নদীর নাম সন্ধ্যা। নামটি এতোই ভাল লাগে- যে জন্য আবারও সন্ধ্যা নদীর পূর্ব প্রান্তে পায়ে হেঁটে এলাম।
বসে বসে দেখছি, ওই যে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। নীড়ে ফিরছে কত না পাখি। ওই সূর্যটা যেভাতে ডুবছে- জীবন প্রদীপটাও একদিন এ ভাবেই নিভে যাবে। আকাশ পানে তাকাতে তাকাতে দেখি সূর্য আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। মনে হলো সন্ধ্যা নদীতেই বুঝি ডুবছে সূর্যটা।
দেখি এক মাঝিভাই নদী তীর ঘেঁষে এগিয়ে আসছে। নৌকা চলানোর ঢংটাই বেশ ভিন্ন। বৈঠা হাতে মাঝির কন্ঠে শুনতে পেলাম- ‘আমার গহীন জলের নদী/আমি তোমার জলে রইলাম ভেসে জনম অবধি/তোমার বানে ভেসে গেল আমার বাঁধা ঘর/চরে এসে বসলাম রে ভাই ভাসালে সে চর/এখন সব হারিয়ে তোমার জলে রে আমি ভাসি নিরবধি/আমার ঘর ভাঙ্গিলে ঘর পাব ভাই/ভাঙলে কেন মন/হারালে আর পাওয়া না যায় মনের মতন/
জোয়ারে মন ফেরে না আররে/ভাটিতে হারায় যদি/ তুমি ভাঙ যখন কুলোরে নদী ভাঙ একই ধার/ আর মন যখন ভাঙরে নদী দুই কূল ভাঙ তার/ চর পড়ে না মনের কূলেরে/ একবার সে ভাঙে যদি...... গানটা শেষ হতেই তাকে বললাম এই যে, রঙিলা নায়ের মাঝি, কোথায় চলছো.... নদীর বিরুদ্ধে তোমার এতো অভিযোগ কেন?
মাঝি- এতো গানের কথা, মনের কথা নয়। কেন আপনি কি জানেন না, কত মানুষ অন্যের মন ভেঙে দেয়। বলুন তারা কী ভাল। নিশ্চয়ই না। বললাম, কোথায় তোমার বাড়ি, নামটি তোমার কিবা? হেসে- একটুখানি শ্যামল ঘেরা কুটিরে মোর বাড়ি।
জানেন, সেখানে একদা দেখা দিতো ধানের শেষে ইশারাতে পিড়ি পেতে বসতো আমার বাবা সবখানি মন উজাড় করে। দিতো তারে খানাপিনা আমার কিষানী মা সেই কাহিনী শোনাই শোন............।
এবার গান ধরলো মাঝি- ‘ঘুঘু ডাকা ছায়ায় ঢাকা/ গ্রাম খানি কোন মায়ায় ভরে/ শ্রান্তজনের হাত ছানিয়ে/ ডাকতো তারে আদর করে সোহাগ ভরে/ নীল শালুকে দোলন দিয়া রঙ ফানুসে ভেসে/ ঘুম পরী সে ঘুম পাড়াত এসে কখন যাদু করের/ ভোমরা যেত গুনগুনিয়ে ফোটা ফুলের পাশে....। ’
গানখানি শুনে খুব ভাল লাগলো। মাঝির ভক্ত হয়ে গেলাম। এই নামটি বলোনা?- আমি যে রঙিলা মায়ের মাঝি, আমায় রঙিলা নামে ডাকতে পারেন......। বললাম, এই যে রঙিলা নায়ের মাঝি, তোমার নৌকায় বেড়ায়ে রাতটা কী পার করা যায়? ওই যে দেখা যায়, আকাশেতে অগনিত তারা। শুয়ে শুয়ে না হয় গুণবো। কী নৌকায় নেবে? মাঝি- আসুন, আসুন উঠে বসুন। আপনি যে আমার মেহমান......।
শুয়ে শুয়ে দেখছি আকাশের লক্ষ তারা। গুনে কী আর শেষ করা যায়। কী সুন্দর পৃথিবী। এপার থেকে ওপার দেখা যায় না। এক তীরে দেখি গাছ পালা- সর্বত্র নির্জন নিরিবিলি। নেই কোনো মানুষের পদচারনা। জোনাক পোকা জ্বলে জ্বলে নিভে যায়- মনে হয় এযেনো ঝিকি মিকি তারার মিছিল।
