ঢাকা: ভাদ্র-আশ্বিনে খালবিলে পানি থৈ-থৈ করে। এ সময় খালবিল আর নদীতে নৌকা নিয়ে বেড়াতে বেশ আনন্দ আছে।
বিল-হাওর আছে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ আর সুনামগঞ্জ জেলায়। ফরিদপুরের গোপালগঞ্জে গেলে দেখবেন কত না বিল! বিলে নৌকায় উঠে চলে যাওয়া যায় মধুমতী নদীতে। শরত্কালে গাছপালা সবুজে সবুজে রূপ নেয়।
শরত্কালে হাওর-বিল-নদী হয়ে যেদিকে যান না কেন খুঁজে পাবেন মনোলোভা রূপ। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য ধরা দেবে বারবার নয়নসম্মুখে। শরত্কালের রূপের কি আর তুলনা হয়!

শরৎ মানেই ‘ভাদরের নদী দু’কূল ছাপায়ে কাঁদে ছলছল সুরে! যাবে যবে দূর হিমগিরি-শিরে, ওগো বাদলের পরী, ব্যথা করে বুক উঠিবে না কভু, সেথা কাহারও স্মৃতি? সেথা নাই জল, কঠিন তুষার, নির্মম শুভ্রতা, কে জানে কী ভালো বিধুর ব্যথা- না মধুর পবিত্রতা...’ কবিতার এই চরণগুলো।
একবার বন্ধু প্রতাপ বলল, নদীর দেশ ঝালকাঠিতে যাব। ওখান থেকে নৌকা ভাড়া করে দূরে- বহু দূরে গেলে কেমন হয়। বললাম, ভালই তো হয়। ঢাকার সদরঘাট থেকে স্টিমারে উঠলাম আমরা দুজনে।
সকাল ৮টায় স্টিমার ভিড়ল ঝালকাঠিতে। নেমেই মনে পড়ল, গাবখান নদী আর ধানসিঁড়ির কথা। বাল্যবন্ধু প্রতাপ বলল, দেখো দেখো শরতের রূপ-শরৎ কত বিচিত্র! ঝালকাঠির পাশেই সুগন্ধা নদীর একটি শাখা চলে গেছে বরগুনার দিকে, আরেকটি চলে গেছে গাবখান নদী হয়ে পশ্চিমে।
মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম, গাবখান নদী হয়ে দূরে পশ্চিমে চলে যাব, যাবেন তো? মাঝি একটু হেসে বলল, কেন নয়? প্রতাপ বলল, শুনুন, কোথাও ভালো লাগলে কূলে নেমে পড়ব। দেখে নেব গ্রামবাংলার রূপ। দেখব পাখি, শুনব পাখির ডাক।
আরও দেখব কলসীকাঁখে রমণী নদীতীরে এসে জল ঢেলে জল ভরছে- আহা এমন দৃশ্য দেখতে কীই না ভালো লাগবে। মাঝি একটু হেসে বলল, বুঝেছি, আপনারা সফরে এসেছেন। নৌকা যেখানে যেখানে রাখতে বলবেন, সেখানেই না হয় রাখব। তবে নির্জন বনপথে যাবেন না। কথাটা শুনে ভয়ে একটু আঁতকে উঠলাম।
আমরা সুগন্ধা নদী ছাড়িয়ে গাবখান নদীতে এলাম। মাঝি বলল, ওই যে দেখুন ধানসিঁড়ি নদী। প্রতাপ একটু ভেবে বলল, হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে/তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে...।
মাঝি একটু হেসে বলল, তা চিল দেখলেন কোথায়? চিলটিল হারিয়ে গেছে। কোথাও যে চোখে পড়ে না। শৈশবে কত দেখেছি সোনালি ডানার চিল...। প্রতাপ বলল, জীবনানন্দ দাশের সেই সোনালি ডানার চিল আজ শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে হয়তো বেঁচে আছে চিড়িয়াখানায়। তাই তো দুঃখ করে বলতে হয়, পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে...।
