ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

পঞ্চ নদীর দেশ পাঞ্জাব

লিয়াকত হোসেন খোকন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:৩৫, জুন ২, ২০১৩
পঞ্চ নদীর দেশ পাঞ্জাব

ঢাকা: পাঞ্জাব দিয়েই শক-ছন-পাঠান-মোগল এসেছিল ভারত ও বাংলায়। আর্যরাও আসে হিন্দুকুশ পেরিয়ে এই পাঞ্জাব হয়েই।

পাঞ্জাবের সিন্ধু নদের অববাহিকায় বিকাশ লাভ ঘটে আর্য সভ্যতার।

তখন এই ভূখণ্ডের নাম ছিল সপ্তসিন্ধু অর্থাৎ সাত সাগরের দেশ। কালে কালে সরস্বতী শুকিয়ে যায়। প্রমাদ শুনলেন পাঞ্জাবীরা। সিন্ধুও তাদের পছন্দ নয়। অর্থাৎ রইল বাকি পাঁচ-ঝিলাম, চেনার, রাতি, বিপাশা আর শতদ্রু। এই পঞ্চনদের দেশ পাঞ্জাব।
 
পাঞ্জাব নামটিও এসেছে ২টি ফারসি শব্দ থেকেÑ ‘পাঞ্জ’ মানে পাঁচ আর ‘আব’ অর্থাৎ জল থেকে। এক সময় পাঞ্জাব পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আলেকজান্ডারও পাঞ্জাবের ওপর দিয়ে এগিয়ে চলেন ভারত অভিযানে। আর মৌর্য সম্রাট চন্দ্র গুপ্ত ম্যাসিডোনিয়ার গভর্নরকে হারিয়ে দখল করে নেয় পাঞ্জাব।

১৫ এবং ১৬ শতকে পাঞ্জাবীরা শিখ রাজ্য গড়তে সক্ষম হয়। বারবার খ-িত হয়েছে পাঞ্জাব। তাই ওখানে নদীর সংখ্যা পাঁচ নেই। এদিকে পাঞ্জাবের ৩টি পাহাড়ি জেলা সরে গিয়ে গড়ে ওঠে হিমাচল প্রদেশ। পাঞ্জাবের রাজধানী শহর লাহোর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের দখলে চলে যায়।

৫ সংখ্যাটি পাঞ্জাবীদের কাছে অতি পবিত্র। যেমন-  চুল, দারু বা হাড়ের চিরুনি, পাগড়ি, স্টিল কংকন আর কৃপান। পুরুষদের বসন লুঙ্গি ও পাঞ্জাবী। আর মহিলাদের পরিধানে থাকে সালোয়ার-কামিজ।

পাঞ্জাবীদের আয়ুর গড় ৬৫ বছর। শৌর্য ও বীর্যেও এদের খ্যাতি আছে। তেমনি খ্যাতি আছে এদের কষ্ট সহিষ্ণুতায়। সবুজ বিপ্লবেও এরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। পাঞ্জাবীদের লোকনৃত্য আর লোকসংগীতের খ্যাতিও আছে।

পাঞ্জাবের দর্শনীয় স্থানগুলো হলো- চণ্ডীগড়, অমৃতসর, জালিয়ানওয়ালাবাগ, জলন্ধর, হোশিয়ারপুর, লুধিয়ানা, পাতিয়ালা, পাঠানকোট। এসব জায়গা এখন ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে। পাঞ্জাবের লাহোর, শিয়ালকোট এখন পাকিস্তানের অধীনে।

অমৃতসর : শিখধর্মাবলম্বীদের পবিত্র স্থান স্বর্ণমন্দিরের শহর অমৃতসর। পাকিস্তান সীমান্তবর্তী শহর। অমৃতসর থেকে ২৯ কিমি দূরে সীমান্ত চৌকি ওয়াগা হয়ে পথ গেছে লাহোরে।

ট্রেন যাচ্ছে সরাসরি অমৃতসর থেকে লাহোরে ৪ ঘণ্টায়।   আর বাসেও সীমান্ত চৌকি পর্যন্ত যাওয়া যায়। তবে ১৯৮৪ সালে হাঙ্গামার পর থেকে অনুমতি লাগে বিদেশিদের অমৃতসরসহ পাঞ্জাব ভ্রমণে।

