ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

হারিয়ে যাওয়া পাঁচ বিস্ময় সভ্যতা

জাকারিয়া খান, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩:০৬, ফেব্রুয়ারি ৩, ২০১৪
হারিয়ে যাওয়া পাঁচ বিস্ময় সভ্যতা

ঢাকা: পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক সভ্যতার উত্থান পতনের কাহিনী আমরা দেখতে পাই। বিভিন্ন সময়ে এসব সভ্যতার আবিষ্কৃত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন কিংবা তাদের লিখে যাওয়া ইতিহাস থেকে আমারা এসব সভ্যতা সম্পর্কে কম-বেশি জানতে পারি।

কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক সময়ের যেসব সভ্যতা ছিল বা প্রাগৈতিহাসিককালের পরেরও যেসব সভ্যতার লিখিত ইতিহাস তেমন পাওয়া যায়না সেসব সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের একমাত্র ভরসা এসব সভ্যতার খুঁজে পাওয়া বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আর্টিফেক্ট তথা হস্তশিল্পের উপাদান, তাদের নির্মাণশৈলির বৈচিত্র্য ইত্যাদি। চলুন জেনে নেই সেরকমই পাঁচটি বিস্ময় সভ্যতা সম্পর্কে।

নাবাতিয়ান সভ্যতা
আমেরিকান চলচ্চিত্র পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গের অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত ছবি ‘দ্য লাস্ট ক্রুসেড’র শেষ দৃশ্য নির্মিত হয় নাবাতিয়ান সভ্যতার কোষাগার ‘আল খাজেন’এ। বিখ্যাত একজন পরিচালক কেন তার ছবির জন্য এমন স্থান বেছে নিলেন সে বিষয়ে যে খুব বেশি চিন্তা করতে হয় না।

নাবাতিয়ান সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বর্তমান জর্ডান ও আশেপাশের অঞ্চলে প্রতিষ্টিত হয় বলে ধারণা করা হয়। রহস্যের চাদরে ঢাকা বিস্ময়কর এ সভ্যতার শহরগুলোর মতো এর নির্মাতারাও রহস্যই থেকে গেছেন।
Nabatian
পাথরের খোদাইকৃত শহরগুলো দেখে মনে হতে পারে যেন রূপকথার কোনো এক অতিকায় দৈত্য এসে এক রাতেই জটিলসব গাঁথুনি দিয়ে শহরগুলো নির্মাণ করে আবার অদৃশ্য হয়ে গেছে।

দীর্ঘদিন যাবৎ টিকে থাকা নাবাতিয়ান সভ্যতার ইমারতগুলোর নির্মাণশৈলিতে প্রত্নতাত্তিক ও ঐতিহাসিকরা এখনো বিস্মিত হন।

তবে নাবতিয়ান সভ্যতার শৈল্পিক গঠনই একমাত্র বিস্ময় নয়। এ সভ্যতার কোনো লিখিত ইতিহাস না থাকাটাও ঐতিহাসিকদের মধ্যে কম বিস্ময়ের জন্ম দেয় না।

অপরূপ গঠনের নাবাতিয়ান সভ্যতা ১০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে রোমান সম্রাট ট্র্যাজান কর্তৃক বিজীত হয়। এরপর ধীরে ধীরে গ্রীক-রোমান সংস্কৃতিতে হারিয়ে যায় এ সভ্যতার কীর্তিমানদের সব বীরত্বগাঁথা।   তবে এক সময়ের জাঁকজমকপূর্ণ এই পাথুরে নগর সভ্যতাটি এখনো আকর্ষণ করে পর্যটকদের।  

খেমার সভ্যতা
পৃথিবীর অন্যতম রহস্যাবৃত খেমার সাম্রাজ্য ‘অ্যাঙ্কর’ সভ্যতা নামেও পরিচিত। সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় প্রাসাদে গোলন্দাজদের জন্য ইস্পাতনির্মিত টাওয়ার এবং খোদাইকৃত অসাধারণ শিল্পকর্মের ইমারতগুলো শিল্পায়ন পূর্ববর্তী বিশ্বের এক শক্তিশালী সাম্রাজ্যের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে।
কম্বোডিয়ার প্রাচীন রাজাগণ খেমার সভ্যতা নির্মাণ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দের দিকে এ সভ্যতা ভিয়েতনাম থাইল্যান্ড এবং লাওসে বিস্তৃতি লাভ করে। খেমার সভ্যতার কেন্দ্র ছিল ‘অ্যাঙ্কর’ নামের একটি শহর। ‘অ্যাঙ্কর’ সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ ‘শহর’।
   
শুধু স্থাপত্যশৈলির অমরত্ব নয়, বরং প্রথমদিককার যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠাক‍ারী সভ্যতা সমূহেরও অন্যতম এই খেমার সভ্যতা। স্থল যোগাযোগ ব্যবস্থার মূল সমস্যা বিভিন্ন খাল ও নদীর উপর সেতু নির্মাণও ছিল যুগান্তকারী খেমার সভ্যতার অন্যতম কীর্তি।
শুধু তাই নয় খেমার রাজা সপ্তম জয়াভারনামের সময় রাজ্যের জনগণের স্বাস্থ্য সেবায় কিছু হাসপাতাল নির্মাণ করেন।

