ঢাকা: বেশ কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে ‘রিকশাওয়ালাদের লাগামহীন ভাড়া আদায়’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন পড়েছিলাম। সংবাদটিতে বিভিন্নভাবে দেখানো হয়েছে রিকশাওয়ালারা বেপরোয়াভাবে তাদের রিকশা ভাড়া আদায় করছে।
এটা শুধু ঐ রিপোর্টার নয় রিকশায় চড়া সকল যাত্রীরই এ ধরনের অভিযোগ।
আমাদের এ নগরে রিকশা আরোহীদের বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত শ্রেণির। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে রয়েছে উঠতি বুর্জোয়া, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত। এছাড়াও শ্রমিক শ্রেণি এবং ধনিক শ্রেণির লোকেরাও রিকশায় ওঠে। তবে সেটা সংখ্যায় কম।
আমাদের সমাজে রিকশাওয়ালারা শ্রমিক শ্রেণির লোক। যেখানে একটি ইঞ্জিনবিহীন ৩ চাকার গাড়িকে দৈহিক শ্রম দিয়ে একজন রিকশাওয়ালা টেনে নিয়ে যান। অনেক সময় দেখেছি প্রচণ্ড রোদে যখন ঘামে রিকশাওয়ালার গায়ের গেঞ্জি ভিজে গেছে তখন আমি ২০ টাকা দিয়ে তার শ্রম কিনে শাহবাগ থেকে নীলক্ষেত গিয়েছি। হ্যা কিছুদিন আগে আমি এ দূরত্বের ভাড়া দিতাম ১০ টাকা।
যারা রিকশাওয়ালাদের ভাড়া নিয়ে কথা বলছেন, তারা কি এ শ্রমের মূল্য নির্ধারণ করতে চাচ্ছেন?
দৈহিক শ্রমের মূল্য নির্ধারণ হয় না। কারণ রোদে একজন শ্রমিকের যে কষ্ট হয়, ছায়ায় তা হয় না, আবার বৃষ্টিতেও কষ্ট হয়। আবার এমনও হতে পারে একজন বৃদ্ধ রিকশাওয়ালাকে তরুণ রিকশাওয়ালার চেয়ে বেশি শ্রম দিতে হচ্ছে। তরুণ যদি ১৫ টাকা ভাড়া চায়, বৃদ্ধের ভাড়া হবে ২০ টাকা। এ মূল্য আমরা কয়জন দিচ্ছি?
রিকশাওয়ালার বিপ্লব ..
আমাদের কৃষি প্রধান দেশে এখন কৃষকরা জিম্মি তাদের উৎপাদিত পণ্যে মূল্যের কাছে। তাদের শ্রম মূল্য নির্ধারণ করে ধনীরা। নানান ধরনের কৃষি যন্ত্রপাতি, বীজ, সার এসে কৃষকের দৈহিক শ্রমের মূল্য কমিয়ে দিয়েছে। এরপরও নিম্নবর্গের কৃষককে আরো বেশি শোষণ করার জন্যে প্রয়োজনে বিদেশ থেকে কৃষিপণ্য নিয়ে আনে তারা। ধনীর বাজারের টার্গেট দেশের মধ্যবিত্ত এ পণ্য ক্রয় করে। অসহায় হয়ে পড়েছে কৃষক। দ্রব্যমূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধিতে তার কোন ভূমিকা নেই।
বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানি আর উন্নয়ন সংস্থার ‘সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্বে’র নামে গ্রাম্য বাজারগুলোকে আধুনিক করেছে। প্রন্তিক পর্যায়ের কৃষক আর তার পণ্য নিয়ে সে বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না। ইজারা দেওয়া গ্রামীণ বাজারের সুবিধা লুটছে মধ্যসত্বভোগীরা।
এদিক থেকে রিকশাওয়ালারা রয়েছে সুবিধাজনক জায়গায়। তাদের শ্রমকে এখনো পুরোপুরি কিনতে পারেনি বুর্জোয়ারা। কারণ ১৬ কোটি লোকের এ দেশে পাবলিক পরিবহনের দ্বায়িত্ব নেয়া তাদের পক্ষে কঠিন। আবার রিকশার বিপরীতে ইঞ্জিনচালিত যে যানগুলো তারা আমদানি করেছে সেগুলোও মধ্যবিত্তর জন্যে সুলভে চালু হয়নি।
সমাজতন্ত্র কায়েম হোক আর না হোক শ্রেণি সংগ্রামের যে কথা মার্কস এবং লেনিন বলেছেন, তা কিন্তু এখনো চলছে। গরীব পারুক আর না পারুক বুর্জোয়া কিন্তু শোষণ করেই যাচ্ছে।
এখন শ্রেণি সংগ্রামের এ পর্যায়ে দিনমজুর রিকশাওয়ালা দৈহিক শ্রমের ভাড়া বৃদ্ধির মাধ্যমে বিপ্লব করছে বুর্জোয়ার বিরুদ্ধে। কারণ সব কিনে নিলেও এখনো তার শরীর কিনে নিতে পারেনি।
রিকশাওয়ালাদের ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে আমরা কথা বলি। কিন্তু তাদের কয়জনের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে! ভালো করে ভেবে দেখুন, বর্তমান বুর্জোয়াদের ফাঁদে পড়া নিত্যপ্রয়োজণীয় দ্রব্যের যে মূল্য বৃদ্ধি সেখানে তার সংগ্রাম কতটুকু! তাকেও প্রান্তিক শ্রেনির শ্রমজীবী বলাই যায়।
রিকশাওয়ালার কাছে অস্ত্র নেই। কিন্তু বুর্জোয়া পরিচালিত রাষ্ট্রে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের নিরাপত্তকর্মীরা আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত তার মনিবকে রক্ষায়। ছোট জাতের বিচার করা আর নিজেদের মনিবদের প্রয়োজনে ব্যবহার হয় তারা।
কিন্তু গরিবের সন্তান মিলিটারি বা পুলিশ দিয়ে গরিব ঠেকানো সবসময় নিরাপদ নয়। লাঠি ঘুরিয়ে ধরার সম্ভাবনা থাকে। হয়তো এরকমও দিনও খুব দূরে নয়।
এখন এসব পোষা নিরাপত্তা বাহিনীর আধুনিক সমরাস্ত্রের সঙ্গে আর লাঠি দিয়ে রিকশাওয়ালার প্রতিবাদ সম্ভব নয়। বাজার পরিস্থিতিতে নিজের শ্রমকে পুঁজি করে যে ভাড়া দাবি করছে তারা, হয়তো অবেচতন মনেই বিপ্লবের ছোঁয়া দিচ্ছে তারা।
রিকশাওয়ালার বিপ্লবের কথায় আসি। কিন্তু আগের মতোই সে বিপ্লবের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এ শ্রেণি ইচ্ছা বা স্বপ্ন পোষণ করে একদিন বুর্জোয়া বা পেটিবুর্জোয়া হয়ে দাঁড়াবে।
রিকশাওয়ালার ভাড়া বিপ্লবের ধাক্কা যেয়ে লাগছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির গায়ে। বিপ্লবের জন্যে এখন দরকার মধ্যবিত্তের ধাক্কা দেয়া, যেটা বুর্জোয়াকে করবে ক্ষত বিক্ষত এবং মসনদ থেকে নামিয়ে আনবে জনগণের কাতারে। কিন্তু মেরুদণ্ডহীন মধ্যবিত্তের পক্ষে এ ধাক্কা দেয়া সম্ভব নয়। কারণ সে মাথা বিক্রি করে ফেলেছে।
শ্রমিক রিকশাওয়ালা যেমন প্রতিবাদ করে তার উপরের মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বলতে পারছে, ‘যাইলে যাবেন, না গেলে নাই’। কিন্তু ধনী শ্রেণির কাছে চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত নিজের মজুরি আদায়ে দৃঢ় অবস্থানে যেতে পারে না। মাথা নত থাকে ধনী মালিকের সামনে। আর মধ্যবিত্তের এ মেরুদণ্ডহীন আচরণে ব্যর্থ হয় রিকশাওয়ালার পার্টিবিহীন বিপ্লব।
এ ব্যর্থতার ফলে একদিন রিকশাওয়ালারা আর ভাড়া বেশি চাইতে পারবে না। কারণ বুর্জোয়া তার সুবিধার জন্যে এরই মধ্যে নগরের বেশিরভাগ রাস্তায় রিকশা নিষিদ্ধ করেছে। এখানেও ভুগছে মধ্যবিত্ত। তারপরও প্রতিবাদের শক্তি তার নেই।
যতদিন আমাদের নগরের এ মধ্যবিত্তরা শ্রমিকের কাতারে এসে দাঁড়াতে না পারবে আসলে ততদিন না শ্রমিকের মুক্তি হবে, না মধ্যবিত্তের মুক্তি হবে। এর মধ্যে মধ্যবিত্তের বড় একটি অংশ যেমন দারিদ্রের সর্বনিম্ন স্তরে যাবে, তেমনি ছোট একটি অংশ পেটি বুর্জোয়া হয়ে দাঁড়াবে।
পুনশ্চ: রিকশাওয়ালা বা শ্রমজীবীরা এক কাতারে দাঁড়াতে পারে। যেমন, ২০ টাকার কমে কেউই শাহবাগ থেকে নীলক্ষেত যাবে না যদি একজন না যায়। কারণ, এরা নিজেরা পরস্পরকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করে। আর মধ্যবিত্তের ‘আপনি’, ‘তুমি’, ‘তুই’ তাকে এক কাতারে দাঁড়াতে দেয় না।
বাংলাদেশ সময়: ২০২৪ ঘণ্টা, ০১ মে ২০১৩
এমএন/সম্পাদনা: এম জে ফেরদৌস, নিউজরুম এডিটর