পুরো নাম ভ্লদিমির ইলিচ উলিয়ানফ। যদিও তিনি বিশ্বের কাছে পরিচিত ভিন্ন নামে।
লেনিনের জন্ম রাশিয়ার এক শিক্ষিত পরিবারে ১৮৭০ সালের ২২ এপ্রিল (রাশিয়ার পুরানো ক্যালেন্ডার অনুসারে ১০ এপ্রিল)। লেনিনের পিতা-মাতা থাকতেন ভল্গা নদীর তীরে সিমবিস্ক শহরে। ছয় ভাইবোনের মধ্যে লেনিন ছিলেন তৃতীয়। লেনিনের বাবা ইলিয়া অস্ত্রাকান ছিলেন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।
ছয় সন্তানের উপরেই ছিল বাবা-মায়ের প্রত্যক্ষ প্রভাব। তবে লেনিনের জীবনে যার প্রভাব পড়েছিল সবচেয়ে বেশি তিনি বড় ভাই আলেকজান্ডার।
আলেকজান্ডার ছিলেন সেন্ট পিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি ‘নারোদনায়া ভোলিয়ার’ নামে এক বিপ্লবী সংগঠনের সভ্য হিসাবে গোপনে রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
‘নারোদনায়া ভোলিয়া’ বিপ্লবী দলের সদস্যরা স্থির করলেন জার তৃতীয় আলেকজান্ডারকেও হত্যা করা হবে। লেনিনের ভাই আলেকজান্ডারও এই পরিকল্পনার সাথে যুক্ত হলেন। এই সময় (১৮৮৬ সাল) লেনিনের বাবা হঠাৎ মারা গেলেন। যখন পরিকল্পনা চূড়ান্ত পর্যায়ে তখন জারের গুপ্তচর বিভাগের লোকজন সব কিছু জেনে গেল। অন্য সকলের সাথে আলেকজান্ডার ধরা পড়লেন। বিচারে অন্য চারজনের সাথে তারও ফাঁসি হলো।
বড় ভাইয়ের মৃত্যু লেনিনের জীবনে বড় আঘাত। এ সময়ে লেনিনের বয়স মাত্র ১৭। তিনি স্থির করলেন বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত হবেন।
২.
১৮৮৭ সালের ৪ ডিসেম্বর ছাত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ছাত্রদের এক বিরাট সভা হল। সেই সভার নেতৃত্বের ভার পড়লো লেনিনের উপর। এই কাজের জন্য তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হলো। শুধু তাই নয়, পেছনে তিনি নতুন কোন আন্দোলন শুরু করতে পারেন; এ সন্দেহে ৭ ডিসেম্বর তাকে কাজানের গভর্নরের নির্দেশে কোফুশনিকো নামে এক গ্রামে নির্বাসন দেওয়া হলো।
এক বছর নির্বাসন শেষ হলো। লেনিন ফিরে এলেন কাজান শহরে। তার ইচ্ছা আবার পড়াশোনা শুরু করবেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির অনুমতি দেওয়া হলো না।
কাজানের ছিল একটি বিপ্লবী পাঠচক্র। এখানে সব সদস্যরাই মার্কসবাদের চর্চা করতেন। লেনিন সেই পাঠচক্রের সদস্য হলেন। এখানেই তিনি প্রথম মার্কসীয় দর্শনের সাথে গভীরভাবে পরিচিত হলেন।
লেনিন সেসময় অনেক বই সন্ধান করতেন। বেশকিছু বই পেয়েও গেলেন। তার মধ্যে ছিল মাকর্স-এঙ্গেলসের রচনাবলী। এখানেই তিনি তাদের রচনা জার্মান থেকে রুশ ভাষায় অনুবাদ করলেন। এছাড়া একের পর এক গ্রন্থ রচনা করতে আরম্ভ করলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘রাশিয়ার সোস্যাল ডেমোক্রেটদের কর্তব্য’। এছাড়া ‘রাশিয়ার পুঁজিবাদের বিকাশ’- এ দুটি বইয়ের মধ্যে লেনিনের চিন্তা-মনীষা, ভবিষ্যৎ জীবনের পরিকল্পনা স্পষ্ট ছবি ফুটে উঠেছে। দ্বিতীয় বইটির রচনার সময় তিনি ছদ্মনাম ব্যবহার করলেন ‘লেনিন’।