আমাদের নৌকা প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে এসে পৌঁছাল কাউখালির কাছে। একটু পরই কচা নদী। কাউখালিতে নেমে এক হোটেলে ঢুকে ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে নিলাম। তখন দুপুর দুটো বেজে গেছে।

বললাম, এই প্রতাপ, নৌকায় ওঠো। কথাটা শুনে মাঝি হেসে বলল, বাহ্! নামটা তো খুব সুন্দর! জানেন, শৈশবে একটা ছবি দেখেছিলাম...। বললাম, কী ছবি? মাঝি বলল, ওই যে ‘চন্দ্রশেখর’।
ছবির নায়কের নাম ‘প্রতাপ’। তার বাল্যবান্ধবী ছিল শৈবালিনী। একটি দৃশ্যে প্রতাপকে না পেয়ে শৈবালিনী নদীতে ডুবতে গিয়েছিল। পরে প্রতাপ এসে তাকে বাঁচিয়েছিল। জানেন, কাহিনী অনুযায়ী প্রতাপ আর শৈবালিনীর মিলন হয়নি।
তা দাদা, আপনার স্ত্রীর নামও কি শৈবালিনী? প্রতাপ একটু রেগে সিনেমার কাহিনী বাদ দেন-শৈবালিনী আমার স্ত্রী হতে যাবে কোন দুঃখে? মাঝি একটু হেসে বলল, আপনি যে কী বলেন, শৈবালিনী কত সুন্দর গান করত।
আজও যে ভুলিনি তার গাওয়া-‘ভাসিয়ে দিলেম মালা, তবে প্রিয় যাই চলে, তুমি যদি আসিবে না, এ মালা নেবে না গলে...। ’ ইস্! এই গান কি জীবনে ভুলব!
কচা নদী পেরিয়ে নৌকা এলো হুলারহাটে। লঞ্চঘাটের পশ্চিমে দামোদর খালের মুখ। এই খালটি এঁকেবেঁকে চলে গেছে বলেশ্বর নদীতে। কচার ওপারে মেঘপাল, শ্রীরামকাঠি, সুবিধপুর, চিড়াপাড়া, পাঙ্গাশিয়া। আহা কত গাঁও কত নাম!
দামোদর খাল হয়ে নৌকা চলছে। দেখি দুই কূলে চাম্বল, গজারি, সেগুন আরও কত গাছ। বাঁ দিকে পিচঢালা পাকা সড়কের ওপর দিয়ে চলছে স্কুটার, টেম্পো, রিকশা- বাস-ট্রাকও দেখলাম। মাঝি বলল, ওই যে ট্রাক- ওগুলো এই রাস্তার বারোটা বাজাচ্ছে। ছোটবেলা দেখেছি, কী মসৃণ পিচঢালা ওই পথ।
রাস্তাটা তৈরি হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। সৈয়দ আফজাল মিয়া না হলে রাস্তাটা হতো কিনা সন্দেহ। তিনি দেশের অনেক উন্নয়ন করে গেছেন। এদিকে দেখি গাছে গাছে কত পাখি। বহুদিন পরে পাখির কলরবে মুগ্ধ হলাম।
প্রতাপ একটা পাখি দেখিয়ে বলল, দেখো ওই সে শ্যামা...। কত নাম শুনেছি শ্যামার আজ এই প্রথম দেখা, মনটা আনন্দে উত্ফুল্ল হয়ে উঠল। তখন বাল্যবন্ধু প্রতাপের আনন্দকে দেখে... লাফিয়ে লাফিয়ে বলল, ‘ওহ্ শ্যামা, ওহ শ্যামা...। ’
মাঝি বলল, ‘ওই যে পথটি দেখছেন, ওই পথ ধরেই পলিশা, মুলগাঁও, তেজদাস কাঠির দিকে যাওয়া যায়। আর দক্ষিণ দিকে হরিণা, গাজীপুর-ওদিকে না যাওয়াই ভালো। শুনি প্রায়ই ছিনতাই হয় হরিণা-গাজীপুরের দিকে। নৌকা থেকে নেমে প্রতাপ আর আমি উত্তরের পথ ধরে এগিয়ে চললাম। আঁকাবাঁকা পথ-যেদিকে তাকাই দেখি সবুজের আদিগন্ত সাগর। গাছে গাছে পাখি।
প্রতাপ বলল, দেখো ওই যে বিল। কত পাখি উড়ে এসে ওখানে বসেছে। শরতের রূপকে ওরা যে অপরূপ করে তুলেছে। শেষ বিকালে দেখো প্রেমিক-প্রেমিকা হাতে হাত রেখে যেন গান গাইছে। বাহ! তাই তো! জিজ্ঞেস করলাম, কী গান?
