ঢাকা: কুশিয়ারা নদী। এপারে অর্থা ৎ পশ্চিম পাড়ে বাংলাদেশের জকিগঞ্জ।
ওই নদী তীরে পর্যাপ্ত পানি থাকায় পাখিরাও সেখানে ফিরেছে। বিকালেই ওখানে পাখিদের ভিড় থাকে। মেহেবুব চৌধুরী স্থানীয় এক কলেজে পড়ে। ওর বাড়িতেই উঠলাম। পায়ে হেঁটে এলাম কুশিয়ারা তীরে।
গত রাতে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে এখানে আসা তারপর ১৫ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। ভাবলাম, কী-ই না এক নির্জন বনপথে এলাম। এখানে নেই কোনো কোলাহল। এ নির্জনতায় মন উদাস হয়।
বাহ্, এখানে তো দোল দিয়ে যায় সোনার ধানের শীষে। ঝিরঝির মেঠো হাওয়ায় নদীর বুকে ঢেউয়ের খেলা...। দেখতে পেলাম তীরে তীরে এখানে কতই না নির্জনতা। রঙিলা নায়ের মাঝি নৌকা বেয়ে বরাক নদীর ওপারে যাচ্ছে, যাদের ভিসা আছে তারাই যাবে ওই যে করিমগঞ্জে।
মেহেবুব চৌধুরী বলল, প্লিজ দাঁড়ান দাঁড়ান, কুশিয়ারার তীরে। ছবি তুলব। আপনার পেছনে থাকবে ভারতের করিমগঞ্জ। বললাম, কেন করিমগঞ্জে গিয়ে কি ছবি তুলতে পারি না?
হাসল মেহেবুব- দেখুন দেখুন, কুশিয়ারা নদী। অচেনা এক বৃদ্ধলোক এসে গাইতে লাগল :
‘দুটি পাখি দুটি তীরে মাঝে নদী বহে ধীরে/একই তরু শাখা পড়ে ছিল বাঁধা লীলাভরে/অজানা সে কোন ঝড়ে ভেঙে নিলো বাসাটিরে/বিধাতার অভিশাপ নিয়তির হলো জয়/ছিঁড়িল বীণার তার মুছে গেল পরিচয়/ছিল যেথা আলো হাসি ফুলফল মধু বাঁশি/আজি সেথা কিছু নাহি বায়ু কেঁদে যায় নীড়ে/দুটি পাখি তীরে...’
গানটা শেষ হতেই দেখি তার দুই চোখ বেয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। জিজ্ঞাসা করলাম কেন কাঁদছেন? জানালেন, এই জকিগঞ্জে আমার বাড়ি, ওই যে নদীর ওপারে করিমগঞ্জে আমার বহু আত্মীয়-স্বজন রয়ে গেছেন।
যেতে লাগে ১০ কি ১২ মিনিট; কিন্তু যেতে পারছি কোথায়? করিমগঞ্জ ভারতের আসাম রাজ্যের অন্তর্গত।
পাসপোর্ট ভিসা ছাড়া গেলে জেলে যেতে হবে! বড় অসহায় আমরা এই সীমান্তেই বসবাস করছি। মেয়েটা ওই করিমগঞ্জে থাকত, মৃত্যু সংবাদ শুনেও ওকে শেষ দেখা দেখতে পারিনি। দেশ ভাগ...।
কথাগুলো শুনে কোন উত্তর দিতে পারিনি। বৃদ্ধ ভদ্রলোকটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে চললাম। মেহেবুব বলল, দেখুন ওই যে শঙ্খচিল উড়ে যাচ্ছে করিমগঞ্জের দিকে। বলতে পারেন, ওরা কোন দেশের নাগরিক!
