ঢাকা, শনিবার, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৭ মে ২০২৫, ১৯ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

সূর্য দেখব বলে

শাকিল ফারুক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৫০, জানুয়ারি ৯, ২০১১
সূর্য দেখব বলে

বাসের ইঞ্জিন চালু হওয়ার শব্দের মধ্যেও যে কোনও সুরেলা বিষয় থাকতে পারে, জানা ছিলো না। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের প্রায় ঘণ্টাদুয়েক বাদে যখন বাসটা চলতে শুরু করলো, ইঞ্জিনের শব্দটাকে তখন বেশ শ্রুতিমধুরই মনে হলো!

কথা ছিলো রাত সাড়ে ১০টায় সবাই হাজির হবেন ছবির হাটের সামনে।

ঠিক ১১টায় এখান থেকে শেরপুরের উদ্দেশে রওনা হবে বাস, এমনটাই জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারন সম্পাদক মিলন ভাই। অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন গত ১১ বছর ধরে আয়োজন করছে সূর্য উৎসবের। বছরের শেষ সূর্যাস্ত এবং নতুন বছরের প্রথম সূর্যোদয় দেখতেই এই উৎসব। একেক বছর দেশের একেক অঞ্চলে উৎসব আয়োজন করা হয়। সে ধারাবাহিকতায় এবার শেরপুরে সূর্য উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। আমি অবশ্য অনাকাক্সিক্ষতভাবেই জুটে গেলাম উৎসবে, অফিসিয়াল অ্যাসাইন্টমেন্টের বদৌলতে।

মিলন ভাই আরো জানিয়েছিলেন, শেরপুরে এখন খুব শীত। রাতে ঘুমোতে হবে তাঁবুতে। সেহেতু সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র। আমি মোটামুটি উত্তরমেরু যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রওনা হয়েছি। সাতান্নজন মানুষের জন্য দুটি বাস। বেশির ভাগ মানুষই উঠে গেছেন প্রথম বাসে। দ্বিতীয় বাসে তাই বেশ আরাম করে বসা গেছে। আমার পাশের সিটে বসেছেন গাজী মুনছুর আজিজ।

বাস চালু হতেই একটা ঝিমুনি ভাব চলে এল। বাসের জানালার ফাঁক-ফোঁকর গলে আসা কনকনে ঠান্ডা বাতাসে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খবর পাইনি। হঠাৎ করেই ঘুম ভাঙলো। বাস যে থেমে আছে, তা বুঝতে একটু সময় লাগলো। তবে এখানে যে যাত্রাবিরতি দেওয়া হয়েছে তা বুঝতে সময় লাগলো না। আজিজ এবং আমি বাস থেকে নামলাম। আমাদের আগেই বাকিরা নেমে পড়েছেন। ময়মনসিংহের চুরখাই এলাকা এটা। রাস্তার পাশে রেস্টুরেন্ট থেকে হালকা নাশতা সারছেন সবাই। আমরাও সেই পথ অনুসরণ করলাম। তারপর উঠে বসলাম বাসে। অন্য সময় হলে জানালার দিকে তাকিয়ে রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করা যেত। কিন্তু এখন কুয়াশা ছাড়া কিছুই দেখার সুযোগ নেই। তাই আবারও ডুব দিলাম ঘুমে।

ঘুম ভাঙল ৩১ ডিসেম্বর সকাল ৮টায়। বাস তখন থেমেছে লাউচাপড়া পিকনিক স্পটে। পিকনিক স্পটের প্রবেশপথের ফলক দেখে অবাক হলাম। কারণ আমাদের শেরপুর যাওয়ার কথা, কিন্তু এটা তো জামালপুর! কারণটা অবশ্য জানা গেল না। সারা রাতের ভ্রমণকান্তি সে বিষয়ে আগ্রহও জাগালো না তখন।

