমার নয়ন পানে ধাইছে নয়ন
অধর মরিতে চায় তোমার অধরে।
দেহমিলন নামে চতুষ্পদী কবিতার শুরুতে কবিগুরু উপরের যে চরণগুলো লিখেছেন, তা যেন প্রেম ভালবাসার একেবারে মোদ্দা কথা -‘অধর মরিতে চায় তোমার অধরে’! সত্যই তো।
তাই ভালবাসার কথা বললে অবধারিতভাবেই চুমুর কথা এসে পড়বে। ভালবাসা প্রকাশের আদি এবং অকৃত্রিম মাধ্যমটির নাম যে চুম্বন - সে বিষয়ে সম্ভবত কেউই দ্বিমত করবেন না। কাজেই কেন কবিগুরুর কথামতো আমাদের অধর মরিতে চায় অন্যের অধরে - তার পেছনের বিজ্ঞানটি না জানলে আমাদের চলছে না। গতবছর (২০১২ সালে) আমি একটা বই লিখেছিলাম ‘ভালবাসা কারে কয়’ নামে [1]। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল শুদ্ধস্বর থেকে। ডারউইনীয় বিবর্তন এবং বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা বাংলায় সম্ভবত প্রথম বই ছিল এটি। বইটিতে চুম্বনের বিজ্ঞান নিয়েও অনেক প্রাসঙ্গিক তথ্য ছিল, যা হয়তো পাঠকদের চিন্তার খোরাক যোগাবে।
বাঙালি, আফগানি, জাপানি, মালয় থেকে শুরু করে পশ্চিমা সংস্কৃতি- সব জায়গাতেই প্রেমের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে চুম্বন পাওয়া যাবে। সংস্কৃতি ভেদে চুম্বনের তারতম্য আর ভেদাভেদ আছে ঠিকই, তবে কোথাও প্রেমিক প্রেমিকাকে কিংবা প্রেমিকা প্রেমিককে চুমু খায় গোপনে, কোথাও বা প্রকাশ্যে, কারো চুম্বন শীতল, কারোটা বা উদগ্র, কেউ ঘাড় কাত করে চুমু খায় কেউ বা খায় মাথা সোজা রেখে। কিন্তু চুম্বন আছেই - মানব সভ্যতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে [2]। তাই চুম্বনের বিবর্তনীয় উৎসটি আমাদের জানা চাই।
আর শুধু মানুষই নয়, অনেকে জেনে হয়তো অবাক হবেন, চুমুর অস্তিত্ব রয়েছে অন্যান্য অনেক প্রাণীর মধ্যেই[3]। ইঁদুর, কুকুর, বিড়াল, পাখি থেকে শুরু করে শিম্পাঞ্জি, বনোবোসহ বহু প্রাণীর মধ্যেই চুম্বনের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা গেছে। এ সমস্ত প্রাণীদের কেউ বা চুমু খায় খাদ্য বিনিময় থেকে শুরু করে আদর সোহাগ বিনিময় এমনকি ঝগড়া-ফ্যাসাদ মেটাতেও। বিজ্ঞানী বিজ্ঞানী ফ্র্যান্স ডি ওয়াল তার প্রাইমেট সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণায় দেখিয়েছেন চুম্বনের ব্যাপারটা মানব সমাজেরই কেবল একচেটিয়া নয়, আমাদের অন্য সকল জ্ঞাতিভাই প্রাইমেটদের মধ্যেও তা প্রবলভাবেই দৃশ্যমান।

চিত্র: চুম্বনের ব্যাপারটা মানব সমাজেরই কেবল একচেটিয়া নয়, প্রাইমেট এবং নন প্রাইমেট অনেক প্রাণীর মধ্যেই চুম্বনের অস্তিত্ব দেখা যায়। উপরের ছবিতে প্রেইরি কুকুর নামে খ্যাত একধরনের ইঁদুরের মধ্যকার চুম্বন আর নীচের ছবিতে দুটি শিম্পাঞ্জির মধ্যকার চুম্বন দেখানো হয়েছে।
