ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

প্যাক খেলা ও হাজং কথা

সালেক খোকন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২:২৯, জানুয়ারি ১৮, ২০১৪
প্যাক খেলা ও হাজং কথা ছবি: বিপুল হাজং

ইলশে গুড়ি বৃষ্টি। আকাশে রোদ-মেঘের খেলা।

এরই মধ্যে আমরা পা রাখি উত্তর লেংগুরা গ্রামে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট্ট একটি নদী। মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা নদীর দু’তীরেই মানুষের জটলা। সবাই ব্যস্ত পাথর তোলায়। নদীর জলে শরীর ডুবিয়ে বাঁশের টুকরি ভরে দিচ্ছে নারী শ্রমিকরা। তাদের মাঝে কয়েকজন আদিবাসীও নজরে এলো। বাঙালিদের সঙ্গে এক হয়েই কাজ করছে তারা। এখানকার হাট-বাজারেও রয়েছে আদিবাসী-বাঙালিদের সহ অবস্থান। অন্য অঞ্চলে যা ততটা দেখা যায় না।

লেংগুরা নেত্রকোনা জেলার একটি আদিবাসী গ্রাম। নিজেদের আদি রীতিনীতি মেনে এখানেই বসবাস করছে প্রায় ৭০টি হাজং পরিবার।

আমরা পা রাখি নদী পাড়ের একটি হাজং বাড়িতে। বাড়ির ভেতর চলছে ধান মাড়াইয়ের কাজ। আবাল-বৃদ্ধ সবাই ব্যস্ত। কেটে আনা ধান শুকিয়ে তা থেকে ধান ছাড়িয়ে নিচ্ছে কেউ কেউ, কেউ আবার ধান থেকে চাল তৈরি করে নিচ্ছে। কাজ থামিয়ে বাড়ির কর্তা দেবেন্দ্র হাজং আমাদের বসতে দেন। পরিচয় শেষে আমরা আলাপ জমাই হাজং আদিবাসীদের নানা বিষয়ে।
012014
গারো ভাষায় ‘হা’ মানে মাটি, ‘জং’ মানে পোকা বা কীট। সুদূর অতীত থেকেই এরা মাটির সঙ্গে সখ্য এদের। তাদের কৃষি কাজের এ কৌশল দেখেই গারোরা তাদের নাম দিয়েছিল হাজং।

ধারণা করা হয় আগে হাজং নামে কোনো জাতি ছিল না। এ বিষয়ে হাজংরা বলেন, গারো গিলা আমলা নাম থুছে হাজং অথ্যাৎ গারোরা আমাদের নাম রেখেছে হাজং। আবার অনেকেরই ধারণা প্রাচীন আসামের কামাখ্যা এলাকার কোচ রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ‘হাজো’ বা ‘হাজু’র নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের হাজো নগরের বাসিন্দা ছিল বলেই কালক্রমে স্থানীয় লোকদের কাছে তারা হাজং নামে পরিচিতি লাভ করে।

তবে হাজংদের ভাষ্য মতে, হাজং শব্দের অর্থ প্রস্তুত হই, সজ্জিত হই, সংগঠিত হই। এরা মনে করেন, অতীতে তারা বারবার ছত্রভঙ্গ হয়ে পরে আবার সংগঠিত হয়েছে। আর এই অবস্থার কারণেই হাজং নামের উৎপত্তি।

হাজংদের নিজস্ব ভাষা আছে। পরিবার এবং নিজেদের মধ্যে তারা নিজ ভাষায় কথা বলে। তবে হাজং ভাষার কোনো লিখিত বর্ণমালা নেই। বর্তমানে বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা থেকে অনেক শব্দ প্রবেশ করেছে হাজং ভাষাতে।

দেবেন্দ্রের মুখে শুনি হাজংদের সমাজ কাঠামোর কথা। অন্যান্য আদিবাসীদের মতো এরাও একেক জায়গায় পাড়া করে বাস করে। পাড়া প্রধানকে এরা বলে ‘গাওবুড়া’। তিনিই পাড়ার বিচার সালিশীসহ নানা দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