শুরুতে জানানো হয়েছিল, রাত্রিযাপন করতে হবে তাঁবুতে। কিন্তু এই পিকনিক স্পটে থাকার জন্য তিনটি কটেজ দেখা গেল। সবচেয়ে বড়ো এবং আধুনিক কটেজটার দিকেই রওনা হলাম সবাই। তবে মিলন ভাই সেটা মেয়েদের জন্য বরাদ্দ করে বাকিদের নিয়ে গেলেন অন্যগুলোতে। মূল কটেজ থেকে বেশ খানিকটা দূরে পাহাড়ের ওপরে একটা টাওয়ার টাইপের কটেজে থাকার ব্যবস্থা হলো আমার। অন্য রুমগুলোতে দুটো বিছানা। চারজন করে মানুষ। আমাকে পাঠানো হল যেখানে, সেখানে একটা ঘর, বিছানাও একটাই। কিন্তু সঙ্গী আরো তিনজন। আজিজের সঙ্গে যোগ হলো শরীফ এবং সোহেল। সোজা গিয়ে রুমে ঢুকলাম, হাত মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিচে নামলাম। বেগুন আর ডিম ভাজা দিয়ে ভুনা খিচুড়ি খাওয়ার পর বেশ ফুরফুরে ভাব চলে এল!

Sunআমাদের কটেজ থেকে মেঘ আর কুয়াশায় মোড়া বিশাল পাহাড়সারির কিছুটা দেখা গেল। চারপাশে পাহাড়। বেলা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রোদও বাড়ছে। কুয়াশা কাটছে। আমি আর আজিজ বেরিয়ে পড়লাম। কটেজ থেকে দেখেছিলাম একটা বিশাল ওয়াচ টাওয়ার। সেদিকেই রওনা হলাম প্রথমে। ১৫০ ফুট পাহাড়ের ওপরে ৬০ ফুট উঁচু ওয়াচ টাওয়ারে উঠতেই পুরো এলাকা চলে এল চোখের সামনে। যতোদূর দেখা যায়, চারপাশে গাছপালায় ছাওয়া দীর্ঘ পাহাড় আর টিলা। জামালপুরের সীমান্তবর্তী বকশীগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে ১০ হাজার একর জায়গা জুড়েবিস্তৃত ধানুয়া কামালপুর ইউনিয়নের এই বিশাল বনাঞ্চল বিভক্ত লাউচাপড়া ও ডুমুরতলা নামের দুটি মৌজায়। সীমান্তের ওপাড়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা জেলা। সব মিলিয়ে মুগ্ধতার অনন্য আয়োজন। তবে বেশিণ মুগ্ধতার স্বাদ নেওয়া গেল না। খানিক পরেই শুরু হবে পরিচিতি পর্ব। টাওয়ার থেকে নেমে রওনা হলাম কটেজের দিকে। আগেই শুরু হয়ে গেছে পরিচয়পর্ব। শেষ অংশে গিয়ে নিজেদের পরিচয় দিলাম। তারপর এই ভ্রমণের নিয়ম কানুন ও ভ্রমণসূচি জেনে নিলাম।

এ পর্ব শেষ হতেই সবাই পা বাড়ালাম পাহাড়ের দিকে। লাউচাপড়া ও ডুমুরতলা মৌজায় পাহাড়টিলায় দিঘলাকোনা, বালুঝুড়ি, সাতানীপাড়া, পলাশতলা, মেঘাদল, শুকনাথপাড়া, গারোপাড়া, বালিজোড়া, সোমনাথপাড়া ও বাবলাকোনা গ্রাম। এখানে ঘরসংসার পেতেছে গারো, হাজং, কোচ মিলিয়ে প্রায় হাজার তিনেক আদিবাসী। বাঙালিও আছে প্রচুর। উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথে খুব সাবধানে এগুতে হচ্ছে। পা ফসকালেই খবর আছে। আশপাশের ঝোপ আর লতাপাতা ধরে পাহাড়ে উঠার বা নামার চেষ্টা করতে গিয়ে কাঁটার খোঁচা খেতে হলো অনেককেই।

