বন্ধু শব্দের আভিধানিক অর্থ সুহৃদ, মিত্র, সখা, স্বজন, প্রিয়জন, প্রণয়ী বা কল্যাণকামী ব্যক্তি। আর বন্ধুত্ব শব্দের আভিধানিক অর্থ সৌহার্দ্, সখ্য, মৈত্রী ও বন্ধুতা।
একটু চিন্তা করলে বলা যায়, বন্ধু শব্দটি দু’টি বিষয়ের খুব কাছাকাছি দিয়ে যায়। একটি বন্ধুত্ব আর অন্যটি প্রেম।
বন্ধুত্ব বলতে গিয়ে বলা যায়, দু’টি ভিন্ন মানুষের মাঝে ভিন্ন একটি হৃদয়। যদিও এটি একটি হালকা শব্দ মনে হয়। এর পরও এর ভাবার্থ অসাধারণ ও পবিত্র। দু’টি মানুষের মাঝে এক পবিত্রতম সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করে বন্ধুত্ব। আর এটিকে মানুষের জীবন থেকে আলাদা করে ভাবার কোন সুযোগ নেই। বন্ধুত্ব প্রত্যেকটি মানুষের জীবনের একান্ত অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত।
সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে কিছু মানুষের সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। যারা মানুষের অনেক বড় বড় স্বার্থের উর্ধ্বে থাকে। একজন অন্যজনকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করে।
সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বন্ধু ছাড়া জীবন অসম্পূর্ণ। কোন মানুষ একাকী চলাফেরা করতে পারে না। যদিও বন্ধু নিয়ে অনেকের অভিজ্ঞতা সুখকর হয় না। যার কাছ থেকে প্রতারণা পাওয়া যায় সেতো বন্ধুই না।
বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামাল তার ’না’ বইয়ে লিখেছেন, বন্ধুত্বের নানা সঙ্কটের কথা। একজন মানুষ কিভাবে তিল তিল করে ভাল বন্ধু হয়ে ওঠে, আবার তার কাছ থেকে সবচেয়ে বড় আঘাত পেয়ে থাকে।
লেখক তার বইয়ে বন্ধুর নানা ব্যাখ্যা যেমনি করেছেন, তেমনি বলেছেন বন্ধুত্ব করার নানা দিক নিয়ে।
তবে মোহিত কামালের লেখা দিয়ে সমাজের বাস্তব চিত্র বোঝা গেলেও সব বন্ধুর কাছে মানুষ প্রতারিত হয় না। আর যার কাছে প্রতারিত হয়, আবারও বলছি সে তো আসলেই বন্ধু না।
যদিও ডা. মোহিত কামাল দেখিয়েছেন, বন্ধুত্বের মাঝে লুকিয়ে থাকা অপরাধচিত্র। একজন ঘৃণ্য অপরাধী কিভাবে বন্ধু সেজে ছোবল বসাতে পারে। লেখক বিশ্লেষণ করে বুঝিয়েছেন পুরো বিষয়টি। চারপাশে জালের মত ছড়ানো প্রতারণা থেকে মুক্তির কথাও বলেছেন তিনি।
অনেক আগে ইমদাদুল হক মিলনের লেখা একটি বই পড়েছিলাম ’বন্ধুবান্ধব’ নামে। সেখানে লেখক তার বন্ধুদের কথা যেভাবে লিখেছেন তা পড়ে ডা. মোহিত কামালের বই পড়ে যে হতাশায় পড়েছিলাম তা কেটে গেছে।
অন্যদিকে বন্ধুদের সহযোগিতা মানুষকে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে তাও বলেছেন ইমদাদুল হক মিলন। তিনি বন্ধুবান্ধব বইটির ভূমিকায় লিখেছেন, “জীবনের যে ক্ষেত্রে আটকে গেছি, সেখান থেকে আমার বন্ধুরা আমাকে হাত ধরে আমাকে পার করে এনেছে”।
লিখেছেন, শৈশব, কৈশর, শিক্ষা ও কর্ম জীবনে বন্ধুর নানা গল্প। ২০৮ পৃষ্ঠার বইটিতে লিখেছেন বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর আর সুখকর পথে চলার নানা স্মৃতি। এমন নানা গল্প আমাদের প্রত্যেকের জীবনে গাঁথা আছে। এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে বন্ধু ছাড়া চলছে।
