রাঙামাটি-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের বেড়ে মিয়ানমার ও মিজোরাম ছুঁয়ে থাকা অনিন্দ্য সুন্দর বান্দরবানের পরতে পরতে যেন নিজেকে মেলে রেখেছে প্রকৃতি। দেশের সর্বোচ্চ দুই পাহাড় তাজিনডং ও কেওক্রাডং, সর্বোচ্চ খাল রাউখিয়াং এ জেলার অন্যতম আকর্ষণ। বান্দরবান থেকে ফিরে: অনন্য সুন্দর ভোর। ঝুম বৃষ্টি। টিনের চালে বৃষ্টির টানা তাল। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে মাটির সোঁদা গন্ধ।
পাহাড়ের তিনশ’ ফুট উঁচুতে কাঠের কটেজ। গ্রীষ্মের গরমেও দু’টি কম্বল গায়ে শুয়ে। জানালা গলে উঁকি দিচ্ছে ভোরের স্নিগ্ধ আলো। সে আলোর আলতো ছোঁয়ায় ঘুম ভাঙল সবার।
ঘড়ির কাঁটায় তখন ভোর ৬টা। যেতে হবে অনেক দূর। সেই নাফাখূম। যাওয়া আসা মিলিয়ে প্রায় ৬ ঘণ্টার হাঁটা পথ।
ধড়ফড়িয়ে উঠে ডেকে তুললাম সবাইকে। নিচ থেকে ডাক শুনতে পেলাম আমাদের গাইড মংয়ের। ঘর থেকে বেরিয়ে দাঁড়ালাম কটেজের কাঠের বারান্দায়। সে এক অদ্ভুত ভালোলাগা। আজকের ভোরটা যেন নতুন করে সেজেছে আমাদের জন্যে। চারপাশ নিস্তব্ধ। শুধু থেমে থেমে শোনা যাচ্ছে জলের ফোঁটার টুপটাপ শব্দ।
বৃষ্টি কমে গেছে। দুষ্টু মিষ্টি মেঘগুলো পাহাড়ের সবুজ কোলে পেখম মেলে বসে হাতছানি দিচ্ছে আমাদের।
চারদিকে মিষ্টি একটা গন্ধ। রেমাক্রি খূম থেকে বইছে জলের নহর। এত ভোরেও কমর্ব্যস্ত রেমাক্রি ঘাট।
দ্রুত তৈরি হয়ে নেমে এলাম নিচে। এবার নাস্তার পালা। ব্যবস্থা খুব বেশি নেই। সিদ্ধ নুডুলস, ডিদ্ধ ডিম, ভাজি ডিম, নাপ্পি আর কলা। যার যার পছন্দ মতো খেয়ে কলা কিনলাম আড়াই ডজন। দাম মাত্র ৩০ টাকা।
পেয়ে গেলাম কালো আখও। প্রতি পিছ ১৫ টাকা। দলের সদস্য পাঁচজন। মং পথপ্রদর্শক। আমাদের বান্দরবান অভিযাত্রার চতুর্থ দিন। কোমর পানির রেমাক্রি খাল পেরিয়ে রেমাক্রি খূম। এর পানি বয়ে পড়ছে রেমাক্রি খালে।
রাতে কম্বল গায়ে দিতে হলেও দিনের রোদ এবং তাপ কিন্তু কম নয়!