শুধু চড়াই-উৎরাই নয়, পাহাড়ি জলাও পথ আগলে দাঁড়ালো। আকারে ীণকায় হলেও সেগুলো পেরোতে দলের মেয়েদের একটু বেগ পোহাতে হয়েছে বৈকি! তারপরও আনন্দের সীমা নেই কারো। যে যা দেখে তাতেই মুগ্ধ। আর মুগ্ধতা মানেই জম্পেশ ফটোসেশন। ‘কিক কিক’ রবে যেন কোরাস গেয়ে ওঠে সবার ক্যামেরা। আমাদের সঙ্গে আছেন প্লাজমা বিজ্ঞানী ড. মফিজউদ্দীন আহমেদ। দুনিয়াতে কতো অজানারে! সবাই নিজেদের প্রশ্নের ঝুলি খুলে বসেছেন। মফিজউদ্দীন সবার প্রশ্নেরই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

আদিবাসীদের ঘরবাড়ি, মিশনারি স্কুল দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম একেবারে বাংলাদেশের কিনারায়! ‘২০০ গজ সামনে সীমান্ত এলাকা অতিক্রম করবেন না। ’ বিজিবির (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) এমন হুঁশিয়ারির সামনে এসে দল বিভক্ত হয়ে গেলাম আমরা! একদল চলে গেলে ডানদিকে। অন্যদল ফিরল পিছনে। আমরা ফিরতি দলেই যোগ দিলাম।

নির্ধারিত সময়েরও প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর পাওয়া গেল দুপুরের খাবার। ভাত-মাছ আর ডাল দিয়ে পেট পুরলাম। তারপর? ঘোরাঘুরি তো শেষ করেছি এবার কী করা যায়? মিলন ভাইয়ের কাছ থেকে জানা গেল সাড়ে ৫টার দিকে ওয়াচ টাওয়ারের দিকে রওনা হবে সবাই। সেখান থেকেই বছরের শেষ সূর্যাস্ত দেখা হবে। এতণ সূর্যের কথা মনে ছিলো না। মনে পড়তেই একটু আতঙ্ক বোধ করলাম। কারণ আমার বরাতে কখনও আয়োজন করে সূর্য দেখা নেই। যতোবার আয়োজন করে সূর্য দেখতে গিয়েছি, ততোবারই মেঘের দাপট দেখা গেছে আকাশে।

তাও তো অনেক দেরী। এখন সময় কাটাই কী করে? দলের অন্য সদস্যদের আচরণে মনে হলো এটা একটা পারিবারিক ভ্রমণ। আমি উটকো একজন। শুধু আমার না, প্রথমবার সূর্য উৎসবে যোগ দেওয়া বাকিদেরও অনেকটা তাই মনে হলো। কী হচ্ছে কী হবে কিছুতেই জানানো হচ্ছে না আমাদের। নিজ উৎসাহে কিছুণ জানার চেষ্টা করে এক সময় সে আগ্রহও হারিয়ে ফেললাম। ‘উটকো’ লোকদের নিয়ে আবারও বেরিয়ে পড়লাম ঘুরতে। এই দলে যথারীতি আজিজ এবং সোহেল আমার সঙ্গী। নতুন হিসেবে যোগ দিলেন অপুদা। চট্টগ্রামের স্কুলশিক এই মানুষটা ছিলেন বলেই রা। তার রসবোধ প্রবল।

নিজেদের উটকো ভেবে যে দুঃখে ভুগছিলাম, তার ঠাট্টা মশকরায় তা উবে গেল নিমিষেই। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়! সূর্যাস্তের ঠিক আগ মুহূর্তে কথা নেই বার্তা নেই, শীতের আকাশে মেঘের দাপট। সূর্যাস্ত দেখার আয়োজন প-, এ খবরটাও অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে জানা গেল না কারো কাছ থেকে! শেরপুর জামালপুরবিষয়ক জটিলতা সম্পর্কেও জানা যায়নি কিছু।