গুরু নানক প্রবর্তিত ধর্মমতে আকৃষ্ট হয়ে বহু হিন্দু ও মুসলমান তাঁর শিষ্য অর্থাৎ শিখ ধর্ম গ্রহণ করেন। পাঞ্জাবী ভাষায় শিখ মানে শিষ্য। আর ১৫৭৭ সালে মোগল বাদশা আকবর শিখগুরু রামদাসকে অমৃতসরের স্থানটি দান করেন।

চতুর্থ গুরু রামদাস এইস্থানে পুষ্করিণী অমৃতসর অর্থাৎ অমৃতের সরোবর খনন করান। আর পঞ্চম গুরু অর্জুনদেব নির্মাণ করান পুষ্করিণীর মাঝে মন্দির। মন্দির ঘিরে পত্তন হয় নগরের। নাম হয় অমৃতসর।
১৭৬১ সালে মন্দির ধ্বংস হয়। ৩ বছর পরে শিখরা আবার পুন‍ঃনির্মাণ করে মন্দির। আর ১৮০৩  সালে মহারাজা রণজিৎ সিং মন্দিরের অর্ধভাগ মর্মর পাথর ও ওপরের অংশ তামার পাত বসিয়ে তার ওপর সোনার চাদরে মুড়ে দেন।

প্রায় ৪০০ কিলো সোনা ব্যবহৃত হয়েছে এতে। সেই থেকে স্বর্ণমন্দির নামে পরিচিত হচ্ছে। শিখরা বলে দরবার সাহেব বা হরমন্দির। মন্দিরে কোনো বিগ্রহ নেই। আছে চতুর্থ গুরু অজুর্নদেব সংগৃহীত শিখ ধর্মগ্রন্থ ‘গ্রন্থসাহেব’। গ্রন্থসাহেবই শিখদের একমাত্র উপাস্য। এতে গুরুজির সব উপদেশ সংগৃহীত আছে।

স্টেশন থেকে ১ কিমি দূরে ৪০০ বছরের পুরনো স্বর্ণমন্দির কমপ্লেক্স। টাঙ্গা/ সাইকেল রিকশায় পৌঁছানো যায়। বিশাল এলাকা নিয়ে মন্দির চত্বর। খালি পায়ে আর মাথা ঢেকে প্রবেশ করতে হয়। পাগড়ির রুমাল বাঁধতে পারেন। ধূমপান নিষিদ্ধ।

ক্লকটাওয়ার দিয়ে প্রবেশ। প্রাঙ্গণে পুষ্করিণীর মধ্যে মর্মর ও সোনার পাতে মোড়া হরমন্দির সাহেব। মন্দিরগাত্র কারকার্য খচিত। অপূর্ব এর ভাস্কর্য। পাথরের সেতু রয়েছে সরোবরের ওপর দিয়ে মন্দির পর্যন্ত। মূল মন্দিরের অভ্যন্তরে রয়েছে হস্তলিখিত গ্রন্থসাহেব।

সর্বক্ষণ ধর্মীয় সংগীতে পবিত্র ভক্তিরভাব বিরাজ করছে। তীর্থযাত্রীরা ভক্তিভরে গ্রন্থসাহেব প্রার্থনায় রত। আর রয়েছে সরোবরের ধারে অকাল তখত। শিখধর্মের পীঠস্থান। শিখদের সর্বোচ্চ সংস্থা এটি। ১৯৮৪ সালের অপারেশন ব্লু-স্টারে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর পরে করসেবার মাধ্যমে পুনর্নির্মিত হয়।

এখানে শিখ ও গুরুদের স্মৃতিচিহ্ন ও অস্ত্রাদি আছে। দেওয়ালি ও বৈশাখীর দিন উৎসব হয় অমৃতসরে। আর মন্দিরের উত্তর-পূর্ব নবম তলার আট কোনা বাবা আটলের স্তম্ভ। বাবা অটল ছিলেন ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দের পুত্র। গুরু নানকজির জীবনকাহিনি উৎকীর্ণ করা আছে। অদূরেই রামদাস সরাই।
 