কেউ কি কবুতরের চুমু খাওয়া দেখেছেন? ওরা ঘরের চালে একেবারে উপরে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে ঠোঁট আংটার মত করে আটকিয়ে দেয়। তারপরে বিশেষ ছন্দে উঠা নামা করে মিনিট খানেক। বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলে একে বলে “নালি ভাঙ্গা”। তার বলে, কবুতর “নালি ভাঙ্গছে। বাচ্চা হবে”[4]। কিসিং গোরামি নামে এক ধরনের মাছ আছে, যাদের মধ্যেও চুম্বন ব্যাপারটা বেশ প্রচলিত। যারা অ্যাকুরিয়ামে গোরামি মাছ পালেন, তারা প্রায়শই এদের চুম্বনলীলা দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেন ।

চিত্র: যারা অ্যাকুরিয়ামে গোরামি মাছ পালেন, তারা প্রায়শই এধরনের চুম্বনলীলা দেখতে পান। এই আচরণের জন্য এধরনের মাছদের ‘কিসিং গোরামি’নামে ডাকা হয়।
তবে কিসিং গোরামিদের চুম্বন আসলে ‘সত্যিকার’চুম্বন নয়। এদের চুম্বন আসলে এক ধরণের দ্বন্দ্বযুদ্ধের স্বরূপ, যার মাধ্যমে তারা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে; আর সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপারটা চুম্বন হিসেবে প্রতিভাত হয়। কুকুর, বিড়াল এবং পাখিদের মধ্যে মুখ দিয়ে অবলেহন এবং পরিচ্ছন্নতা নির্দেশক অনেক কিছু করতে দেখা যায়, যা অনেক সময়ই অনেকের কাছে ভুলভাবে চুম্বন বলে মনে হতে পারে। সেই দিক থেকে চিন্তা করলে মানুষের মধ্যে চুম্বনের ক্ষেত্র অনেকটাই ভিন্ন।
তাহলে মানব সমাজে চুম্বনের শুরুটা কোথায়, আর কীভাবে? এটা বলা আসলেই মুশকিল। তবে, ১৯৬০ সালে ইংরেজ প্রাণীবিজ্ঞানী ডেসমণ্ড মরিস প্রথম প্রস্তাব করেন যে, চুম্বন সম্ভবত উদ্ভূত হয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষ প্রাইমেট মায়েদের খাবার চিবানো আর সেই খাবার অপরিণত সন্তানকে খাওয়ানোর মাধ্যমে।
শিম্পাঞ্জি মায়েরা এখনো এভাবে সন্তানদের খাওয়ায়, আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যেও ব্যাপারটা ঠিক এভাবেই এবং এ কারণেই তৈরি হয়েছিল। মনে করা হয় খাদ্যস্বল্পতার সময়গুলোতে যখন সন্তানকে খাবার যোগাতে পারত না। তখন অসহায় সন্তানকে প্রবোধ দিতে এভাবে মুখ দিয়ে খাবার খাওয়ানোর ভান করে সান্ত্বনা দিত স্নেহবৎসল মায়েরা। এভাবেই একটা সময় চুম্বন মানব বিবর্তনের একটি অংশ হয়ে উঠে, এর পরিধি বৃদ্ধি পায় সন্তানের প্রতি ভালবাসা থেকে প্রেমিক প্রেমিকার রোমান্টিকতায়, যার বহুবিধ অভিব্যক্তি আমরা লক্ষ্য করি মানব সমাজের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে আনাচে কানাচে, নানাভাবে।

চিত্র: ফরাসি স্থপতি অগুস্ত রদ্যাঁর (Auguste Rodin) একটি বিখ্যাত স্থাপত্যকর্ম - The Kiss। আমি আর আমার স্ত্রী বন্যা প্রথমবার ২০০২ সালে প্যারিসে গিয়ে রডিনের এই অদ্ভুত সুন্দর স্থাপত্যকর্মটি দেখে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ!