বন্ধু¡ বলতে শুধু ভালবাসার মানুষের বন্ধু বোঝায় না। আগেই কাংলা একাডেমীর দেওয়া অর্থ বলেছি। এটা অনেকটা বন্ধু আর প্রেমিক প্রেমিকার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। শব্দের অর্থের দিক থেকে। এর ব্যাখ্যা যদিও অনেক বড়। এ বিষয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর একটি লেখায় বলেছেন, “বন্ধুত্ব ও ভালোবাসায় অনেক তফাৎ আছে, কিন্তু ঝট্ করিয়া সে তফাৎ ধরা যায় না। বন্ধুত্ব আটপৌরে, ভালোবাসা পোশাকী। বন্ধুত্বের আটপৌরে কাপড়ের দুই-এক জায়গায় ছেঁড়া থাকিলেও চলে, ঈষৎ ময়লা হইলেও হানি নাই, হাঁটুর নীচে না পৌঁছিলেও পরিতে বারণ নাই। গায়ে দিয়া আরাম পাইলেই হইল। কিন্তু ভালোবাসার পোশাক একটু ছেঁড়া থাকিবে না, ময়লা হইবে না, পরিপাটি হইবে। বন্ধুত্ব নাড়াচাড়া টানাছেঁড়া তোলাপাড়া সয়, কিন্তু ভালোবাসা তাহা সয় না। ”
তিনি আরও বলেছেন, “বন্ধুত্ব বলি তে তিনটি পদার্থ বুঝায়। দুই জন ব্যক্তি ও একটি জগৎ। অর্থাৎ দুই জনে সহযোগী হইয়া জগতের কাজ সম্পন্ন করা। আর, প্রেম বলিলে দুই জন ব্যক্তি মাত্র বুঝায়, আর জগৎ নাই। দুই জনেই দুই জনের জগৎ। ” কবির এই ব্যাখ্যায় আমরা অনেকটা পরিষ্কার হতে পেরেছি বন্ধুত্ব আর প্রেম এর পার্থক্য।
শুধু মেয়ে বন্ধুর জন্যেই মানুষের মন কাঁদে তা কিন্তু না। ছেলে বন্ধুর জন্যেও মন কাঁদতে পারে যদি তেমন বন্ধু হওয়া যায়। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতা পৌঁছে কুমিল্লায় থাকা তার প্রিয় বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে যে চিঠি লিখেছেন তা দিয়ে বন্ধুত্বের অমর দৃষ্টান্ত স্থাপন করা সম্ভব।
কবি তার বন্ধুকে সম্বোধন করে লিখেছেন, “বন্ধু, তুমি আমার চোখের জলের মতিহার, বাদল রাতের বুকের বন্ধু। যেদিন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর আর সবাই আমায় ভুলে যাবে, সেদিন অন্ততঃ তোমার বুক বেঁধে উঠবে। তোমার ঐ ছোট্ট ঘরটিতে শুয়ে, যে ঘরে তুমি আমায় প্রিয়ার মত জড়িয়ে শুয়েছিল, অন্ততঃ এইটুকু শ্বান্তনা নিয়ে যেতে পারবো, এই কি কম সৌভাগ্য আমার !!!”
বন্ধুর প্রতি এমন অভিব্যক্তি পাওয়া গেলে আর কি চাই তার কাছে। প্রতিটি মানুষের জীবনে অনেক মুহূর্ত আসে যখন সে নিজেকে একা ভাবতে শুরু করে। সেই নি:ষঙ্গ সময়ে তার পাশে এসে দাঁড়ায় একজন ভাল বন্ধু। সে, মানুষটিকে সামনে অগ্রসর হতে, বেঁচে থাকতে আর আরও সুন্দরভাবে পথ চলতে সহায়তা করে।
বন্ধুর জন্য বন্ধুর দিন প্রতিদিন। দিনে-রাতে যখন প্রয়োজন তখন বন্ধুর সঙ্গে দেখা ঘোরা আর চলতে পারা যায়। বন্ধুর সঙ্গে চলতে চলতে চলতে কত মানুষ পথ হারিয়েছে। গন্তব্যহীন পথ চলেছে অনেকে। আবার এই বন্ধুই পথ দেখায় সামনে এগিয়ে যেতে। তাই বলা যায়, জীবনে বন্ধুর অবদান অন্য কারো মত নয়। বন্ধুর বিকল্প বন্ধুই।
বন্ধু দিবস। আমাদের দেশে পালিত হয় আগস্টের প্রথম রোববার। পৃথিবীর এক এক দেশে এক এক দিনে পালিত হয় দিনটি। বন্ধু দিবস পালনের সুনির্দিষ্ট কারণ নিয়েও রয়েছে নানা মত পার্থক্য। কেউ বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জনমনে যে অবিশ্বাস আর শত্রুতা জন্ম নিয়েছিল তার প্রেক্ষিতেই বন্ধু দিবসের শুরু। আবার অনেকে বলেন, আমেরিকায় একজন বন্ধুর মৃত্যুর পরদিন তার বন্ধুর আত্মহত্যার ঘটনায় শুরু হয়েছে বন্ধু দিবসের প্রচলন। সারা পৃথিবীতে দিবসটি নিয়ে মাতামতি হলেও অনেক দেশ রয়েছে যেখানে বন্ধু দিবস হিসেবে কোন আলাদা দিবস পালিত হয় না। দিবস পালন হোক বা না হোক, বন্ধুত্ব অমর হোক। বন্ধুত্ব বেঁচে থাক অনাদিকাল। পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষ সুপরশ পাক বন্ধুত্বের।
আনিস রহমান: বার্তাকক্ষ সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর , anish.jmc07@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১২০৮ ঘণ্টা, আগস্ট ৪, ২০১৩
জেডএম/