জালিয়ানওয়ালাবাগ : স্বর্ণমন্দির থেকে ৫ মিনিটের হাঁটাপথ। ১৯১৯ সালের বৈশাখীর দিন (১৩ এপ্রিল) রাওলাট অ্যাক্টের প্রতিবাদে আহূত জনসভা হয় এই চারপাশ বাড়িঘরে ঘেরা ময়দান চত্বরে।

প্রবেশপথ ছিল অত্যন্ত সরু। সভায় হংসরাজ বক্তব্য  রাখছিলেন। আর সে সময় ব্রিটিশ জেনারেল ডায়ার ১০০ সেনাসহ উপস্থিত হয়ে প্রবেশপথের সংকীর্ণ গলির মুখে লুইসগান বসিয়ে গুলি চালিয়েছিল সমবেত নিরস্ত্র নর-নারীর ওপর। মুহূর্তে গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন অসংখ্য নর-নারী। তবু থামে না গুলি।
 
এতে ২ হাজার নিরস্ত্র মানুষ নিহত হন আর আহত হয় এর দ্বিগুণ। বাঁচার আশায় অনেকে আবার পাশের এক কূপে ঝাঁপিয়ে পড়ে । পরের দিন প্রায় ৪০টি মৃতদেহ ফুলে ভেসে ওঠে।

এখন সেই কূপটি রেলিং দিয়ে ঘিরে রাখা আছে। সেদিন সভ্য জগৎ ধিক্কার জানায় ব্রিটিশ অত্যাচারকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ রাজের দেওয়া নাইট উপাধি ত্যাগ করেন জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে।

পরবর্তীকালে নিহত লোকজনের স্মৃতির উদ্দেশে লাল পাথরের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। কুয়ো ও দেয়ালের গায়ে গুলির চিহ্ন আজও বর্তমান।

বৈশাখীর দিন প্রতি বছর সমবেত হন ভারতবাসী শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।
দুর্গিয়ানা মন্দির : স্বর্ণমন্দির থেকে ১৫ মিনিটের পথে টাঙ্গা/ রিকশায় পৌঁছানো যায় ১৬ শতকের মন্দিরে। অবস্থান এর পুরনো শহরে। জলাশয়-ঘেরা মন্দিরে। দেবতা দুর্গা মার দর্শন করে রেলস্টেশনের উত্তর-পূর্বে নতুন শহরে রামবাগ উদ্যান দেখে নিতে পারেন।

উদ্যানে মহারাজা রণজিৎ সিংয়ের প্রাসাদে মিউজিয়াম রয়েছে। বুধবার বন্ধ। আর উৎসাহীরা বাসে অমৃতসর থেকে ২২ কিমি দূরে তরণ-তারণ ঘুরে নিতে পারেন। তরণ-তারণে গুরুদ্বার ও জলাশয় আছে। আর গুরু নানকজির স্মৃতিধন্য ডেরাবাবা নানক অমৃতসর থেকে ৫৫ কিমি দূরে। মক্কা ভ্রমণের সময় উপহার পাওয়া চোল অর্থাৎ পোশাক প্রদর্শিত হচ্ছে এখানকার মন্দিরে। অমৃতসর ভ্রমণের উপযুক্ত সময় অক্টোবর থেকে মার্চ।

শীতে ভালোমতো শীতবস্ত্র চাই। রেলস্টেশনের বিপরীতে ট্যুরিস্ট অফিস পাবেন। পুরনো শহরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জের কাছে বাজার এলাকায় কম্বল, সোয়েটার বিবিধ পণ্য অপেক্ষাকৃত কম দামে পাওয়া যায়।
যানবাহন : কলকাতা (হাওড়া) থেকে ৩০০৫ অমৃতসর মেল ১৯ : ২০ মিনিটে ও ৩০৪৯ অমৃতসর এক্স ১৩: ০৫ মিনিটে ছেড়ে ধানবাদ-পাটনা-বারানসি-লখনউ-মোরাদাবাদ-লস্কর-আম্বালা-জলন্ধর হয়ে অমৃতসর পৌঁছায় ৯:২০/ ১১:১০ মিনিটে।