তবে আজকের দিনের চিরচেনা তীব্র রোমান্টিক প্রেমের সঙ্গে চুম্বনের জৈববৈজ্ঞানিক তথা বিবর্তনীয় উৎস খুঁজতে গেলে আমাদের বের করতে হবে চুমু খাওয়ার এই মাধ্যমটি সম্পর্ক তৈরি এবং টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে কোনো ধরনের বাড়তি উপযোগিতা কখনো দিয়েছিলো কি না, এবং এখনো দেয় কি না।
এ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন। যেমন, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানী গর্ডন জি গ্যালোপের (Gordon G. Gallup) গবেষণা থেকে জানা গেছে, চুম্বন মানব সমাজে মেটিং সিলেকশন বা যৌনসঙ্গী নির্বাচনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে[5]। বিশেষ করে ‘প্রথম চুম্বন’ ব্যাপারটা রোমান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ সমীকরণ হিসেবে অনেকের জীবনেই উঠে আসে বলে মনে করা হয়। সাধারণত প্রথম প্রেম কিংবা প্রথম যৌনসঙ্গমের মতো প্রথম চুম্বনের ঘটনাও প্রায় সবাই হাজারো ঘটনার ভিড়ে মনের স্মৃতিকোঠায় সযত্নে জমিয়ে রাখে স্থায়ীভাবে। মহাকবি কায়কোবাদের একটা চমৎকার কবিতা আছে প্রথম চুম্বন নিয়ে -
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!
যবে তুমি মুক্ত কেশে
ফুলরাণী বেশে এসে,
করেছিলে মোরে প্রিয় স্নেহ-আলিঙ্গন!
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন?
প্রথম চুম্বন!
মানব জীবনে আহা শান্তি-প্রস্রবণ!
কত প্রেম কত আশা,
কত স্নেহ ভালবাসা,
বিরাজে তাহায়, সে যে অপার্থিব ধন!
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!
হায় সে চুম্বনে
কত সুখ দুঃখে কত অশ্রু বরিষণ!
কত হাসি, কত ব্যথা,
আকুলতা, ব্যাকুলতা,
প্রাণে প্রাণে কত কথা, কত সম্ভাষণ!
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!
সে চুম্বন, আলিঙ্গন, প্রেম-সম্ভাষণ,
অতৃপ্ত হৃদয় মূলে
ভীষণ ঝটিকা তুলে,
উন্মত্ততা, মাদকতা ভরা অনুক্ষণ,
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!
তবে কায়কোবাদ প্রথম প্রেমের মাহাত্ম্য নিয়ে যতই কাব্য করুন না কেন, প্রকৃত বাস্তবতা একটু অন্যরকম। বিশ্ববিদ্যালয়ের আণ্ডারগ্র্যাড ছাত্রদের উপর গবেষণা চালাতে গিয়ে গবেষকেরা দেখেন, অন্তত ৫৯ ভাগ ছাত্র এবং প্রায় ৬৬ ভাগ ছাত্রীরা স্বীকার করেছে যে তাদের জীবনে ‘প্রথম চুম্বন’ -এর পর পরেই সঙ্গীর প্রতি আগ্রহ রাতারাতি উবে গেছে। এমন নয় যে সেই সব খারাপ চুমু আসলেই খুব খারাপ ছিল। কিন্তু প্রথমবার চুম্বনের পরেই তাদের সবারই মনে হয়েছিলো কোথায় যেন মিলছে না - সামথিং ইজ নট রাইট!
