ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

বিশ্বজুড়ে সমাদৃত কুমিল্লার খাদি

রনবীর ঘোষ কিংকর, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:৪৫, আগস্ট ১১, ২০১৩
বিশ্বজুড়ে সমাদৃত কুমিল্লার খাদি

চান্দিনা (কুমিল্লা): কুমিল্লা‘র ইতিহাসে প্রতিটি পাতা জুড়ে রয়েছে খাদি। স্বদেশী আন্দোলন থেকে শুরু করে এর গৌরবময় ঐহিত্য বাংলাদেশ তথা এশিয়া মহাদেশে জুড়ে আজও সমাদৃত।



ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যসহ সকল দেশে খাদির পোশাক ব্যবহৃত হয়। এক সময় খাদি সকলের পরিধেয় হলেও বর্তমানে উন্নত রাষ্ট্রসহ দেশের খ্যাতনামা ব্যক্তিদের আভিজাত্যের পোশাক খাদি।

বিশ্ব জুড়ে আছে এশিয়া মহাদেশের খাদির খ্যাতি। এই খাদির জন্য পুরস্কৃত হয়েছে বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশের মধ্য কুমিল্লা জেলা হচ্ছে খাদির জন্য বিখ্যাত। তবে খাদির আদি ঠিকানা  কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলায়। যা আজও শ্রেষ্ঠত্ব বজায় করে চলেছে।

প্রায় শতবর্ষেরও বেশি সময় কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার মাধাইয়া, কলাগাঁও, কুটুম্বপুর, হারং, বানিয়াচং, ভোমরকান্দি, বেলাশ্বর, মধ্যমতলা, বাড়েরা, গোবিন্দপুর, ছয়ঘড়িয়া, হাড়িখোলা ও দেবিদ্বার উপজেলার বরকামতা, নবীয়াবাদ, জাফরাবাদ, সাইতলা, বাখরাবাদ, ভানী গ্রাম খাদির জন্য খ্যাত।

এসবস্থানে চরকায় সুতা কেটে কাঠের তৈরি লোম মেশিনে খট খট শব্দে একের এর এক সুতার সাথে বুনন করে তৈরি হচ্ছে খাদি কাপড়। যার প্রতিটি সুতায় জড়িয়ে আছে বৃহত্তর ভারতবর্ষসহ বাংলার ঐতিহ্য।

নিম্নবিত্ত বা সনাতন ধম্বাবলম্বী নিম্নবর্ণের পরিবারের পরিধেয় মোটা সুতায় তৈরি সাদামাটা এই কাপড়। তৎকালিন সময়ে ওই কাপড়ের কোন নাম ছিল না। রাঙ্গামাটির কার্পাস তুলায় সুতা কেটে এ কাপড় তৈরি শুরু করা হয়েছিল।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে নিম্নবর্ণের যুগী সম্প্রদায়ই এই কাপড় তৈরির কাজে নিয়োজিত ছিল। ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর আহবানে বৃহত্তর ভারতবর্ষে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় বিদেশি পণ্য বর্জন করে দেশিয় পণ্যে ‘মোটা কাপড়, মোটা ভাত’ ব্যবহারের জন্য ডাক ওঠে।

ওই সময় মহাত্মা গান্ধীজির হাতে কাটা সুতা দিয়ে তাঁতে তৈরি খদ্দর কাপড় তুলে দিলে তিনি এই স্বদেশী কাপড় হিসেবে এবং গর্তে (খাদে) বসে তৈরি করা হয় বলে খদ্দর নামসহ এই শিল্পের প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরবর্তীতে উন্নত মানের খদ্দর তৈরির প্রচেষ্টা শুরু হয়।

১৯৩০ সালে ভারতের অভয়াশ্রম পরিচালিত কুমিল্লার বরকামতায় (বর্তমান চান্দিনা) নিখিল ভারত কার্টুর্নি সংঘে হাতে কাটা চরকায় সুতা ও তকলীতে কাপড় তৈরির কাজ চলতো। তাৎকালীন সময়ে সেখানে ডায়িং মাষ্টার হিসেবে কাজ করতেন চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার বাসিন্দা শৈলেন্দ্র নাথ গুহ।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর খাদি শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করা হলে কুমিল্লার খাদি শিল্পে বিপর্যয় নেমে আসে। কিন্তু ওই বিপর্যয় বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।  

১৯৫২ সালে সমবায় আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ ড. আখতার হামিদ খানের চেষ্টায় এবং তৎকালীন গভর্নর ফিরোজ খান নুনের সহযোগিতায় কুমিল্লায় ‘দি খাদি অ্যান্ড কটেজ ইন্ডাষ্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