বহিঃশত্রু আক্রমণ থেকে রাজ্য রক্ষায় খেমার রাজারা পাথর দিয়ে এমন কিছু সীমান‍া দেওয়াল তৈরী করেন যা ডিঙ্গিয়ে শত্রুর পক্ষে খেমার রাজ্যে প্রবেশ করা ছিলো প্রায় অসম্ভব।
Khemar
ধর্মভীরু হলেও খেমার সভ্যতার লোকেরা বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাস্কৃতিক উৎসব পালন করতো। বাৎসরিকভাবে কুস্তি প্রতিযোগিতা (রেসলিং) গানের আসরসহ বিশেষ দিবস উপলক্ষ্যে আতশবাজির উৎসব ছিল ‍খেমার সভ্যতার অন্যতম আকর্ষণ।

‘অ্যাঙ্কর’ শহরের কেন্দ্রে হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর প্রতি শ্রদ্ধার স্মারক হিসেবে একটি মন্দির নির্মাণ করে তারা। মন্দিরটি খেমারদের নিকট দেবতাদের আবাসস্থল, পৃথিবীর অক্ষরেখা এবং পুরানের উল্লিখিত ‘মেরু’ পর্বতের চূড়া হিসেবে বিবেচিত ছিলো।

হিন্দু পুরানে ‘মেরু’ পর্বতকে পৃথিবীর কেন্দ্র এবং দেবতাদের আবাসভূমি বর্ণনা করা হয়েছে। ‘মেরু’ পর্বতের পাদদেশে হিমালয় অবস্থিত বলেও বিশ্বাস করা হয়।

উন্নত পানিসেচের ব্যবস্থা করে খেমার সভ্যতার লোকেরা প্রচুর শস্য উৎপাদনের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হতে পেরেছিলো।  

বিচিত্র এ সভ্যতা পঞ্চদশ শতকের ধ্বংস হয়ে যায়। তবে ঐতিহাসক ও প্রত্নতাত্তিকরা এখনো এ সভ্যতা ধ্বংসের কারণ নির্ণয়ে একমত হতে পারেন নি।

সমৃদ্ধ এ সভ্যতা ধ্বংসের কারণ হিসেবে কেউ কেউ যুদ্ধ-বিগ্রহকে দায়ি করেন। তবে অন্যপক্ষের ধারণা, কল্পনাতীত খাদ্য স্বল্পতাই এর কারণ।

কালের বিবর্তনে নৃতাত্বিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন বিভিন্ন উপাদান (আর্টিফেক্ট) ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় এবং খেমার সাম্রাজ্যের সীমানা হারিয়ে যাওয়ায় এ বিষয়ে সমাধানে পৌঁছার সম্ভাবনাও প্রায় নেই বললেই চলে।

মিনোয়ান সভ্যতা
ইজিয়ান সাগরের ক্রীট দ্বীপে খ্রিস্টপূর্ব ২৭ থেকে ১৫ অব্দের দিকে মিনোয়ান সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। তবে প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন মধ্য ‘নিওলিথিক’ যুগে এখানে বসতি স্থাপন হয়।

ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হওয়া মিনোয়ার সভ্যতাকে ঘিরে অনেক কল্পক‍াহিনী (মিথ) তৈরী হয়।
Minoan
বিংশ শতাব্দির শুরুতে ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক আর্থার ইভানস ও উইলিয়াম ডুরেন্ট আবিস্কার করেন মিনোয়ান সভ্যতা।

আর্থার ইভানসই এ সভ্যতাকে গ্রীক পুরানে বর্ণিত রাজা ‘মিনোস’ এর নামে নামকরণ করেন।

দীর্ঘদিন টিকে থাকার পর মিনোয়ান সভ্যতার অ্যাক্রতিরি শহর সমূদ্রের বুকে হারিয়ে যা‍য়। প্লেটোর ‘আটলান্টিস’ নামের গল্পটির উপজীব্যও এ ঘটনা।
 
আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে ‘ক্রিট’ দ্বীপসহ পার্শ্ববর্তী ‘থেরা’ দ্বীপের উপকূলবর্তী শহর ও পার্শ্ববর্তী দ্বীপগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।

দ্য ইন্ডাস ভ্যালি
অপূর্বসব স্থাপত্যকর্মের জন্য প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম মানব নির্মিত বিস্ময় হিসেবে বিবেচিত ইন্ডাস ভ্যালি সভ্যতা। বর্তমান আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত এ সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ অব্দের দিকে এ এলাকার অন্ততঃ সাড়ে বার লাখ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত ছিল।

বিকাশমান শিল্প ও অলঙ্কার ব্যবসার পাশাপাশি ইন্ডাস ভ্যালির লোকেরা পরিকল্পিত পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থাও চালু করে।

ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রবর্তক ইন্ডাস ভ্যালি সভ্যতার লোকেরা বৃহৎ পরিসরে ব্যবসা-বাণিজ্যের উপযোগী ওজন পরমাপ পদ্ধতি চালু করে করে।