কিন্তু কেন এমন হয়? সেটাই ব্যাখ্যা করছেন বিজ্ঞানীরা। আমরা যে আগের অংশে ফেরোমোন এবং জিনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম, দেহজ গন্ধের মাধ্যমে সেখানকার ভালবাসার সংকেতগুলো পৌঁছে যায় মস্তিষ্কে। ঠিক এমনটাই ঘটে চুম্বনের ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ চুমুর মাধ্যমে সঙ্গীর বংশগতিয় কম্প্যাটিবিলিটির খোঁজ পায় মানব মস্তিষ্ক। অর্থাৎ সোজা বাংলায়, সঠিক চুমু মানসিকভাবে সঠিক যৌনসঙ্গীকে খুঁজে নিতে সহায়তা করে । চুম্বনের পর যদি কায়কোবাদের মতো সেই ‘আহা শান্তি-প্রস্রবণ’ কিংবা ‘ভীষণ ঝটিকা তুলে, উন্মত্ততা, মাদকতা ভরা অনুক্ষণ’ আসে আপনার কাছে তাহলে বুঝতে হবে, আপনার মস্তিষ্ক ইঙ্গিত করছে আপনার সঙ্গী বংশগতিয় ভাবে আপনার জন্য সঠিক। আপনার জৈবিক দেহ আপনার সঙ্গীর দ্বারা নিরুপদ্রুপভাবে গর্ভধারণ করার জন্য নির্বাচিত হয়েছে! আর যদি চুম্বনের পর মনে হয় ‘কোথায় যেন মিলছে না’তাহলে বুঝতে হবে যে, আপনার সঙ্গীর MHC জিনের বিন্যাস আপনার জন্য কম্পিটেবল নয়।
তবে চুম্বনের রসায়নে নারী পুরুষে কিছুটা পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অধ্যাপক গ্যালোপ এবং তার সহকর্মীরা ১০৪১ জন কলেজ ছাত্র-ছাত্রীর উপর গবেষণা চালান। তাদের গবেষণা থেকে পাওয়া গেছে, তীব্র চুম্বন পুরুষদের জন্য আবির্ভূত হয় যৌনসম্পর্ক সূচিত করার পরবর্তী ধাপ হিসেবে। কিন্তু অন্য দিকে মেয়েরা চুম্বনকে গ্রহণ করে সম্পর্কের মানসিক উন্নয়নের একটি সুস্থিত পর্যায় হিসেবে [6]।
গ্যালপের গবেষণায় আরো দেখা গেছে চুম্বনের ব্যাপারটা ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতিভাত হয়। মেয়েদের কাছে ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণই শুধু নয়, অধিকাংশ মেয়েরা চুম্বন ছাড়া এমনকি সঙ্গীর সাথে যৌনসম্ভোগে অস্বীকৃত হয়। কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এতখানি প্রকট নয়। ছেলেদের কাছে একটা সময় পর চুমু খাওয়া না খাওয়া তেমন বড় হয়ে উঠে না- চুমু টুমু না খেয়ে হলেও কোন ‘আকর্ষণীয়’ মেয়ের সাথে যৌনসম্ভোগ করতে পারলে - ছেলেদের জন্য তাতেই সই! সমীক্ষায় দেখা গেছে কেউ ‘গুড কিসার’ না হওয়া সত্ত্বেও মেয়েদের চেয়ে অধিক সংখ্যক ছেলেরা তার সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়।
মেয়েদের জন্য চুম্বন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠার পেছনে কিছু বিবর্তনীয় কারণ রয়েছে বলে মনে করা হয়। বিবর্তনের পথিকৃৎ চার্লস ডারউইন তার যৌনতার নির্বাচন তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে খেয়াল করেছিলেন যে, প্রকৃতিতে প্রায় সর্বত্রই মেয়েরা সঙ্গী নির্বাচনের ব্যাপারে খুব বেশি হিসেবী, সাবধানী আর খুঁতখুঁতে হয়ে থাকে। এই ব্যাপারটি জীববিজ্ঞানে পরিচিত ‘নারী অভিরুচি’ (female choice) হিসেবে। ডারউইনের সময়ে ডারউইন ব্যাপারটি পর্যবেক্ষণ করলেও এই নারী অভিরুচির পেছনের কারণ সম্পর্কে তিনি কিংবা তার সমসাময়িক কেউ ভালভাবে অবহিত ছিলেন না। কিন্তু পরবর্তী কালের জীববিজ্ঞানী এবং বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণায় এর পেছনের কারণটি আরো স্পষ্টভাবে বোঝা যেতে শুরু করে। বিশেষত বিখ্যাত সামাজিক জীববিজ্ঞানী রবার্ট ট্রিভার্সের ১৯৭২ সালের গবেষণা এ ব্যাপারে একটি মাইলফলক[7]।