প্রতাপ বলল, কী আর গাইবে ওই যে, অনাদিকালের স্রোতে ভাসা মোরা দুটি প্রাণ নয়নে নয়ন রাখি’ নয়তো অন্য কিছু। ৫০ বছর আগে ইরা টকিজে ছবি দেখতে গিয়ে এই গানটা শুনেছিলাম, আজও তা ভুলিনি। এবার আমরা ফিরে এলাম দামোদর খালের কাছে। মাঝি গামছাটা কোমরে বেঁধে বৈঠা বাইতে শুরু করল।
মাঝি বলল, এই যে দামোদর খালটা আজ প্রায় মৃত। পৌষ-মাঘ-ফাল্গুন মাসে এলে এই খালে নৌকা ঢুকতেই পারত না। একশ্রেণির লোক ময়লা-আবর্জনা ফেলে ফেলে এই খালটার বেহাল দশা বানিয়েছে। এদিকে পলি জমেও খালটা বিলীন হতে চলেছে।

আগে তো নিকটবর্তী লোকজন এই দামোদর খালেই স্নান করত। রাস্তাঘাট যখন ছিল না তখন তো এই খালটিই ছিল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। ওই সময় তো শুধু নৌকাই চলত।
বাবার মুখে শুনেছিলাম, একদা দামোদর ছিল নদী- তখন বড় বড় নৌকা, বজরা, মালটানা নৌকা, কত সব পালতোলা নৌকা চলত এই দামোদ্দরের বুক দিয়ে। রায়েরকাঠির জমিদাররা দামোদর নদী, দরাটনা, রূপসা, বলেশ্বর, ভৈরব- আরও কত নাম না জানা নদী হয়ে চলে যেতেন কলকাতায়।
সেই জমিদাররা নেই, জমিদারি আমলও ফুরিয়ে গেছে। তাদের নির্মিত অনেক বাড়ি ছিল, ধ্বংস হয়েছে আবার দখলও নিয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
সত্যেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরীর কাছারিবাড়ি দখল করে স্থাপিত হয়েছে ‘মহিলা কলেজ’। অথচ ওরা কলেজের নামটি পর্যন্ত দেয়নি সত্যেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী নামে। বলুন, কত আর শোনাব অনুশোচনার কথা। তাদের কথা কেউই মনে রাখেনি। এ প্রজন্ম জানেই না তাদের অতীত গৌরবময় কাহিনী।
কথাগুলো শুনে মনে পড়ল আমার শৈশবের কথা। পিরোজপুর শহরেই আমার বাবা চাকরি করতেন। সেই কবে প্রায় ৫০ বছর আগে কুমারখালি হয়ে শিকারপুরে এসেছিলাম। মাটির মেঠোপথের দুই দিকে দেখেছিলাম কামিনী, কদম, জুঁই, চামেলি, হাসনাহেনা, রজনীগন্ধা ফুল গাছের ছড়াছড়ি।
ভাবলাম- এই পথ হয়ে পায়ে হেঁটে ঘুরে আসি... দেখি না সেই পথ আজ কেমন! প্রতাপ বলল, চলো ওই দিকটায়। জনপথ নয়, এবার পিচঢালা পথ ধরে। দেখি এদিকে-ওদিকে নতুন নতুন বাড়িঘর। ফসলের জমি ধ্বংস করেই স্থাপিত হয়েছে নতুন নতুন ঘরবাড়ি। দেখি ছেলেপুলের হাতে মোবাইল... কত পরিবর্তন! সব যেন আধুনিক।