এদিকে তৎকালীন সময়ে শৈলেন্দ্র নাথ গুহ ধারণা করেছিলেন খাদি একদিন প্রসার লাভ করবে এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠবেই। ওই ধারণামতে তিনি বরকামতার (বর্তমান চান্দিনার কাঠের পুল সংলগ্ন চান্দারপাড়) খাদির ওই কারখানাটি ধরে রাখেন। তৎকালীন সময়ে কর্মহীন ব্যক্তিদের খুঁজে এনে তার কারখানায় সুতা কাটা, কাপড় বোনার কাজ দিতেন।

এভাবে কয়েক যুগ অতিক্রম হলেও সনাতন ধর্মাবলম্বী যুগী সম্প্রদায়ের তৈরি ওই কাপড়কে খাটো চোখে যুইগ্যা কাপড় হিসেবে বিবেচনা করায় খাদি কাপড়ের চাহিদার পরিবর্তন ঘটেনি।

কিন্তু তিনি যার সাথেই আলাপ করতেন তাকেই বলতেন ‘আপনারা বছরে অন্তত একটি পাঞ্জাবী, পায়জামা বা ধুতি পড়ুন। তিনি সর্বদাই চিন্তা করতেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) পাঁচ কোটি জনসংখ্যা ছিল। সকলেই যদি বছরে একগজ খদ্দরের কাপড় কেনেন তাহলে প্রতি বছরে পাঁচ কোটি গজ কাপড় তৈরি করতে হবে।

আর সকলের গাঁয়েই থাকবে দেশিয় পণ্য। খাদিকে সারা দেশে প্রসার ঘটাতে তিনি ঢাকা শহরে ‘প্রবর্তন’ নামে একটি খাদি কাপড় বিক্রির দোকান গড়ে তোলেন।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা  লাভ করে। এসময়ও  নিম্নবিত্ত পরিবার ছাড়া অনেক বাঙ্গালি তার ঐতিহ্যের কাপড় খদ্দর ব্যবহার করতেন না। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে খাদি কাপড়ের চাহিদা বাড়তে থাকে।

সাদামাটা রঙের খাদি কাপড় এখন বিভিন্ন রঙে ছাপা হচ্ছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজগুলোতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে আছে খাদি কাপড়ের পোশাক। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে খাদি কাপড়ের তৈরি পোশাক রপ্তানি হচ্ছে।

যখনই খাদি কাপড়ে তৈরি পোশাকে ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে ঠিক তখনই দেশের খ্যাতনামা ব্যক্তিরা কুমিল্লার বিখ্যাত খদ্দর কারখানা শৈলেন্দ্রনাথ গুহের গ্রামীন খদ্দর পরিদর্শনে আসেন। ঢাকাসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে খদ্দরের প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার।  

বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেলসহ প্রশাসন ও রাজনৈতিক উর্ধতন ব্যক্তিরাও আসেন শৈলেন্দ্রনাথ গুহের কারখানায়। কিন্তু জীবদ্দশায় শেষ ইচ্ছায় পূরণ হয়নি তাঁর।

১৯০১ সালে জন্ম নিয়ে সাবালক হওয়ার পর থেকে জীবনের শেষ সময় টুকু পর্যন্ত শৈলেন্দ্রনাথ গুহ খাদি কাপড় নিয়ে কাজ করেছেন। খাদিকে জনপ্রিয় করতে এবং তার প্রসার ঘটাতে অনেক ত্যাগ-তীতিক্ষাও করেছেন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করেন তখন শৈলেন্দ্রনাথ গুহ অসুস্থ হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সে অবস্থায় তিনি চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিজ হাতে একটি খদ্দরের শাড়ি উপহার দেবেন। কিন্তু তার শেষ ইচ্ছা আর পূরণ হয়নি। সেখানেই তিনি মৃত্যু বরণ করেছিলেন।

খাদি কাপড়ের ঐতিহ্য আর আভিজাত্যে ভিন্নতর মাত্রা আছে। বিদেশ থেকে আসা কাপড় আর আধুনিক বস্ত্রকলে উৎপাদিত কাপড়ের পাশে খাদি বস্ত্রের আভিজাত্যই আলাদা। কিন্তু দেশে বস্ত্রনীতির অভাবে অন্যান্য তাঁত শিল্পের মতো এতিহ্যবাহী খাদিশিল্প কমবেশি ক্ষতিগ্রস্থ ও প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছে।