কয়েকটি পাড়া মিলে হাজংদের একটি গ্রাম হয়। গ্রাম প্রধানকে এরা বলে মোড়ল। গাওবুড়াদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বিচক্ষণ তাকেই হাজংরা মোড়ল বানায়। মোড়ল গাওবুড়াদের সহযোগিতায় গ্রামের নানা সমস্যার সমাধান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এভাবে কয়েকটি গ্রাম মিলে হয় একটি চাকলা বা জোয়ার। এর প্রধানকে বলে চাকলাদার বা জোয়ারদার। মোড়লদের মধ্য থেকে একজনকে এ পদে মনোনিত করা হয়। আবার কয়েকটি চাকলা বা জোয়ারের সমন্বয়ে হয় একটি পরগণা। পরগণার সর্বময় কর্তা রাজা।
02201
হাজং সমাজে গাওবুড়া ও মোড়লের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাদের মর্যাদা ও ক্ষমতাও বেশি। হাজং পাড়া বা  গ্রামের শান্তিশৃঙ্খলা গাওবুড়া ও মোড়লদের বিচক্ষণতা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করে।

হঠাৎ আমাদের চোখ পড়ল কুলা দিয়ে আপন মনে ধান ঝাড়‍া এক নারীর ওপর। বয়স ষাটের বেশি। নাম রুবিলা হাজং। দেবেন্দ্রর বোন তিনি। আমাদের দিকে চোখ পড়তেই মুচকি হাসেন।

বাড়ির এককোণে ছোট্ট একটি প্রার্থনা ঘর। মাটির তৈরি ধুপের ঘটি ও প্রদীপ পড়ে আছে। সেখানে সামান্য একটু জায়গা উঁচু করে মাটি লেপা। কি এটি? প্রশ্ন করতেই রুবিলা বলে, হরিমন্দির। তার ভাষায়, প্রতিদিন আমরা ধূপ, কলা, ফুল দিয়ে হরির নামে ভক্তি দিই।

এছাড়াও হাজংরা কড্ডা পূজা, শিব পূজা পালন করে। ধর্মের কথা উঠতেই তিনি বলেন, আমরা সনাতন ধর্মের অনুসারী। হিন্দু ধর্মের বর্ণ এবং সূর্য বংশীয় ব্রাহ্ম ক্ষত্রিয়। দিওলী আমাদের প্রধান উৎসব।

বড় একটি মাঠ পেরিয়ে আমরা পৌঁছলাম নরেশ হাজংয়ের বাড়ি। নরেশের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে দেবেন্দ্রর মেয়ে স্বপ্না হাজংয়ের। নিজের কাজের অবসরে নরেশ গড়ে তুলেছেন একটি গানের দল। তাই হাজংদের উৎসবগুলোতে আশপাশ থেকে ডাক পড়ে নরেশের।

নরেশের মুখেই শুনি হাজংদের ভিন্ন ধরণের একটি উৎসবের কথা। হাজংরা এটিকে বলে ‘প্যাক খেলা’। সাধারণত  রোয়া (ধান গাছের চারা) লাগানোর সময় গ্রামের মোড়ল বা যাদের সামর্থ আছে তারা এই উৎসবের আয়োজন করে থাকে। এটি হাজংদের একটি আদি উৎসব।

হাজংরা জমিতে রোয়া লাগায় ভাদ্র মাসে। একটি জমি ফাঁকা রেখে গ্রামের মোড়ল তার সব জমির রোয়া লাগানো শেষ করে। অতঃপর তিনি গ্রামের সবাইকে ডেকে আনতে নির্দেশ করেন চাকোরাকে (গ্রাম সমাজের একটি পদ)। সবাই উপস্থিত হলে ঠিক হয় একটি তারিখ।