সময় লাগে কমবেশি ৩৯ ঘণ্টা। আর টাটানগর থেকে ৮১০১ এক্স ৮:৩০ মিনিটে ছেড়ে ডালটনগঞ্জ-এলাহাবাদ-কানপুর-তুল্লা-নয়াদিল্লি-আম্বালা হয়ে অমৃতসর পৌঁছায় ৫:৩০ মিনিটে।
নয়াদিল্লি থেকে ফ্লাইংমেল ১২:১৫ মিনিটে ছেড়ে অমৃতসর পৌঁছায় ৯:৩০ মিনিটে। এছাড়া মুম্বাই ও দাদার থেকে ছেড়ে আসা পশ্চিম  এক্স ও দাদার- অমৃতসর এক্স নয়াদিল্লি¬ পৌঁছে ১১:১৫/ ৮:০৫ মিনিটে। দিল্লি ছেড়ে অমৃতর পৌঁছে ১৯:২০ / ১৮:৩০ মিনিটে।

এছাড়া দিল্লি-অমৃতসর এক্স ১৪:২০, শানে পাঞ্জাব এক্স ৬: ৪৫ মিনিট ছাড়াও একাধিক ট্রেন দিল্লি¬ থেকে অমৃতসর যাচ্ছে নিয়মিত। সময় লাগে এসব ট্রেনে ৭/ ৮ ঘণ্টা।

এছাড়া আম্বালা, লুধিয়ানা, জলন্ধর, পাঠানকোট, ক্ষেমক্ষরণ, বাতালা থেকে মেল/ প্যাসেঞ্জার ট্রেন আসছে-যাচ্ছে ঘন ঘন। আর ট্রেন যোগাযোগ আছে অমৃতসরের সাথে ভূপাল, মুম্বাই পাটনা, বরোদাসহ নানা স্থানের।

বাস : স্টেশনের ১ কিমি দূরে বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস যাচ্ছে/ আসছে চণ্ডীগড় ৪ ঘণ্টায়, পাঠানকোট ৩ ঘণ্টায়, জম্মু ৫ ঘণ্টায়, ধরমশালা ৭ ঘণ্টায় ছাড়াও দিল্লি¬, মানালি, কাটরা, ডালহৌসি ছাড়াও রাজ্যের বিভিন্ন দিক থেকে। আর আইএ বিমান চলাচল করছে দিল্লি, শ্রীনগর, জম্মুর মধ্যে।   থাকার জন্য ২০০-৩০০ টাকায় ঘর পাওয়া যায়।
এছাড়া আরো আছে গুরুদ্বারায় থাকার ব্যবস্থা। শ্রীরামদাস সরাইয়ে বিনা খরচে থাকা যায়। এছাড়া অনেক হোটেল ও বেশ কয়েকটা ধর্মশালা পাবেন অমৃতসরে।

আর খাবার জন্য রেলের   রেস্তোরাঁ (স্টেশনে) ; স্টেশনের কাছে কুন্দন  বাবা, দা বাবা ও দুর্গিয়ানা মন্দিরের কাছে কেশর দি ধাবার সুনাম আছে।

জলন্ধর প্রাচীন শহর। একসময় রাজধানীও ছিল। তবে আজকের জলন্ধরের খ্যাতি তার খেলাধূলার সামগ্রীর জন্য। শিল্পনগরীও এই জলন্ধর। জামে মসজিদ, ইমাম নাসিরের সমাধি, নায়ক-গায়ক কুন্দন লাল সায়গলের সমাধিসৌধও রয়েছে এখানে।

পাঠানকোট সামরিক শহর। পাঠানকোট জলন্ধর রোডে ৫ কিমি দূরের দামতাল মন্দিরটির পর্যটক আকর্ষণও কম নয়। লুধিয়ানার অন্যতম আকর্ষণ রেশম, পশম ও সুতিবস্ত্রের পোশাকের জন্য।

১৪৮০ খ্রিষ্টাব্দে লোধি বংশের দুই শাহজাদার হাতে লুধিয়ানা শহরের পত্তন হয়েছিল। তবে পাঞ্জাবের অন্যতম আকর্ষণ মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর এবং সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের সমাধিসৌধ রয়েছে পাকিস্তানের পাঞ্জাবে।

বাংলাদেশ সময় : ১৬১৬ ঘণ্টা, জুন ০২, ২০১৩
সম্পাদনা: সুকুমার সরকার, আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।