ট্রিভার্স তার গবেষণায় দেখান যে, প্রকৃতিতে (বিশেষত স্তন্যপায়ী জীবের ক্ষেত্রে) সন্তানের জন্ম এবং লালন পালনের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীরাই বেশি শক্তি বিনিয়োগ করে। গর্ভধারণ, সন্তানের জন্ম দেয়া, স্তন্যপান করানো সহ বহু কিছুতে মেয়েদেরকেই সার্বিকভাবে জড়িত হতে হয় বলে মেয়েদের তুলনামূলক ভাবে অধিকতর বেশি শক্তি খরচ করতে হয়। ভবিষ্যৎ জিন বা পরবর্তী প্রজন্ম রক্ষায় মেয়েদের এই অতিরিক্ত বেশি শক্তি খরচের ব্যাপারটা স্তন্যপায়ী সকল জীবদের জন্যই কমবেশি প্রযোজ্য। জীববিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে ‘অভিভাবকীয় বিনিয়োগ’ (parental investment)। মানুষও একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী। একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হবার পরেও নির্দ্বিধায় বলা যায় মেয়েরাই অভিভাবকীয় বিনিয়োগের সিংহভাগে জড়িত থাকে। যেহেতু পুরুষদের তুলনায় নারীদের অভিভাবকীয় বিনিয়োগের সিংহভাগে জড়িত থাকতে হয়, তারা যৌনসঙ্গী নির্বাচনের ব্যাপারে হয়ে উঠে অধিকতর হিসেবী এবং সাবধানী। বিবর্তনীয় পথ পরিক্রমায় মেয়েরা সঙ্গী নির্বাচনের ব্যাপারে অধিকতর সাবধানী হতে বাধ্য হয়েছে, কারণ অসতর্কভাবে দুষ্ট-সঙ্গী নির্বাচন করলে অযাচিত গর্ভধারণ সংক্রান্ত ঝুট-ঝামেলা পোহাতে হয় নারীকেই। ডেভিড বাস তার ‘Human Mating Strategies’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে সেজন্যই লিখেছেন [8]
‘বিবর্তনীয় যাত্রাপথে যে সকল মেয়েরা হিসেবী কিংবা সাবধানী ছিল না। তারা খুব কমই প্রজনন গত সফলতা (reproductive success)অর্জন করতে পেরেছে। কিন্তু যারা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শয্যাসঙ্গি নির্বাচন করতে পেরেছে, যেমন - যৌনসঙ্গী নির্বাচনের সময় গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করেছে তার সঙ্গী সঙ্গমের পরই পালিয়ে না গিয়ে তার সাথেই থাকবে কিনা, বাবা হিসেবে তার ভবিষ্যৎ সন্তানের দেখভাল করবে কি না, সন্তান এবং পরিবারের পরিচর্যায় বাড়তি বিনিয়োগ করবে কি না ইত্যাদি- সে সমস্ত সতর্ক মেয়েরাই সফলভাবে প্রজনন গত উপযোগিতা উপভোগ করতে পেরেছে। কাজেই ট্রিভার্সের দৃষ্টিকোণ থেকে জীবজগতে প্রজাতির প্রজননগত সাফল্য এবং সফলভাবে প্রজন্ম টিকিয়ে রাখার মূলে রয়েছে সেই প্রজাতির নারীদের সতর্ক সঙ্গীনির্বাচনী অভিরুচি (careful mate choice)’।
কাজেই যৌনসঙ্গীর ব্যাপারে নারীদের সতর্ক থাকতে হয়, কারণ ভুল সঙ্গীকে নির্বাচনের মাশুল হতে পারে ভয়াবহ। অন্তত একজন নারীর জন্য চুম্বন হয়ে উঠে সঙ্গী বাছাইয়ের একটি অবচেতন প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে সে নির্ণয় করতে চেষ্টা করে তার সঙ্গী তার ভবিষ্যৎ সন্তানের অভিভাবকীয় বিনিয়োগে অবদান রাখবে কিনা কিংবা তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ (committed) কিনা ইত্যাদি[9]। আর আগেই বলা হয়েছে, চুমুর মাধ্যমে MHCজিনের মধ্যকার ভালবাসার সংকেতগুলো পৌঁছে যায় মস্তিষ্কে। পুরুষের লালাগ্রন্থিতে যে সমস্ত যৌন হরমোনের উপস্থিতি থাকে, সেটার উপাত্তই চুমু বিশ্লেষণের জন্য বয়ে নিয়ে যায় মস্তিষ্কে।