নৌকা এসে গেল পিরোজপুর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের কাছেই। স্কুলটা দেখিয়ে প্রতাপ বলল, একদা এটা ছিল দেবেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরীর বাড়ি। সেই স্মৃতি আর নেই। আজ যারা আছে তারাও একদিন থাকবে না। খালের ওপারে রাজারহাট। কত বাড়িঘর। কাউকেই দেখি না খালের ঘাটে।
এখানে আসবেই বা কেন, খাল তো প্রায় শুকিয়ে গেছে। ওদিকে বাড়ি বাড়ি সাপ্লাইয়ের পানি যে পৌঁছে গেছে। ইস! এক সময় এখানে প্রতিটি বাড়ির পেছনে ছিল ঘাট। কলসিকাঁখে আসত বধূরাও। মনে আছে, সে তো ৫০ বছর আগের কথা।

চপলা আর লীলা দুই বোন। ওরাও কলসিকাঁখে জল নিতে আসত। চপলার কণ্ঠে কতবার শুনেছি, ‘ওরে ও বিদেশি বন্ধু, ও তুই গাঙ্গের কূলে ও যে সাঁঝের বেলায়/রোজ বেয়ে যাস তরী, আমি একলা ঘাটে বসে যে ভাবি ভাসায়ে ঘাঘড়ি... ভাটির টানের সাথে সাথে তোর ভাটিয়াল সুরে সাধের কাজল যায় ধুয়ে গো নয়ন আমার জুড়ে আর যে ঘরকে যেতে মন, মন মানে না গো, আমি জল ঢেলে জল ভরিরে...’ এই গানখানি।
চপলা ভালো গান করত। তখন প্রশ্ন জাগল-সেই চপলা কোথায়? কোথায় সেই খরস্রোতা দামোদর খাল! প্রতাপ বলল, দেখো দেখো, ওই যে মাছরাঙা পাখি... মাছ শিকারের জন্য ওঁত্ পেতে রয়েছে। আর কি ফিরে পাব সেই দিন সেই মধুক্ষণ।
কূলে দাঁড়িয়ে মনে পড়ল সেই রাস্তাটির কথা। স্কুলের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে ওই যে দক্ষিণে। এরই মাথায় ছিল ৫টি বাড়ি। আমার বাবা আমির হোসেন মিয়ার বাড়ির চারদিকে বাগান। প্রায় এক বিঘা জায়গা নিয়ে বাড়িটি। পাশেই ছিল আহসান মিয়া ও জাফর মিয়ার বাড়ি, জিন্নাত মিয়া নাজির সাহেবের বাড়ি, মোদাচ্ছের মিয়ার বাড়ি আর লতিফ মাস্টারের বাড়ি।
এ নামের কেউই আজ বেঁচে নেই। ভ্রমণে এসে তাদের কথা মনে পড়ায় মনের যাতনা আরও যে বেড়ে গেল...।
মাঝিকে টাকাপয়সা বুঝিয়ে দিয়ে এবার বাস ধরে চললাম ঢাকার পথে। তখন বারবার মনে পড়ল, ‘বন্ধু আমার! থেকে থেকে কোন সুদূরের নিজনপুরে। ডাক দিয়ে যাও ব্যাথার সুরে? আমার অনেক দুঃখের পথের বাসা বারে বারে ঝড়ে উড়ে ঘর ছাড়া তাই বেড়াই ঘুরে’ কবিতার এই চরণগুলো।
কীভাবে যাবেন

নৌকা ভাড়া ৭০০ টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকা পড়বে। খাওয়া-দাওয়া খরচ ৫০০ টাকা। ফিরতি পথে বাস ভাড়া ৫০০ টাকা। সব মিলিয়ে খরচ পড়বে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। দুজন একত্রে গেলে খরচ কমে আসবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৩
এসএস/এসআরএস