রেমাক্রি নৌকাঘাট থেকে নাফাখূম যাওয়ার পথটা মুগ্ধ করার মতো। তবে বর্ষা এবং গ্রীষ্মে কিন্তু ভিন্ন রূপ। বর্ষায় পথটি বেশ ঝুঁকিপূর্র্ণ। এসময় সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞাও থাকে বেশ কিছুদিন। তাই নাফাখূমে যেতে গ্রীষ্ম অথবা শীত বেছে নেওয়াই ভালো।
রওয়ানা করলাম সকাল সাড়ে সাতটায়। যাত্রাপথের পাতকূয়াগুলোতে তখন শিশু ও নারীদের সারি। সারাদিনের পানি সংগ্রহে ব্যস্ত তারা। পুরুষদের অধিকাংশকে দেখা গেল জাল দিয়ে মাছ ধরতে, বাঁশের ভেলা বানাতে ও বাঁশের ভেলা বাইতে। উঁচু নিচু, আঁকা-বাঁকা পথ বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। একবার কেউ পিছিয়ে পড়লে তার জন্য ক্ষণিকের অপেক্ষা। তারপর আবার যাত্রা।
কখনো সরু একটি কাঠের সাঁকো, কখনো হাঁটুজলে খাল পার হয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা। প্রচণ্ড রোদ আপনাকে ঘামিয়ে দুর্বল করে দেবে। তাই রওয়ানা দেওয়ার আগেই ছাতা নিয়ে নেওয়া ভালো। অবশ্য সেটি আপনার হাঁটার গতি কমিয়ে দেবে। আর ক্যাপ গরম করে দেবে আপনার মাথা। এক্ষেতে আমাদের কাজে লেগে গেল তানজিলের বুদ্ধি। সবাই একটা করে গামছা নিয়েছিলাম। জলে গামছাটা ভিজিয়ে সবাই পেঁচিয়ে নিলাম মাথায়। ব্যস, মাথা ঠাণ্ডা!
ওহ! আরেকটা জিনিস। রওয়ানা দেওয়ার আগে হাতে পায়ে মুখে ওডোমাস মেখে নিতে ভুলবেন না। কারণ পাহাড়ি গাছপালা, জঙ্গলের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার মাছি আর মশার আড়ত বলতে পারেন। এগুলোর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া মুশকিল। আর বর্ষা ছাড়া অন্য সময় গেলে জোঁকের ভয় নেই।
নাফাখূম যাত্রায় আপনার সাহসেরও পরীক্ষা দিতে হবে। কারণ মাঝে মাঝে দেখবেন সামনে এগুনোর পথ নেই। তখন আপনাকে ঝিরির হাঁটুজল আবার কখনো গলাজলে ডুবে পার হয়ে অন্য পাড়ে গিয়ে আবার হাঁটা ধরতে হবে। দু’পাশের গাছগুলো হবে আপনার ছায়া সঙ্গী।
টানা দু’ঘণ্টা হাঁটার পর আমরা জল কাদামাখা ভয়ঙ্কর পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে হাজির হলাম পাথরের রাজ্যে। পাথর এত বেশি যে তার ফাঁক গলিয়ে পানি আসতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। পথিমধ্যে কিন্তু অনেক ছোটখাট ঝরনাধারাও দেখতে পাবেন। আর এসব ক্ষীণ ঝরনাধারা পানি একেবারে হিম। চলার পথে এসব ঝরনা থেকে একটু পানি নিয়ে হাতমুখ ভিজিয়ে নিলে পাবেন অনাবিল প্রশান্তি।
হাঁটার পথে পাহাড়ের সুমিষ্ট আখ খেয়ে তৃষ্ণা মিটিয়েছি। এবার ক্ষুধা মেটানোর পালা। সঙ্গে দরকার এনার্জি। মং ব্যাগ থেকে কলা বের করলো। একেকজন মুহূর্তে খেয়ে নিলাম তিন চারটি করে। তারপর পাথরে নেমে উপভোগ করলাম অনাবলি সৌন্দর্য। এরমধ্যে আমাদের ফটোগ্রাফার নূর ভাইয়ের দেখা নেই। পরে আবিষ্কার করলাম পাথরের মধ্যে শুয়ে, বসে কতরকম ভঙ্গিতে ছবি তোলায় ব্যস্ত তিনি।