চুম্বনের রসায়নে নারী পুরুষে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও একটি বিষয়ে মিল পাওয়া গেছে। চুম্বন মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে - নারী পুরুষ উভয়েরই। মনোবিজ্ঞানী উইন্ডি হিল এবং তার ছাত্রী কেরি উইলসনের গবেষণা থেকে জানা গেছে চুম্বনের পরে দেহের কর্টিসল (cortisol) হরমোন, যার পরিমাণ মানসিক চাপের মধ্যে থাকলে বৃদ্ধি পায় বলে মনে করা হয়, তার স্তর লক্ষ্যণীয়ভাবে কমে আসে। এর থেকে বোঝা যায় যে, রোমান্টিক চুম্বন আমাদের মানসিকভাবে চাপমুক্ত থাকতে সহায়তা করে।
আমরা জানি, এবারের ভ্যালেন্টইন্স ডে অন্যান্য বারের মতো নয়। এ বছরের ভালবাসা দিবস আক্ষরিক অর্থেই যেন অনন্য। শাহবাগ চত্বরে কাদের মোল্লাসহ সকল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দাবীতে উত্তাল হয়ে উঠেছে তরুণ প্রজন্ম। বিদ্রোহের আগুন প্রজ্বলিত তরুণ তরুণীদের বুকে বোধ হয় একটু বেশিই অনুভূত হবে ভালবাসার আগুন। প্রতিভাত হবে তাদের চোখের চাহনি, শরীরী ভাষা আর গোলাপ বিনিময়ে। তাদের নীল খামে হয়তো থাকবে লিপস্টিকের হাল্কা দাগ। মুঠোফোনের বার্তা, ই-মেইল কিংবা ফেসবুক ভরে উঠবে প্রেম-কথার কিশলয়ে। তারা হয়তো সুমনের গানের মতো করেই গাইবে -
ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ব্যারিকেড কর প্রেমের পদ্যটাই
বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি শুধু তোমাকেই চাই।
তথ্যসূত্র:
[1] অভিজিৎ রায়, ভালবাসা কারে কয়, শুদ্ধস্বর, ২০১২।
[2] অবশ্য চুম্বন ব্যপারাটি সংস্কৃতি নির্বিশেষে সার্বজনীন (কালচারাল ইউনিভার্সাল) কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কিছু গবেষক দেখেছেন যে মানব সমাজের সব জায়গায় চুম্বনের প্রচলন নেই। ডাচ বিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার নাইরোপ তার একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন ফিনিশ একটি গোত্রে একসাথে নগ্ন হয়ে স্নান করার প্রচলন আছে, কিন্তু চুম্বনের নেই। অনেক জায়গায় চুম্বনকে ঘৃনিত প্রথা বলেও মনে করা হয়। কিন্তু এই স্বল্প কয়েকটি সংস্কৃতি বাদ দিলে মানব সমাজের মোটামুটি সবাই চুম্বন ব্যাপারটার সাথে পরিচিত।
[3] "How animals kiss and make up". BBC News. October 13, 2003.
[4] মুক্তমনায় আমার ‘সখি, ভালবাসা কারে ক্য, তৃতীয় পর্বে (চুম্বনের বিজ্ঞান) ড. নৃপেন সরকারের প্রাসঙ্গিক মন্তব্য।
[5] Susan M. Hughes, Marissa A. Harrison and Gordon G. Gallup, Sex Differences in Romantic Kissing Among College Students: An Evolutionary Perspective, Evolutionary Psychology, 2007. 5(3): 612-631
[6] Chip Walter, Affairs of the Lips: Why We Kiss, Scientific American Mind, February 2008
[7] R.L. Trivers, Parental investment and sexual selection, In B. Campbell (Ed.), Sexual selection and the descent of man: 1871-1971 (pp. 136-179). Chicago: Aldine, 1972
[8] David Buss, Human Mating Strategies. Samfundsokonomen, 4, 47-58, 2002.
[9] Chip Walter, Affairs of the Lips: Why We Kiss, Scientific American Mind, February 2008
লেখক : ড. অভিজিৎ রায়, আমেরিকা প্রবাসী গবেষক, ব্লগার এবং মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। ‘ভালবাসা কারে কয়’সহ সাতটি আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শন ভিত্তিক বইয়ের লেখক।
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর