বিজয়ের মাত্র দু দিন আগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা দেশের খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীদের তুলে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। যদিও মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে হানাদার বাহিনী ও রাজাকার-আলবদরদের অন্যতম প্রধান টার্গেট ছিল দেশের মেধাবী মানুষ।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। বাইরে কারফিউ। ঘড়ির কাঁটায় বেলা একটা। শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী হাতিরপুলের সেন্ট্রাল রোডে তার মায়ের বাড়িতে (দারুল আফিয়া) বসে বিবিসির খবর শুনছিলেন। এর একটু পরই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ দেশীয় দোসররা শহীদ মুনীর চৌধুরীকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর দেশ স্বাধীন হলো। বাংলাদেশ মুক্ত হলো। কিন্তু আজও ফিরে আসেনি শহীদ মুনীর চৌধুরী।
১৯৭১ সালে আসিফ মুনীরের বয়স ছিল মাত্র চার বছর। সে দিনের কথা কিংবা বাবার কোনো স্মৃতি তার মনে নেই। মা লিলি চৌধুরী ও চাচা শমশের চৌধুরীর কাছ থেকে শুনেছেন সে দিনের কথা।
আসিফ মুনীর বলেন, ‘খবরের এক পর্যায়ে বাবা পাশে বসে থাকা মা লিলি চৌধুরীকে উৎফুল্লচিত্তে বললেন, আর দেরি নেই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাক আর্মির পতন হবে। ’
কী সৌভাগ্য বাংলাদেশের! দুদিনের মাথায় পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করেছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু তা দেখে যেতে পারেননি বাংলা নাটকের প্রাণপুরুষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী।
লাশের সন্ধান না পেয়ে, এমনকি মৃত্যুরও কোনো খবর না পেয়ে পরিবারের সবার মনে একটা ক্ষীণ আশা স্বাধীনতার পরও অনেক বছর জেগে ছিল। স্বপ্ন দেখতেন হয়তো মুনীর চৌধুরী কোনো একদিন ফিরে আসবেন। কিন্তু তিনি আর ফিরেননি।
শহীদ মুনীর চৌধুরীর তিন ছেলে। বড় ছেলে আহমেদ মুনীর ভাষণ তখন যুদ্ধে (এখন দেশের বাইরে বসবাস করছেন)। মেজো আশফাক মুনীর মিশুক (এখন বেসরকারি চ্যানেল এটিএন নিউজের প্রধান) ও আসিফ মুনীর বাবা-মার সঙ্গে বাসায় ছিলেন।
আসিফ মুনীর মা ও চাচার উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলানিউজকে সেদিনের কথা বলে যান।
‘তিনি (মুনীর চৌধুরী) যখন দোতলা বাড়ির উপর তলায় বিবিসির খবর শোনা শেষ করে লিলি চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলছিলেন, ঠিক সে সময় নিচে কেউ একজন প্রধান ফটকে ধাক্কা দেয়। উপর থেকে নিচে নেমে গেটে যান চাচা শমশের চৌধুরী (মুনীর চৌধুরীর ভাই) ও ভাই আশফাক। গিয়ে দেখেন ছাইরঙের পোশাক পরে ১৯-২০ বছরের তিন যুবক দাঁড়িয়ে। তারা মুনীর চৌধুরীর খোঁজ করছেন। ’
‘ততক্ষণে মা লিলি চৌধুরী জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ান। দেখতে পান গেটের বাইরে একটি বাস দাঁড়ানো। জানালার কাঁচে কাদা মাখানো, ছাদে গাছের ডালপালা। ভেতরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। বাবা নিচে নামার জন্য যখন পাঞ্জাবি পরছিলেন তখন মা কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। তা দেখে বাবা বললেন, যাই দেখে আসি কি বলে। ’
আবেগাপ্লুত কন্ঠে আসিফ মুনীর বলে যান, ‘বাবা যখন নিচে নামেন তখন যুবকরা বলল, স্যার, আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। জবাবে মুনীর চৌধুরী ওয়ারেন্ট দেখতে চান। হঠাৎ করে তিনজনের একজন মুনীর চৌধুরীর পিঠে বন্দুক ধরে তাকে যেতে বাধ্য করে। ’
৮৩ বছর বয়স্কা মায়ের মুখে বাবার গল্প আর কয়েকটি পারিবারিক ছবি ছাড়া আসিফের কাছে বাবার আর কোনো স্মৃতি নেই। মাঝে মাঝেই বাবার একটু আদরের জন্য এখনো হাহাকার করে বেড়ান তিনি। কিন্তু জানেন সে আর সম্ভব নয়, তাই শহীদ বুদ্ধিজীবীসহ লাখ লাখ নারী-পুরুষ-শিশু হত্যাকারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শক্তি খোঁজেন।
তিনি বলেন, ‘তারপরেও বাবার অনুপস্থিতি সহ্য করতে অনেক সময় লেগেছে। পরিবারের প্রায় সবাই কেমন হয়ে যায়। বিশেষ করে আমি তখন একেবারেই চুপসে যাই। আজ এতে বছর পরেও আমরা তিন ভাই কিংবা মা কেউ এ বিষয়ে তেমন কথা বলি না। সবার কষ্ট তো একই। এ কষ্ট শুধু ভিতরে ভিতরে অনুভব করার বিষয়। ’
বলেন, ‘ অনেকে বাবাকে বাসা থেকে অন্যত্র সরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা থেকে হাতিরপুলে মায়ের বাসায় উঠলেও দেশ এবং পরিবারের কথা ভেবে কোথাও যাননি। তার এ দেশপ্রেমের কথা মনে হলে গর্ব অনুভব করি। ’
‘আবার মাঝে মাঝে ভয়ানক কষ্ট লাগে যখন ভাবি স্বাধীনতার মাত্র দুদিন আগে হারিয়ে গেলেন তিনি। ’
মুনীর চৌধুরীর লাশের সন্ধান পাওয়া না গেলেও রায়ের বাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধেই তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে তাদের ধারণা। সেখানে পাওয়া লাশের মধ্যে তাকে শনাক্ত করা না গেলেও দুই কারণে তাদের এ ধারণা হয়েছে। আসিফ মুনীর বলেন, ‘১৪ ডিসেম্বর যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের অনেকের লাশ এখানে পাওয়া যায়। তাছাড়া সেই হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেন হত্যাকাণ্ডের সময় সেখানে মুনীর চৌধুরীর নাম শুনেছেন। ’
অনেকটা আফসোস করে আসিফ বলেন, ‘প্রায় শুনি দেশে ভালো বাংলা নাটক হয় না। মানসম্পন্ন নাট্যকারের অভাব। অথচ মুনীর চৌধুরীর অসামান্য নাটকগুলো টেলিভিশনে প্রদর্শন কিংবা মঞ্চায়নের কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। অবশ্য গত ঈদে মহারাজ নাটকটি বাংলাদেশ টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে। ’
‘আমি নিজ উদ্যোগে কবর, মানুষ, গতকাল ঈদ ছিল, দণ্ডধর ও মহারাজ মঞ্চায়ন করেছি। মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালি চেতনা যারা লালন করেন তারা এবং রাষ্ট্র এ দায়িত্ব নিতে পারে। ’
আসিফ মুনীর বলেন, ‘জন্মদাতা বাবাকে হারানোর কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হয় ও পাকিস্তান তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে। ’
তিনি বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ায় আমরা আশান্বিত। তবে বিচার প্রক্রিয়া যেন অপ্রয়োজনীয় দীর্ঘসূত্রতার সম্মুখীন না হয়। তিনি স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যর উপর গুরুত্বারোপ করেন যাতে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারে।
বাংলাদেশ সময় ১৯১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১০