Sunসন্ধ্যায় আদিবাসীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হওয়ার কথা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাও হলো না। রাত ১২টা ১ মিনিটে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার জন্য ফানুস ওড়ানোর পরিকল্পনা ছিলো। সেটাও বাতিল হয়ে গেল। সীমান্তবর্তী এলাকায় হঠাৎ ফানুস উড়তে দেখলে  বিএসএফ ‘ভুল’ বুঝতে পারে! ফানুশের বদলে তাই পিকনিক স্পটের ভেতরকার লেকে মঙ্গলপ্রদীপ ভাসিয়ে, লেকের পাড়ে তারাবাতি, মশাল, ঝরনাবাতি জ্বালিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হলো। মেয়েদের জন্য বরাদ্দ কটেজটাকে বিকেলেই সাজানো হল বর্ণিল সাজে। সূর্যাস্ত দেখা না গেলেও এখান থেকে টেলিস্কোপে বৃহস্পতি গ্রহ দেখানো হলো সবাইকে। স্থানীয়রাও দেখার সুযোগ পেলেন। দেখানোর কাজটা করলেন শাওন ভাই। রাত নটার দিকে আলুভর্তা আর ডিম ভাজা দিয়ে আমাদের পেটপূজাও সেরে নিয়েছিলাম আমরা।

লাউচাপড়ায় বিদ্যুৎ নেই। জেনারেটর দিয়ে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে দুটি কটেজে। আমাদের কটেজ বেশ খানিকটা দূরে হওয়ায় আলো পৌঁছুল না সেখানে। নতুন বছরকে বরণ করে নিয়ে খাসির মাংস আর রুটি দিয়ে আরও একবার পেটপূজা। তারপর ঘুমোতে চললাম সবাই।

একটামাত্র খাট আমাদের কটেজে। মেঝেতে বিছানা পেতে, স্লিপিং ব্যাগের আশ্রয় নিয়ে কোনোমতে রাতটা কাটিয়ে দিলাম চারজন। ভোর পাঁচটায় সূর্যোদয় দেখতে আবারও উঠতে হবে ওয়াচ টাওয়ারে। কিন্তু সকালে কারো ডাক পেলাম না। মোবাইলের অ্যালার্ম শুনে ঘুম থেকে উঠে জানালা দিয়ে দেখা গেল আমাদের আগেই অন্যরা পৌঁছে গেছেন। কনকনে শীতে কাঁপতে কাঁপতেই তাড়াতাড়ি হাজির হলাম টাওয়ারে। তবে এখনও মেঘে আকাশ ঢাকা। সূর্যোদয় দেখার আশা দিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠলো ফটোসেশনে। শেরপুরের নাম লেখা ভুল ব্যানার টানিয়ে তার সামনেই হাসিমুখে পোজ দিলেন সবাই। বরাবরের মতো হতাশা সঙ্গী করে কটেজে ফিরলাম। বাকিরা তখনও টাওয়ারের আশপাশে। বেশি মানুষ উঠলেই কেমন নড়েচড়ে ওঠে টাওয়ারটা।

কটেজে ফিরে কী মনে করে পেছন ফিরতেই দেখা মিলল সূর্যের। মেঘ কেটে বেরিয়ে এসেছে বছরের প্রথম সূর্য। টকটকে লালরঙা সূর্য যেন ঘোর লাগিয়ে দিলো চোখে। যাক, অস্ত না হোক সূর্য উদয়টা তো দেখা হলো। সূর্যোদয় দেখে ফিরে সকালের নাশতার পর আয়োজন করা হলো প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান ও স্থানীয় শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। দুটো আয়োজনকেই দেওয়া যায় উৎসবের সেরা ও সবচেয়ে উপভোগ্য অংশের স্বীকৃতি। তারপর দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম চটপট। কারণ খানিক পরেই রওনা হতে হবে ঢাকার পথে।

বাংলাদেশ সময় ২১৩৫, জানুয়ারি ৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।