ওদের নাগরিকত্ব লাগে না, আইডি কার্ডও লাগে না। ওরা যে স্বাধীন! ইস্ শঙ্খচিল হলে হয়তো আপনিও এপার থেকে ওপারে যেতে পারতেন।
নদীতীরে এক গাছের তলায় গিয়ে বসলাম। দূর থেকে দেখে যাচ্ছি করিমগঞ্জ। নামটাও বেশ সুন্দর! মেহেবুব বলল, এপারে ‘জকি’ ওপারে ‘করিম’। কতই না ওদের মিল। মানুষ, দেশ আর রাষ্ট্র ওদের মিলনে যেন বাধা হয়ে দাঁড়াল।
যে জন্য আজ করিমগঞ্জে যেতে পারলেন না। নদী তীর হয়ে হয়ে আমরা এবার উত্তর পশ্চিম দিকে এগোতে লাগলাম। ওই দিকেই তো মেহেবুব চৌধুরীর বাড়ি।
বলল, উত্তরে কানাইঘাট উপজেলা, দক্ষিণে বিয়ানীবাজার। আজ সন্ধ্যার পরে ফুফুবাড়ি নিয়ে যাব। ফুফু একাই থাকেন, তার ছেলে-মেয়ে সবাই থাকে লন্ডন, নিউইয়র্কে। বাড়ি খাঁ-খাঁ করছে। ভীষণ শূন্যতা তার। গেলে ফুফু খুশি হবেন। আপনাকে যথেষ্ট আদর আপ্যায়ন করবেন।
জকিগঞ্জের গাঁয়ের পথ ধরে এগিয়ে চলছি। দেখি কত সুন্দর সুন্দর একতলা-দোতলা বাড়ি। টিলার ওপরও কত রঙ-বেরঙের অট্টালিকা। মেহেবুব বলল, জানেন, এসব বাড়িতে বাড়িওয়ালা তো নয়ই, তার ছেলেমেয়েরাও থাকে না। কেউ আছে লন্ডন, কেউবা দুবাই, আমেরিকা।
দেখা-শোনার জন্য কোথাও কেয়ারটেকার নয়তো তালামারা রয়েছে বাড়িঘরগুলো। যেদিকে চোখ যায় দু’চোখ যেন খুঁজে পায়‘মঙ্গল ফুলে জমেছে মৌ/হিজল ডালে ডাহুক ডাকে/ঝিকিমিকি ঝাউয়ের ফাঁকে/বাদামি রোদ ঝলকে/দোপাটিতে খোঁপাটি সাজাও’ গানের এই কথারই প্রতিচ্ছবি।
হঠাৎ দেখি পরপর কয়েকটি কামিনী ফুল গাছ- ফুলের শুভ্র ঘ্রাণে মন উতলা হয়ে উঠল। ভাবলাম, বেড়াতে এসে সমুদ্র দেখছি না, ঐতিহাসিক স্থাপত্য কীর্তিও নেই এখানে, তাতেই-বা কী! বাংলার নয়নলোভা সৌন্দর্য তো মিলেছে এই জকিগঞ্জে এটা বড় দেখা নয় কি!
মেহেবুব বলল, জানেন, আমার একটা ড্যান্স দল আছে, নাম ‘মেহেবুব ড্যান্স গ্রুপ’। আমি ও আমার দলের ছেলেরা ব্রেক ড্যান্স করি। আপনার কি ভালো লাগে না ব্রেক ড্যান্স? বললাম, কেন নয়!
একটু হেসে মেহেবুব বলল, হিন্দি গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করি আমরা। সিলেটে কোনো ফাংশন হলে সেখানেও আমাদের ডাক পড়ে। ‘তুমি তো বেশ মজার মানুষ!’
হাসল মেহেবুব। বয়স সতেরো চলছে, দোয়া করবেন, বড় নৃত্যশিল্পী যেন হতে পারি! বাবা তো থাকেন লন্ডনে, আমাকে লন্ডনে নিয়ে যেতে চান। আমার ইচ্ছে নেই! হঠাৎ দেখি এক গাছের ডালে বসে আছে একটি ছেলে।
তার দিকে তাকাতেই একটু হেসে গান ধরল- ‘পলাশ বনতল উড়েছে কেন আজ/পুলকে ঝলমল রাঙা ফুল সাজ/ওগো মিতা জান কি তা/দখিনা সমীরণ কেন যে বযে যায়/আবেশে তনুমন বিত্তবল হয়ে যায়/ভ্রমর গুঞ্জন কি কথা কয়ে যায়...। ’
গানটা শেষ হতেই একটু এগিয়ে গিয়ে বললাম এই ছেলে তোমার নাম কী?—‘স্বপন চৌধুরী’। ওই যে ছেলেটা আপনার সঙ্গে দেখছি ও কিন্তু ব্রেক ড্যান্সার আর আমি হলাম ক্লাসিক্যাল ড্যান্সার।
তা যাবেন নাকি করিমগঞ্জে নিয়ে যাব। ও পারবে না, আমি পারব...। মেহেবুব একটু উত্তেজিত হয়ে বলল- অবৈধভাবে উনি কেন যাবেন সীমান্তের ওপারে ওই করিমগঞ্জে।
জকিগঞ্জের সৌন্দর্য কি আর কম! স্বপন চৌধুরী এবার বলল, বাড়িতে আসবেন কিন্তু। নাচ দেখাব! ক্লাসিক নাচের মজাটাই ভিন্ন। ওই যে টেলিভিশনে সোহেল আর শিবলি নাচে, ওদের মতোই কিন্তু আমি নাচতে জানি। ওর কথাগুলো মনে বেশ দাগ কাটল। মনে মনে হাসলাম।
সন্ধ্যা হতেই মেহেবুবের সঙ্গে চললাম ওর ফুফুর বাড়ির দিকে। মিনিট পনেরো পর এলাম বাড়ির সামনে। দোতলা বিল্ডিং, সামনে কদম গাছ। অপরদিকে শেফালি, বকুল জুঁই গাছও রয়েছে। কেয়ারটেকার দরজা খুলে দিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল।
মেহেবুবকে কাছে পেয়ে তার ফুফু বুকে জড়িয়ে ধরলেন। মেহেবুব বলল, ফুফু এই যে একজন অতিথিকে নিয়ে এলাম। খুব ভালো লাগবে ওনাকে। ভদ্রমহিলা একটু হেসে বললেন, নিঃসঙ্গ জীবন কাটছে আমার।
ছেলেপুলে সবাই লন্ডনে। বছর তিনেক পর ওরা আসে, আবার কখনও আসতেও পারে না। মরে গেলে ওরা আমাকে শেষ দেখাও দেখতে পাবে না। কথাগুলো শুনে ব্যথিত মনে জিজ্ঞেস করলাম, নিকটাত্মীয় কেউ কি আপনার এখানে নেই?