খাদি শিল্পের প্রসারে শৈলেন্দ্র নাথ গুহের শ্যালক উপেন্দ্র নাথ  সর্ব প্রথম কুমিল্লায় ‘শুদ্ধ খদ্দর ভান্ডার’ নামে খদ্দরের জমজমাট ব্যবসা আরম্ভ করেন। সেখানে তিনি রং ও ছাপার কাজও করতেন।

পরবর্তীতে তরুণী মোহন রায়ের খাদি ঘর, শংকর ভট্টাচার্যের  খাদি কুটির শিল্প, মনমোহন দত্তের বিশুদ্ধ খদ্দর ভান্ডার, কৃষ্ণ সাহার রাম নারায়ণ খাদি স্টোর, দীনেশ দাসের খাদি ভবন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।  

বর্তমানে শুধুমাত্র কুমিল্লা মহানগরীতেই শতাধিক খদ্দরের দোকান গড়ে উঠেছে। মহাসড়কের পাশে অবস্থিত অনেক হোটেলের পাশেও রয়েছে ঐতিহ্যবাহী খদ্দরের দোকান।

কারণ দেশের যে প্রান্ত থেকেই কোন ব্যক্তি বা পরিবার কুমিল্লায় বেড়াতে আসেন বা কুমিল্লায় অঞ্চলে কিছুক্ষণ অবস্থান নেন তাদের কেউ কুমিল্লার ঐতিহ্য হিসেবে খদ্দরের যে কোন পোশাক না কিনে যাবেন না এটাই স্বাভাবিক।

কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার কাঠেরপুল সংলগ্ন চাঁন্দারপাড়ে গড়ে উঠা শৈলেন্দ্রনাথ গুহের গ্রামীণ খাদি’র বর্তমান পরিচালক অরুন গুহ (চান্দু) জানান, ‘খাদির উপর’ বাবার (শৈলেন্দ্র নাথ গুহের) অনেক স্বপ্ন ছিল।

তাঁর বড় তিনটি স্বপ্নের মধ্যে একটি হলো- সারা বাংলার প্রতিটি মানুষের গাঁয়ে খাদির কাপড়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খাদির শাড়ি উপহার ও খাদি কাপড়ে বাংলাদেশের পতাকা বাধ্যতা মূলক করা।

তিনি শৈলেন্দ্রনাথ গুহের স্বপ্ন পূরণ সম্পর্কে বলেন, সব কিছুর পরিবর্তনের সঙ্গে খাদি কাপড়েও অনেক পরিবর্তন এসেছে। যে সময়ে খাদি শুধু নিম্ন বিত্তদের পরিধেয় ছিল এখন ওই খাদি উচ্চবিত্তসহ বাঙ্গালি জাতির আভিজাত্যের পোশাকে পরিণত হয়েছে।

আমরাও খাদির গুণগত মান অক্ষুন্ন রেখে আধুনিকতা আনার চেষ্টা করছি। কারণ পৃথিবীর যেখানে রুচি সম্মত বাঙালি রয়েছেন সেখানেই খাদি কাপড় সমাদৃত। বিশেষ করে প্রবাসী বাঙালিদের ব্যবহার করা খাদি কাপড়ে বৈচিত্র দেখে বিদেশিরাও খাদি কাপড়ের দিকে ঝুঁকছেন।

প্রধানমন্ত্রীকে বাবা নিজ হাতে খাদি কাপড় উপহার দিতে না পারলেও পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে তৎকালীন ডেপুটি স্পিকার অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ এমপি‘র মাধ্যমে বাংলার বিখ্যাত কারুশিল্পী জয়নুল আবেদীনের বংশধর ইকবাল উদ্দিনসহ তিন ব্যক্তি বাবার ওই স্বপ্ন পূরণ করেছেন। এখন বাঙ্গালি হিসেবে আমাদের দাবী বাংলার ঐতিহ্য খাদি কাপড়েই হোক আমাদের জাতীয় পতাকা।

তিনি আরও বলেন, ফ্যাশন ডিজাইনারদের পাশাপাশি যদি আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী,  রাজনৈতিক উর্ধতন নেতৃবৃন্দ বিদেশি রাষ্ট্রদূত বা বিদেশি রাজনীতিবিদদের বাংলাদেশের ঐতিহ্য খাদি উপহার দেন তাহলে বিশ্ব জুড়ে এই খাদির প্রসার হবে এবং বাংলার বিখ্যাত খাদির ইতিহাস যুগ যুগ ধরে অক্ষুন্ন থাকবে।

বাংলাদেশ সময় : ১৬০৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০১৩
সম্পাদনা: সুকুমার সরকার, আউটপুট এডিটর, কো-অর্ডিনেশন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।