আমাদের বার বার মনে হচ্ছিল ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে দেখা ছোট নদী, দু’পাশে ঝুলে থাকা বড় বড় গাছের ডাল, তার মাঝ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অভিযাত্রীরা...আরও অনেককিছু।
মাঝে মাঝে পড়ছে আবার ছোট বড় পাথর রাজ্য। এরই মধ্যে আবার বিভিন্ন প্রজাতির পাখির ডাক, বুনো সুন্দর ফুল। সব পেছনে রেখে আবার হাঁটা শুরু করলাম। হাতে সবার বাঁশের লাঠি। দু’টি কারণে। প্রথমত, বুনো গাছপালা সরানো। দ্বিতীয়ত, শব্দ করে চলা, যাতে সাপ বা অন্য কোনো হিংস্র জন্তু সতর্ক হয়ে যায়।
যত এগুচ্ছি পথ যেন তত দুর্গম হয়ে উঠছে। কাজেই কাছে ভারি ব্যাগ তো রাখবেনই না, আর পায়ের জুতাটা হতে হবে আরামদায়ক। এক্ষেত্রে কেডস না পরে বান্দরবান থেকে আরামদায়ক প্লাস্টিকের বেল্ট জুতা কিনে নিতে পারেন দুই-তিনশ’ টাকায়। কারণ আপনাকে বারবার পানি পেরুতে হবে।
আরেকটু এগুতেই গম্ভীর জলের আর্তনাদ কানে এলো। কানে পেতে বোঝার চেষ্টা করলাম সত্যি কি নাফাকূমের কাছাকাছি এসে গেলাম! পা-ও তখন আর চলছে না কারো। আশার আলো দেখে একটু এগিয়েই দেখা পেলাম নাফাকূমের। তখন বর্ষা ছিল না। তাই নাফখূম জলপ্রপাতের প্রবাহ অত বেশি ছিল না। তবু তার গম্ভীর শান্ত ভাবটা উপভোগ করার মতো। ঘোলা নয়, স্বচ্ছ কাচের মতো জল বইছে অঝোর ধারায়।
গাইড মং পৌঁছা মাত্রই জামা খুলে লাফিয়ে পড়লো নাফাখূমের জলে। আমরা তো অবাক! মানুষ এভাবে লাফানোর সাহস করে এমন জায়গায়! কিন্তু তার লাফানো দেখে আমরা কেউ কিন্তু স্থির থাকতে পারলাম না। অথচ কেউ অতিরিক্ত পোশাক আনিনি। কি আর করা! মং আমাদের সাহস দিলো। টি-শাট খুলে আমরা প্রথমটায় লাফ দিলাম না। কিন্তু নেমে গেলাম পাথর বেয়ে জলে। অদ্ভুত শীতল স্বচ্ছ জলে অবগাহন। প্রশান্তির জল, স্বর্গীয় অনুভূতি। যেন ওপর থেকে পড়া জলে মুছে যাচ্ছে সব গ্লানি।
আমরা জলকেলিতে এতই মগ্ন ছিলাম যে কিছুক্ষণের জন্য বোধহয় ভুলেই গেলাম আমাদের সঙ্গে নূর ভাইও এসেছেন। ভুল ভাঙলো তার চিৎকারে। আমাদের হৈচৈতে তিনি নাকি ছবি তুলতে পারছেন না। বার বার তার ফ্রেমেরে মধ্যে আমরা। অগত্যা, আমাদের কিছু সময়ের জন্য উঠে পড়তে হলো। কিছু ছবিও তুললাম। এরই মধ্যে মং আবার লাফ দিলো। শুধু তাই নয়, পাথরের বড় বড় ফোঁকরে হাত গলিয়ে দিয়ে বললো দেখি মাছ পাই কিনা। তাতে মাছ না পেলেও অনেক বড় বড় মাছের দেখা মিললো এখানকার স্বচ্ছ জলে। এখানে এসে জানলাম ‘নাফা’ একপ্রকার মাছ আর ‘খূম’ অর্থ গর্ত। অর্থাৎ নাফাখূমের অর্থ দাঁড়ায় মাছের গর্ত।
এবার আমাদেরও শখ হলো লাফানোর। রেডি ওয়ান টু থ্রি... বলেই দিলাম লাফ। নূর ভাই ক্যামেরাবন্দীও করলেন সে মুহূর্ত। আমাদের লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি দেখে কিন্তু নূর ভাইও শেষ পর্ন্ত ক্যামেরা নিয়ে মশগুল থাকতে পারলেন না। নেমে গেলেন গামছা পরেই। তারপর সবাই মিলে কিছুক্ষণ হৈ চৈ করে উঠে পড়লাম। ভেজা কাপড়েই এখন আমাদের থাকতে হবে তিন চার ঘণ্টা।