থেকেও যেন নেই- কেউই এখানে আসে না। দুই বোনের একজন করিমগঞ্জে, অপরজন শিলচরে রয়ে গেছে ওই দুই জায়গা তো ভারতে। যেতে হলে পাসপোর্ট ভিসা কত কী প্রয়োজন!
রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বসে আছি। আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নাম? একটু হেসে বললেন-‘সুরাইয়া চৌধুরী’। দুলাভাইরা বলতেন, আমি নাকি দেখতে অবিকল চিত্রনায়িকা সুরাইয়ার মতোই।
তাদের সঙ্গে একবার সিলেটের ‘দিলশাদ’ ছবিঘরে গিয়ে সুরাইয়ার অভিনীত ‘আননোন ঘড়ি’ ছবিটা দেখেছিলাম। সেই স্মৃতি আজও যে ভুলিনি, বলুন কী করে ভুলি। কত বছর আগের কথা।
বড় বোনের বাড়ি শিলচরে, বারতিনেক ওখানে গিয়েছি। বরাক নদীর তীরে শিলচর বাঙালিপ্রধান শহর। আসামের কাছাড় জেলার সদর দফতর ওখানে। শিলচর দেখার পড়ে দুলাভাই ও বোনের সঙ্গে একবার ডিব্রুগড়ে গিয়েছিলাম। আসামের বাণিজ্যিক শহর। যা চা-বাগিচায় ঘেরা। ডিব্রুগড়ও বাঙালি অধ্যুষিত শহর। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র নদ। সেখানেই একবার পরিচয় হয়েছিল সিলেটের ইনাম আহমেদের সঙ্গে।
তখনও তিনি অভিনেতা হননি। ওখানে একটা কোম্পানিতে চাকরি করতেন। সে তো প্রায় ৬০ বছর আগেকার কথা! সেদিন তো আর ফিরবে না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যে অনুশোচনা থেকে যাবে।
বৃদ্ধার অতীত দিনের কথাগুলো শুনে ভাবলাম, মানুষের জীবনটা কী? তার সবাই আছে, অথচ কেউ পাশে নেই। দূরে, বহুদূরে চলে গেছে। পরদিন বিকালে মেহেবুব, তার ফুফু সুরাইয়া চৌধুরী ও আমি এলাম কুশিয়ারার তীরে।
একূল-ওকূল দেখছি। হঠাৎ দেখি সুরাইয়া চৌধুরী একটু আনমনা হয়ে গানের ভাষায় জানালেন ‘তুমি আকাশের পারে আছো/আমি মাটির কাছাকাছি/কত ফুল গেছে ঝরে/তবুও আমি জেগেই আছি। ’
এই গানটা শৈশবে শুনেছিলাম দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে। এই কুশিয়ারার পাড়ে এসে আবারও যে মনে পড়ল সেই স্মৃতি...।
যারা জকিগঞ্জ যাবেন : ঢাকা থেকে সিলেটে সড়কপথে বাসে এবং ট্রেনে যাওয়া যায়। বাসের নাম শ্যামলী, সোহাগ, ইউনিক, গ্রিনলাইন। সময় লাগে প্রায় ৮ ঘণ্টা। ভাড়া ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা।
সিলেটের কদমতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে জকিগঞ্জগামী ‘দ্রুতযান’ পরিবহনে উঠুন। সিলেট থেকে জকিগঞ্জ যাতায়াতে সময় লাগে প্রায় ২ ঘণ্টা। ভাড়া ৮০ টাকা।
রাত্রিযাপন করার জন্য জকিগঞ্জে রয়েছে ‘লাকি বোর্ডিং’সহ কয়েকটি আবাসিক হোটেল। জকিগঞ্জে দর্শনীয় তিন নদীর সংযোগস্থল যেমন বরাক, সুরমা, কুশিয়ারা; ফুলতলির অলির মাজার; সীতালং শাহর মাজার, পাহাড়, টিলা, অরণ্য ও ঝরনা।
এ ভ্রমণে জনপ্রতি ৩ হাজার টাকা করে নিয়ে গেলেই চলবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০১৩,
এসএস/এমজেডআর