ঢাকা: নদীও ভাগ হয় দু’দেশের মধ্যে। যেমন ভাগ হয়েছে দক্ষিণবাংলার ইছামতি।
এই সামান্য বাধাটুকু খুলে যায় শুধু বছরের একটি সময় ঘণ্টা কয়েকের জন্য। সেটা দুর্গা পূজার বিজয়া দশমীর দিন। সাম্প্রাদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশে এদিনটি হয়ে ওঠে সবার। ছেলেবেলায় এদিনটির জন্য অপেক্ষা করতাম সারা বছর। কবে আসবে দুর্গা পূজা!
অপেক্ষা শুধু এটার নয়, কবে পাশের বাড়ির বৌদির বাড়ি অষ্টমীর দিন লুচি, সবজি, ডালনা, খই, আখ আর নারিকেলের মজাদার নাড়ু খাবো সেটারও। সাধারণত মাসখানেক আগে থেকেই শুরু হতো আমাদের পাশের মণ্ডপের মূতি বানানোর কাজ। স্কুল থেকে ফেরার পথে তখন প্রতিদিনের রুটিন ওয়ার্ক ছিল ঠাকুর বানানো কতদূর এগুলো সেটা দেখার। এর পেছনে অবশ্য আরো একটা কারণ ছিল। এলাকার ৮ কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ৫টি মণ্ডপ তৈরি হতো প্রতিবছর। এখনো হয়। তবে কাদেরটা ভালো হয় সেটার একটা প্রতিযোগিতা তো বরাবরই থাকতো। কখনো মনে হতো না এটা হিন্দুদের, আমার দেখে লাভ কি। বাবা-মাও বাধা দিতেন না। দেবেনই বা কেন, উৎসব, অনুষ্ঠান তো মানুষের সম্প্রীতি বাড়ায়।
মজার ব্যাপার ছিল আমাদের বাজারের দুর্গা প্রতিমাটি প্রতিবছর হতো সুন্দর শান্ত চেহারার। আর অন্য প্রতিমাগুলো বানাতো কিছুটা রুদ্রমূর্তির। কেন জানি এজন্যই আমার সবচেয়ে পছন্দ ছিল এটি।
ষষ্ঠীর দিন জমে যেত পূজার বাজার। এই বাজার নিয়ে উৎসাহ ছিল বোধহয় সবচেয়ে বেশি। প্রতিবছর এসময় ৭ টাকা দিয়ে একটি পিস্তল আর একটাকা দিয়ে চার বক্স বাজি কেনার জন্য টাকা জমিয়ে রাখতাম। সঙ্গে বাজার থেকে মাটির ঠেলাগাড়ি আর ড্রাম গাড়ি টেনে বাজাতে বাজাতে পাড়া মাথায় করা। সবচেয়ে ভালো আখটা বাজারে পাওয়া যেত এসময়। বিশেষ করে দশমীর দিন। মোটা, লম্বা, মিষ্টি সামসাড়া ও চিনিচাপা আখ, কখনো কখনো কাজলা আখও।

খুব মজা পেতাম এবং আগ্রহভরে দেখতাম কীভাবে প্রতিদিন তুলির আঁচড়ে বদলে যেতো দুর্গা, অসুর, সিংহ, গণেশের রূপ। মহিষাসুর এবার কেমন হলো সেটাও ছিল একটা বড় আগ্রহের বিষয়।
দুর্গাকে প্রসাদ দিলে নাকি খেয়ে ফেলে-এটা জেনে অনেকবার চেষ্টা করেছি কীভাবে খায় সেটা দেখার কিন্তু সফল হতে পারিনি কোনোদিন। কিছু প্রতিমা আবার এভাবেই তৈরি হতো যে, সিংহের মাথা ঘুরছে, নড়ছে মা দুর্গাও। মাঝে মাঝে তখন ভাবতাম এটা বুঝি সত্যিই!
পাশের বাড়ির বন্ধু এবং বন্ধুর মা খুব যত্ন করে খাওয়াতেন অষ্টমীর দিন। আর স্কুলের বন্ধুর মায়েদের কাছে দাবি থকাতো চিনি দিয়ে তৈরি নারকেলের নাড়ু আর রসগোল্লা খাওয়ার।
অষ্টমীর পরেই আলোচনায় আসে মা এবার হাসতে হাসতে যাবেন, না কাঁদতে কাঁদতে যাবেন। বৃষ্টি হলে কান্না, আর রোদ হলে হাসি। সন্ধ্যার পর নদীতে করে নৌকায় আলো জ্বেলে ঘোরানো ছিল দশমীর অন্যতম আকর্ষণ। আর বিকেল থেকে শুরু হতো এবার জলের সীমা ভেঙে ওপার বাংলার মানুষগুলো দেখা যাবে কিনা।
সবচেয়ে বড় আকর্ণ এটা। নদীতে অসংখ্য নৌকা। সব নৌকায় বাজছে লেটেস্ট হিন্দি, বাংলা ছবির জনপ্রিয় গান। নৌকায় প্রতিমার সঙ্গে প্রতিমা মুখের নারীও কম নয়। সবার গন্তব্য ইছামতি। নদীর দু’পারে চোখ মেলে বসে হাজার হাজার নারী-পুরুষ। কেউ এসেছেন ভিন্ন দেশে যাওয়ার স্বাদ নিতে, কেউ আত্মীয়-স্বজনকে একটিবার চোখের দেখা দেখতে। এরই মধ্যে চলতো দুদেশের মানুষের এক নৌকা থেকে আরেক নৌকায় খাবার ছোড়াছুড়ি।
নদী পেরিয়ে যখন ওপার বাংলায় পা রাখতাম, তখন মনে হতো সবই তো এক, এক ভাষা, মানুষ দেখেতে একইরকম, পার্থক্য শুধু ভাষার টানে। ভারতের চকলেট ছিল সবচেয়ে মজার। অনেক কিনতাম সেটি। আর ওপার বাংলার মানুষ পছন্দ করতো আমাদের দেশের আখ।
এদিনটি উপভোগ করতে দু’এক বছর যেতাম বিভূতিভূষণের বিখ্যাত টাকি, ভাতশালা, শ্রীপুরে। আমার নানুবাড়ি সেখানে। ইছামতির পাড় দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে, সেখান থেকে নদীর ওপারের মানুষের হাঁটাচলা, সন্ধ্যার আলোজ্বলা সবই দেখা য়ায়। শোনা যায়, গান বাজনা।
পূজার বাজার আর দুপারের মানুষের মেলবন্ধনে পুরো আবহাওয়াটাই হয়ে উঠতো অন্যরকম। নদীতে যখন নৌকাগুলো ভাসতো তখন পতাকার দিকে না তাকালে বোঝা যেতে না, আসলে আমাদের কোনো দেশ, জাতি ভেদ আছে। তখনও মনে হতো, এখনো মনে হয় সবার উপরে তো আমরা মানুষ, আমরা বাঙালি। এটাই বড় পরিচয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৩
এএ/এসআরএস