সাধারণত প্রতিঘর থেকে একজন নারীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কখনও কখনও  পুরুষ ও শিশুরাও অংশ নেয় এ আনন্দ উৎসবে। পুরুষেরা জালা ভাঙ্গে (বীজতলা থেকে চারা তোলা) আর হাল বায়। আর মেয়েরা রোয়া লাগায়। ওইদিন জমির এক দিক রোয়া লাগালে অন্যপাশে সবাই গোল হয়ে নাচ-গানে মেতে ওঠে। নারীরা তখন গান গাইতে গাইতে একে অপরকে প্যাক (কাদা) মাখিয়ে দেয়। নরেশ থামতেই স্বপ্নার কণ্ঠে শুনি প্যাক খেলার গানটি।
320140
নরেশ বলেন, প্যাক খেলার গানকে হাজংরা বলে গুপনি গান। এদের প্যাক খেলার নাচও অন্য উৎসব থেকে ভিন্ন। সকালে শুরু হয়ে প্যাক খেলা শেষ হয় বিকেলে। এ সময় উলু ধ্বনি দিয়ে হাজং নারীরা রোয়া লাগায় এবং সবাই সবার শরীরে প্যাক মেখে দেয়। এভাবে গ্রামের সবাই মিলে মোড়লের শেষ জমিটিতে রোয়া লাগানো শেষ করে। খেলা শেষে দু’টি হাড়িতে জমির প্যাক তোলা হয়। অতঃপর মোড়ল ও তার স্ত্রীকে বাড়ির উঠানে বসিয়ে সারা শরীরে প্যাক ঢেলে দেওয়া হয়। এরপরই মোড়ল সবাইকে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করে। গোসল সেরে সবাই খেতে আসে মোড়লের বাড়িতে।

এ উৎসবে খাওয়ানো হয় বিন্নি ধানের ভাত, কাছিম (কাচ্ছোয়া) বা মাছ ও ডাল। আটা ও চাউলের গুড়া দিয়ে তৈরি কাসা মদ উৎসবের আনন্দকে আরও বাড়িয়ে দেয়। প্যাক খেলার নাচ-গানে হাজংরা খোল, ধাপা করতাল, জরি (মন্দিরা) প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে। পারস্পারিক সৌহার্দ্য ও আনন্দ করাই এ উৎসবের মূল উদ্দেশ্য। এর মাধ্যমে হাজংদের দলবদ্ধতারও প্রমাণ মিলে।

গেল বছর এ গ্রামের মোড়ল লিলি হাজং প্যাক খেলার আয়োজন করলেও ধীরে ধীরে প্যাক খেলা হারিয়ে যাচ্ছে আদিবাসী সমাজ থেকে। হাজংদের জমি কমে যাওয়া, জমি বর্গা দিয়ে দেওয়া, নিমন্ত্রণ খরচ বেশি হওয়া ও আয় কমে হওয়াই এর মূল কারণ।

অন্য উৎসবের কথা জানতে চাইলে দেবেন্দ্র জানায় হাজংদের নবান্ন উৎসবের আচারগুলোর কথা। অগ্রাহায়ণে বাস্তুদেবতার পূজা ছাড়া হাজংরা নতুন ধান ঘরে তোলে না। নবান্নর দিন এরা গ্রীব দেবতা, কামাখ্যা ও লক্ষ্মী দেবীর উদ্দেশ্যে সর্বপ্রথম নতুন ধানের চাল ভোগ দেয়।

ওইদিন প্রতি ঘরে ঘরে চিড়া, মুড়ি, খৈ ও পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। এ সময় তারা দলবেধে নাচগান করে। সুরেশের কণ্ঠে শুনি হাজংদের একটি নবান্নের গান।

এছাড়াও হাজংরা মাগ মাসে মাগের পূজা, দোল পূজা, শিব পূজা পালন করে থাকে। দুর্গাপূজায় এরা অংশ নিলেও নিজেরা প্রতিমা বানায় না।

হঠাৎ শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি। উঠান থেকে আমরাও সরে আসি বাড়ির বারান্দাতে। গাছ থেকে কাঁঠাল পেরে মুড়ি দিয়ে পরিবেশন করে স্বপ্না হাজং। সঙ্গে লেবু পাতার সুগন্ধি চা। আর আমরা মুড়ি-চা খেতে খেতে শুনি হাজং সমাজের নানা কথা-উপকথা।

সালেক খোকন: লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক
contact@salekkhokon.me

বাংলাদেশ সময়: ০২০২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৪
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।