নাফাখূমের উৎস পথ ধরে ২০ মিনিট হাঁটলেই তকরা পাড়া। আমাদের পানি শেষ। ক্ষুধা লেগেছে অনেক। ফিরে না গিয়ে হাঁটা শুরু করলাম তকরা পাড়ার উদ্দেশ্যে। মংয়ের কাছে সবই পরিচিতি। অনেকবার এসেছেন তিনি। গিয়ে উঠলাম তকরা ত্রিপুরার মাচাংঘরে। সেখানে তৃষ্ণা মিটিয়ে গাছে ঝুলে থাকা আম লাফিয়ে লাফিয়ে পেড়ে খেলাম। মাঝে মাঝে কাটার সময় পাওয়া গেল না, খেয়ে ফেললাম ফাটিয়ে।
এবার ফেরার পালা। মনে ওঠা মাত্রই কষ্ট শুরু হলো। আবার হাঁটতে হবে তিন-চার ঘণ্টা! কিন্তু এ কষ্টটাকে কষ্ট মনে হবে না যদি চলার পথের দু’এক জন মানুষকে দেখেন। তিন ঘণ্টার পাহাড়ি পথ হেঁটে চাল-তরাকারির বোঝা মাথায় নিয়ে বাজার করে ফিরছেন তারা। হয়তো এটা দিয়েই চলতে হবে তাদের পুরো সপ্তাহ। এটা তাদের নিয়মিত রুটিন। চলার পথের কষ্ট আমাদের উবে গেল এই মানুষগুলোকে দেখে। পথও যেন ছোট হয়ে এলো। শুধু পথিকের আশ্রয় নেওয়ার জন্য নির্মিত দু’একটি টং ঘরে দু’পাঁচ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে ফিরে এলাম রেমাক্রি বাজারে।
যদি যেতে চান বান্দরবান: ঢাকা থেকে বান্দরবানের উদ্দেশে শ্যামলী, হানিফ, ঈগল, সৌদিয়াসহ বেশ কয়েকটি পরিবহনের গাড়ি সকাল ৭টা- ৯টা এবং রাত ১০টা-১২টার মধ্যে কলাবাগান, ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ থেকে ছেড়ে যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৬২০ টাকা। সময় লাগবে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা। বান্দরবান থেকে থানচি পর্যন্ত গাড়ি ভাড়া জনপ্রতি ২০০ টাকা। সময় লাগবে সাড়ে চার ঘণ্টা।
থানচি থেকে তিন্দু, রেমাক্রি, নাফাকূম, ছোটমোদক, বড় মোদক পর্যন্ত টানা নৌকা ভাড়া পড়বে দুই থেকে নয় হাজার টাকা। সময় লাগবে ৪ থেকে ১০ ঘণ্টা। আর ইঞ্জিন নৌকায় ভাড়া পড়বে ৪ থেকে ১২ হাজার টাকা। সময় লাগবে ২ থেকে ৭ ঘণ্টা। তবে মৌসুম ভেদে নৌকা ভাড়া বাড়ে ও কমে। এছাড়া প্রতিদিন পাঁচশ’ টাকা চুক্তিতে অবশ্যই নিতে হবে একজন গাইড।
বান্দরবানে থাকার পর্যাপ্ত হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে ২০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত রুম ভাড়া পাওয়া যাবে। এছাড়া কটেজ ভাড়া নিয়েও থাকতে পারেন। খাবারেরও সমস্যা নেই। থানচি বাজারের পর যেখানেই যাবেন আপনাকে কারবারি বা কারও বাড়িতে থাকতে ও খেতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনাকে সব সহযোগিতা করবে গাইড। এমন একজন গাইড হলেন- মং মারমা। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন ০১৫৫৭-৪১১০১৩ নম্বরে। ফোন করে যদি বন্ধ পান তাহলে বুঝবেন থানচিতে নেই তিনি। হয়তো কারো গাইড হয়ে গেছেন তিন্দু, রেমাক্রি বা বিজয় কেওক্রাডংয়ে। এক্ষেত্রে মোবাইলে মেসেজ দিয়ে তাকে বুক করতে পারেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৩