তখনতো, মনে হলো ‘স্বপ্ন ভরা স্বপ্ন মায়ায়/ নিবিড় কালো আঁধার ছায়ায় / সন্ধ্যা নামে নীল গগনে হায়/ রাত্রি নামে ঐ জ্যোৎস্না ভরা........’ গানের কথাগুলিই। এই রঙিলা নায়ের মাঝি নামটি কি বলবে না?- যখন রঙিলা বলে ডেকেছেন- উটাই না হয় থাক।
জিজ্ঞাসা করলাম - বয়স কতো হলো?- সতেরো পেরিয়ে আঠারো পড়ছে ভাদ্র মাসের ১৫ তারিখ থেকে। ----- এবার কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছ? রঙিলা মাঝি- আকাশের তারা গুনতে থাকুন- একশ তারা গোনা শেষ হলেই ফিরেই নিয়ে আসব আপনার বসে থাকা সেই নদীর কূলেতে। বললাম, রঙিলা আজ রাতটুকু না হয় তোমার বাড়িতেই রাখ। ভ্রমণ বেশ জমবে। হাসলো রঙিলা নায়ের মাঝি। আরে কি যে বলেন, গরিবের বাড়ি যাবেন তো। নাকি তামাশা করছেন।
বললাম, তা হবে কেন। তোমাকে দেখে খুব ভালো লেগেছে বলেই তোমার নায়ে উঠলাম। তুমি যে নায়ের মাঝি- এটাতো বিশ্বাসই হয় না। কি যেন ভাবলো রঙিলা নায়ের মাঝি- জানিনা জানিনা আমার এই মনে কেন রাঙালে। যার পথ চেয়ে দিন গুণেছি আজও তার পদধ্বনি শুনেছি......। সেই কি আপনি আপনি।
ওর কথাগুলো শুনে বার বার অবাক হলাম। - এই যে রঙিলা তুমি কি কাউকে ভালোবাসো?- ও মনে পড়ছে ভালো বাসার সেই মেয়েটির কথা। মেয়েটি অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো। নামটি ছিল তার চন্দনা। আহা কি না ছিল রুপ। ।
ওকে প্রায় বলতাম চন্দনা বনে মন হারাতে দোষ কোথায়। রেখেছি যে, দুটি ভিরু হাত তোমারই হাতে........। এ কথাগুলো বলতেই চন্দনা বেশ লজ্জা পেত। আসলেই চন্দনা ছিল লাজুক লতা। প্রায়ই ওকে নিয়ে সন্ধ্যা নদীতে নৌবিহার করতাম।
চন্দনার বাবা-মা এটা মেনে নিতে পারেনি কখনো। যখন তারা জেনেছে- তারপর ঘরের বাইরে ওকে আর যেতে দেয় নি। বহুবার মার খেয়েছে আমারেই জন্যই। যাতনা সহিতে না পেরে চন্দনা একদিন আত্মহত্যা করল........।
কথাগুলো বলে রঙিলা মাঝি হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠে আমার পাশে এসে বসল। হাতটা স্পর্শ করে- বলুন, এখন আমি কি করবো? আমার জীবনটাই বৃথা। কেউ আমাকে বুঝলো না, জানতে চেষ্টাও করলো না। সেই সময় যে কারোরই নেই। পৃথিবীটা বড় নিষ্ঠুর।
সন্ধ্যা নদীর ওপারে ইন্দেরহাটের কাছাকাছি নৌকা এসে গেছে। বললাম, তোমার গাঁয়ে নিয়ে চলো। দু’চোখের জল মুছে- ঐ যে খালটা দেখছেন, এরই দেড় কিলোমিটার দূরে আমার বাড়ি। নির্জন কুঠিরে একাই যে থাকি। কাছে পিঠে নেই কোন বাড়ি ঘর। নিজেই রান্না করি- খেতে পারবেন তো? কেন নয়?