ইন্ডাস ভ্যালি সভ্যতার কেন্দ্রে ইতিহাস বিখ্যাত মহেঞ্জোদারো সভ্যাতা অবস্থিত। ঐতিহাসিকদের নিকট এটি পৃথিবীর প্রথমদিককার অন্যতম শহুরে সভ্যতা হিসেবে বিবেচিত।

যোগাযোগের জন্য নিজস্ব লিখন পদ্ধতির ‌‌উদ্ভাবন করে ইন্ডাস ভ্যালি সভ্যতার লোকেরা নিজেদের বিস্তৃত ইতিহাস লিখে যায়। ‌এখনো এসব ইতিহাসের অনেকগুলোর পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
Valley
এছাড়া ইন্ডাস ভ্যালির খোদাই কর্ম ও ধাতুবিদ্যার অনেকটাই এখনো অজানা।

ইন্ডাস ভ্যালির ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রাচীন কিছু সিল আবিস্কার করেছেন। আধুনিক যুগের ডাকটিকিটের ন্যায় সিলগুলো বিভিন্ন ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহৃত হতো বলে মনে করা হয়।

সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের নিচে এ ধরনের আরো কিছু নিদর্শন থাকতে পারে বলে প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা।

১৯২২ সালে প্রত্নতত্ত্বিকদের আবিস্কারের আগে পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ এ সভ্যতা সম্পর্কে কেউ জানতো না বললেই চলে।
খ্রিস্টপূর্ব ১৯ শতকের দিকে পরিত্যাক্ত হয় মহেঞ্জোদারো সভ্যতা। তবে ঠিক কী কারণে মহেঞ্জোদারোর অধিবাসিরা অবস্থান ত্যাগ করে তা এখনো অজানা।

অনেকের মতে ইন্দো-ইউরোপীয়দের বল প্রয়োগের ফলেই তারা মহেঞ্জোদারো তথা ইন্দোসভ্যালি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তবে এর সপক্ষে তেমন জোড়ালো কোনো প্রমাণ নেই।

মকি সভ্যতা
মকি সভ্যতা ‘মকিকা’ সভ্যতা নামেও পরিচিত। ৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বর্তমান প্রশান্ত মহাসাগর ও আন্দিজ পর্বতমালার মধ্যবর্তী অঞ্চলে এ সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল। তবে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্তই পেরুর উত্তর উপকূলীয় শুষ্ক অনুর্বর অঞ্চলে মকি সভ্যতার স্বর্ণযুগ ছিল। মকি নামের এক নদী উপত্যকা অনুসারে এর নামকরণ করা হয় বলে ধারণা করেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা।

তবে লিখিত ইতিহাস না থাকায় এবং ইতিহাসের স্বাক্ষ্য বহনকারী তেমন কোনো চিহ্ন না থাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক উপাদান ও স্মৃতিস্তম্বের উপর ভিত্তি করেই প্রত্নতাত্ত্বিকরা এ সভ্যতা সম্পর্কে যৎকিঞ্চিত মতামত দিয়ে থাকেন। এসব সমৃতিস্তম্বের মাধ্যমেই মূলত রহস্যাবৃত এ সভ্যতার উৎকর্ষের প্রমাণ খানিকটা পাওয়া যায়।

লিখিত কোনো ইতিহাস রেখে না গেলেও এ সভ্যতার বাসিন্দারা মৃৎশিল্পের মাধ্যমে কিছুটা হলেও তাদের পরবর্তী প্রজন্মের উৎকর্ষের প্রমাণ রেখে যায়।
Moche
মকি সভ্যতার আবিস্কৃত সাদা-কালো রঙের শিল্পকর্মগুলো এ সভ্যতার সামজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন উপাদান যেমন যুদ্ধ ও অন্যান্য উৎসব উদযাপন বিষয়ে তাদের অলিখিত ইতিহাসের কিছুটা পরিপূরক হিসেবেই কাজ করেছে।

এত কিছু সত্ত্বেও চাঁদের কলঙ্কের ন্যায় মকি সভ্যতার বাসিন্দাদের অতিমাত্রায় ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং এ থেকে উদ্ভূত যুদ্ধ-বিগ্রহ সমূহ ইতিহাসবিদদের কাছে সভ্যতাটির অন্যতম কলঙ্কতিলক রূপে চিত্রিত হয়েছে।

প্রাচীনকালের অন্যান্য অনেক সভ্যতার মতোই ধর্মীয় এসব গোঁড়ামির কারণে বিভিন্ন সময় রক্তক্ষয়ী অনেক যুদ্ধের সূচনা হয়েছে। আবার অনেক সময়ই মকি সভ্যতার দেবতাদের নামে শিশুদের উৎসর্গ করা অনেকটা ডাল-ভাতের মতো ব্যাপার ছিলো।

তেমনি একটি মন্দিরের নিচ থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা মকির বাসিন্দাদের নিকট উচ্চমর্যাদার আসনে স্থান পাওয়া এক দেবীমুর্তির পাশে উৎসর্গীকৃত শিশুদের কঙ্কাল আবিষ্কার করেন।  


বাংলাদেশ সময়: ০৩২১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।