লেনিনকে শিল্পনগরীতে বসবাস করতে দেওয়া হলো না। বাধ্য হয়ে সেন্ট পিটার্সবুর্গ থেকে পসকফ বলে এক শহরে চলে যেতে হলো।
ঘুরে ঘুরে অল্পদিনের মধ্যেই নিজের কর্মক্ষেত্রকে প্রসারিত করে ফেললেন। তার এই গোপন কাজকর্মের কথা জারের পুলিশবাহিনীর কাছে গোপন ছিল না। একটি রিপোর্ট তার বিরুদ্ধে লেখা হলো, ‘বিপ্লবীদের দলে উলিয়ানফের উপরে কেউ নেই। মহামান্য জারকে রক্ষা করতে গেলে তাকে সরিয়ে ফেলতে হবে। ’ লেনিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলো।
সম্পূর্ণ ছদ্মবেশে কখনও পায়ে হেটে কখনও ঘোড়ার গাড়িতে চেপে সীমান্ত পার হয়ে চলে গেলেন জার্মানী।
৩.
জার্মানীতে এসে প্রথমেই স্থির করলেন একটি পত্রিকা প্রকাশ করবেন। ১৯০০ সালের ডিসেম্বর মাসে জার্মানির লিপজিগ শহর থেকে প্রকাশিত হলো নতুন পত্রিকা ‘ইসক্রা’। যার অর্থ স্ফূলিঙ্গ। সেইদিন কেউ কল্পনা করতে পারেনি এই স্ফূলিঙ্গই একদিন দাবানলের মতো জ্বলে উঠবে।
সম্পূর্ণ গোপনে এই পত্রিকা পাঠিয়ে দেওয়া হলো রাশিয়ায়। সেখান থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হলো দিকে দিকে। অল্পদিনের মধ্যেই ইসক্রো হয়ে উঠল বিপ্লবী আন্দোলনের প্রধান মুখপাত্র। আর জার্মানিতে থাকা সম্ভব হলো না। গোয়েন্দা পুলিশের লোকজন এই সব বিপ্লবী কাজকর্ম বন্ধ করবার জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠল। বিপদ আসন্ন বুঝতে পেরে লেনিন ও তার সঙ্গীরা জার্মানি ছেড়ে পালিয়ে এলেন ইংল্যান্ডে।
একটু একটু করে যখন গড়ে উঠছে শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী দল, ঠিক সেই সময় ১৯০৫ সালে রাশিয়ার বুকে ঘটল এক রক্তাক্ত অধ্যায়। সেন্ট পিটার্সবুর্গে ছিল জারের শীতের প্রাসাদ। বন্ধ কারখানার হাজার হাজার শ্রমিক তাদের ছেলে-মেয়ে বৌ নিয়ে সেখানে এসে ধর্না দিল। জারের প্রহরীরা নির্মমভাবে তাদের উপর গুলি চালাল। দিনটা ছিল ১৯০৫ সালের ৯ জানুয়ারি। এক হাজারেরও বেশি মানুষ মারা পড়ল। রক্তের নদী বয়ে গেল সমস্ত প্রান্তর জুড়ে। এই পৈশাচিক ঘটনায় বিক্ষোভ আর ক্রোধে ফেটে পড়ল সমস্ত দেশ। গণ আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল দেশের প্রান্তে প্রান্তে।
এরই মধ্যে দেখা দিল বিশ্বযুদ্ধ। হিংস্র উন্মাদনায় মেতে উঠল বিভিন্ন দেশ। লেনিন উপলব্ধি করেছিলেন এই যুদ্ধের সুদূর প্রসারী ফলাফল। জারের লোহার শেকল আলগা হতে আরম্ভ করেছে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে।
১৯১৭ সালের ১৬ এপ্রিল দীর্ঘ দশ বছর পর দেশে ফিরলেন। তিনি এসে উঠলেন তার বোন আনার বাড়িতে।
লেনিনকে ধরবার জন্য পুলিশ হানা দিল আনার বাড়িতে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আগের দিন সেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন লেনিন। পুলিশ সমস্ত বাড়ি তছনছ করে ফেলল। এ যাত্রায় বেঁচে গেলেন লেনিন।
বিপদের গুরুত্ব বুঝে লেনিন পিটার্সবুর্গ ছেড়ে এক চাষীর ছদ্মবেশে পালিয়ে এলেন সীমান্তের কাছে ‘রাজলি’ নামে ছোট্ট এক শহরে।
কিন্তু এখানেও বিশ্রাম নেবার সময় নেই। কুঁড়েঘরে বসেই রচনা করলেন তার কয়েকটি বিখ্যাত রচনা। এখানে থেকেই তিনি লিখলেন দুটি চিঠি ‘বলশেভিকদের ক্ষমতা দখল করা সম্ভব নয়। অবিলম্বে শুরু হোক এই বিপ্লব। ’
৪.
চূড়ান্ত সময়ে ঘোষণা করা হল শত্রুপক্ষের উপর আঘাত হানার। মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিপ্লবী শ্রমিক আর রেড গার্ডের সৈন্যরা। ২৫ অক্টোবর (নতুন পঞ্জিকা অনুসারে ৭ নভেম্বর) রাত শেষ হবার আগেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব জায়গা দখল করে নিল বিপ্লবী বাহিনী। সরকারী বাহিনী বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু স্রোতের মুখে খড়কুটোর মত ভেসে গেল তারা। জারের অস্থায়ী সরকারের সদস্যরা গিয়ে আশ্রয় নিল তার শীতের প্রাসাদে।
প্রাসাদের অদূরেই সমুদ্রে দাঁড়িয়েছিল যুদ্ধ জাহাজ আরোরা। আরোরা থেকে কামান গর্জে উঠল। জারতন্ত্রের শেষ সৌধ ধূলিসাৎ হয়ে গেল।
রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করল বলশেভিক পার্টি। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই প্রথম জনগণ অর্জন করল নিজেদের অধিকার।
তারপর ঘোষণা করা হল কৃষিজমি সংক্রান্ত ঐতিহাসিক সনদ। এতোদিন দেশের সমস্ত জমির মালিক ছিল জমিদার আর ভূস্বামীরা। তাই দেশের সমস্ত জমি কেড়ে নিয়ে কৃষকদের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
কিন্তু বাধা এল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা জমিদার, ভূস্বামী, রাজতন্ত্রের সমর্থকদের কাছ থেকে। এছাড়াও দেশের মধ্যে ছিল অসংখ্য প্রতিবিপ্লবী দল। দীর্ঘ চার বছর ধরে তাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম চালাতে হয়েছে লেনিনকে। অবশেষে গড়ে উঠেছে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা।
অতিরিক্ত পরিশ্রমে স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে লেনিনের। ডান হাত-পা অসাড় হয়ে আসে। চিকিৎসায় ধীরে ধীরে সুস্থ হতেই আবার শেষ কাজ শুরু করলেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অবশেষে ২১ জানুয়ারি ১৯২৪ সালে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন সর্বহারার নেতা লেনিন।
তাই পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে যেখানেই শোষিত বঞ্চিত মানুষের সংগ্রাম, সেখানেই উচ্চারিত হয় একটি নাম- মহামতি লেনিন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৩
সম্পাদনা: এসএএস/জিসিপি