বললো, থাকবেন তো আমার সঙ্গে। কী যে বলো রঙিলা মাঝি যাবো তোমার গাঁয়ে। দেখবো তোমার কুঠির। হাসলো রঙিলা, একটা গান শুনুন- আরে ও রঙিলা নায়ের মাঝি- তুমি এই ঘাটে লাগাওরে নাও/ লিগুম কথা কইয়া যাও শুনি/ তোমার ভাইটাল সুরের সাথে সাথে কান্দে গাঙের পানি /
ও তার ঢেউ লাগিয়া যায়/ ভাসিয়া কাঙ্খের কলসখানি/ পূবালী বাতাসে তোমার নায়ের বাদাম উড়ে.......। গানটা শেষ না করেই রঙিলা নায়ের মাঝি বলল, ঐ সে দেখছেন বাগান- বাবা মারা যাওয়ার সময় ওটাই রেখে গেছেন। ওখানে রয়েছে ফুল গাছ। চলুন- দেখবেন। ওর পিছু পিছুু চললাম.......।
গাঁয়ের বাগান, রাতের আঁধারে ঘুরে বেড়ানো সে কী না আনন্দের। এমন আনন্দ এই জীবনে কি আর পাব? রঙিলা মাঝি- দেখুন ওই যে আম গাছে আম ধরে। সময় এলেই ফল ধরবে। জাম গাছেও জাম ধরে।
বললাম, এই আঁধার রাতে এসব কথা কেন, অন্য কথা শুনাও- কেন আপনি কি ঐ গানটা শুনেননি, ‘আম গাছে আম ফলে, জাম গাছে- জাম হায়রে, জাম গাছে জাম আমি পন্থের পানে চাহিয়া থাকি না আসিল শ্যাম প্রাণ কোকিলারে...... বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি মধ্যে নলের বেড়া........।
-হ্যাঁ শুনেছি- বাহ কতইনা চমৎকার এই গানটা। এবার আমার পানে চোখ দু’টো বড় বড় করে তাকিয়ে- সামনেই শ্মশান ঘাট। ওখানে আমার বাবা-মা আর চন্দনাকে দাহ করা হয়েছিল। কথাটা শুনে একটু ভয় ভয় লাগলো। শ্মশান ঘাট দেখাবে এই রাতে, তা রাতের আঁধারে ভ্রমণে এসে কীইনা জ্বালায় পড়লাম।
এ যে কোথায় এলাম- কোন মায়া পুরীতে। এই দিকেই বা কেন নিয়ে এলো...........। ভয়ে বুকটা দুরু দুরু করছিল ঠিক সেই ক্ষণে রঙিলা মাঝি আমাকে বললো- ভয় পাচ্ছেন কেন? রাতের আলো আঁধারিতে গাঁয়ে ভ্রমণ এ যে হবে আপনার জীবনে এক দারুন স্মরণীয় ঘটনা। কী তাই না। ভয় নেই...........। চলুন, কুঠিরে ফিরে যাই।
রঙিলা মাঝিকে দেখে বার বার কেমন জানি মনে হলো। ভাবলাম কেনই যে ওর সঙ্গে দেখা, কেনই যে, ওর সঙ্গে এ গাঁয়ে আসা। বুদ্ধি করে বললাম, ঐ যে পথের ধারে কামিনী গাছটা দেখছি ওখান থেকে একগুচ্ছ ফুল নেব। কামিনী ফুল যে আমার খুব প্রিয়......।
হঠাৎ দেখি রঙিলা মাঝি নেই- তিনজন লোক এগিয়ে আসছে। তারা আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাবেন? বললাম, ওই যে নৌকায় মাঝি নাম রঙিলা ওর সঙ্গে এসেছি।
একজন বললেন, কোথাওতো কোন নৌকা নেই। বলুন, কিভাবে এলেন এই পথে। সবকথা খুলে বলতেই একজন বললেন, সে কি আপনাকে ঐ বাগানে নিয়ে গিয়েছিল......। হ্যাঁ বলতেই ভদ্রলোক তিনজন এক বাক্যে বললেন, আপনি প্রাণে বেঁচে গেছেন। ঐ দিকে যে শ্মশান ঘাট।
এই তো কিছুদিন আগে আত্মহত্যা করেছিল একটি ছেলে, একটি মেয়ে- ওরা একে অপরকে ভালোবাসত। মেয়েটির নাম চন্দনা, ছেলেটির নাম হৃদয়। সবাই বলে ওরা নাকি ভূত হয়ে গেছে। ঐ ভূতের সঙ্গে আপনার দেখা।
সকাল বেলা বাড়ির মালিক আমার সামনে ৬৪ জেলার ভ্রমণ বইটি দেখিয়ে বললেন..... এই বইতো আপনি লিখেছেন। আপনি ভ্রমণ বিলাসী। আপনাকে যে আমার বাড়িতে কয়েকদিন থাকতেই হবে। ভদ্র লোকের নাম আহম্মেদ আলী। তিনি এক সময় সরকারি চাকরি করতেন। তারই ছোট ছেলে সবুজের সঙ্গে চললাম সবুজ গাঁও দেখতে।
যে দিকে পথ চলা সেই দিকে চোখে পড়ছে নার্সারি আর নার্সারি। কামিনী, জবা, রজনীগন্ধা গোলাপ, হাসনা হেনা, জুঁই, চামেলী, কতনা ফুল গাছ। ফুলে ফুলে ভরা সন্ধ্যা নদীর দুই কূল।
পায়ে হেঁটে এলাম সন্ধ্যা নদীর তীরে। দেখি এই কূলে ইন্দেরহাট আর ঐ কূলে স্বরুপকাঠী......... নদী এঁকে বেঁকে চলে গেছে। মন জুড়ানো বাতাস তখন মনে করিয়ে দিলো- ‘ও নদীরে একটি কথা শুধায় শুধু তোমারে/ বল কোথায় তোমার দেশ/ তোমার নাই কি চলার শেষ ও নদীরে...... গানের এই কথাগুলি/ কত সুন্দর এই জনপদ।
বাংলাদেশ সময় : ১৭৫১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০১, ২০১৩
এ/আরকে