ঢাকা, শনিবার, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৭ মে ২০২৫, ১৯ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

হিপ্পি থেকে ইমাম

রবাব রসাঁ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:৩০, জানুয়ারি ২৩, ২০১১
হিপ্পি থেকে ইমাম

জীবনের টানা চল্লিশটি বছর কাটিয়ে দিলেন ঘুরে ঘুরে। লোকে ডাকতেন ‘হিপ্পি’ বলে।

এখন ডাকেন ‘ইমাম সাহেব’। তবে নিজেকে এখনো ‘হিপ্পি’ই ভাবেন তিনি। তার নাম জন মোহাম্মদ বাট।

১৯৫০ সালে জনের জন্ম ক্যারিবিয়ান দ্বীপ ত্রিনিদাদে। শৈশবের কিছুদিন কেটেছিল ইংল্যান্ডের ওয়াল্টন-অন-টেমসে। স্টোনিহার্স্টের বোর্ডিং স্কুলে পড়েছিলেন কিছুদিন। তারপর হয়ে যান ‘হিপ্পি’। শুরু হয় ভবঘুরে জীবন।

ঘুরে বেড়ানোর জন্য জন বেছে নেন বৈচিত্র্যময় দক্ষিণ এশিয়া। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রানী সোয়াত উপত্যকাই তার সবচেয়ে প্রিয়। এই মনোমুগ্ধকর উপত্যকাটির অবস্থান পাকিস্তান ও আফগান্তিানের সীমান্ত এলাকায়। সবুজ পাহাড়, সাদা চাদরে মোড়ানো পর্বতচূড়া, বিস্তীর্ণ বনভূমি, কল-কল শব্দে ছুটে চলা ছোট ছোট নদী। এখন ধর্মীয় সন্ত্রাসে বিক্ষত হলেও একসময় অন্যতম সেরা দর্শনীয় স্থান হিসেবে এর খ্যাতি ছিল জগৎজুড়ে।

এদেশ-ওদেশ ঘুরে জন যখন সোয়াত উপত্যকায় আসেন তখন তিনি ডোপ-আসক্ত ১৯ বছরের তরুণ মাত্র। সোয়াতে এসে মুগ্ধ হয়ে যান তিনি। মুগ্ধ হন সেখানকার উপজাতীয় জীবনচর্চায়। তার সঙ্গী-সাথীদের ভেতর যারা ‘হিপ্পি’ ছিলেন তাদের পথে না হেঁটে তিনি আসন গাড়লেন সোয়াত উপত্যকায়। শিখে নিলেন স্থানীয় পশতু ও দারি ভাষা। গ্রহণ করলেন ইসলাম। ছয় ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার এই মানুষটি মিশে গেলেন স্থানীয় জনতার সাথে।

তবে বহতা নদীর মতোই বয়ে চলে তার জীবন। মাঝে মাঝে বের হয়ে যেতেন সোয়াত থেকে, তবে কীসের টানে যেন আবার ফিরেও আসতেন। এমনই এক অবস্থায় জন এলেন ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দে। এখানকার দারুল উলুম মাদ্রাসা তাকে আকৃষ্ট করে। ভর্তি হয়ে যান দক্ষিণ এশিয়ার এই বৃহত্তম মাদ্রাসায়। স্বীকৃতি পান প্রতিষ্ঠানটির প্রথম ও একমাত্র পশ্চিমা শিক্ষার্থী হিসেবে। ভারতীয় মুসলমানরা ব্রিটিশ শাসনের প্রতিবাদ হিসেবে এই মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৮৬৬ সালে। আট বছরের লেখাপড়া শেষে জন এই মাদ্রাসা থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৮৪ সালে। এরপর স্বীকৃতি পান ইসলামের একজন প-িত হিসেবে।

জন বলেন, দেওবন্দের মাদ্রাসার মিনার, ছোট-ছোট গম্বুজ আমার অক্সফোর্ডের স্মৃতিগুলোকেই জাগিয়ে তুলত। মনে হতো নিজের দেশেই আছি। ছোট-ছোট রাস্তার পাশে ছোট-ছোট চায়ের দোকান, দোকানের ভেতর মক্কার ছবি- এসবই আমাকে বেশ আবেগপ্রবণ করে তুলত।

কিন্তু জনের পৃথিবী পাল্টে যায় ১৯৮০-র দশকের শুরু থেকে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, বিশেষ করে আরব দেশগুলো থেকে দলে দলে জিহাদিরা আসতে শুরু করেন এই শান্ত-নিবিড় সোয়াত উপত্যকায়। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জেহাদ করতে আসা এই মুজাহিদদের অস্ত্রের ঝনঝনানিতে আঁতকে ওঠেন এই শান্ত-সৌম্য মানুষটি।

জনের ভাষায়, ‘কী শান্তই না ছিল সোয়াতের গ্রামগুলো। এখানকার মানুষদের জীবনাচরে মুগ্ধ হয়ে ছিলাম। কিন্তু সব কিছুই দূষিত হয়ে গেল। বিষিয়ে গেল চারপাশ। ’ এই দূষিত পরিবেশ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি জন ওখানে স্থাপন করলেন একটি রেডিও স্টেশন। প্রচার করলেন শান্তির বাণী। তুলে ধরলেন সৌহার্দ্যরে প্রয়োজনীয়তা।

তার প্রচারকে আরো বেগবান করার জন্য ১৯৯০ সালের দিকে জন যোগ দিলেন বিবিসির পশতু ভাষার অনুষ্ঠানগুলোতে। এখন তিনি ইসলামের শান্তির বাণী প্রচারের জন্য কাজ করছেন আফগানিস্তানের জালালাবাদের একটি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘কাজটি খুবই কঠিন। অনেক ঝুঁকি আছে এতে। তালেবানদের কাছ থেকে হুমকি আসে,’ বললেন জন।

কিন্তু জনের কাছে এখন প্রধান কাজ ইসলামের শান্তির বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে জনগণকে সন্ত্রাসবাদীর হাত থেকে মুক্ত করা। পশতুনদের উপজাতীয় আলখাল্লা পরিহিত এই মানুষটিকে দেখে মনে হবে পশ্চিমের কোনো সন্নাসী অথবা ভিক্টোরীয় যুগের কোনো এক অভিযাত্রী।

দেখে যাই মনে হোক না কেন, জন এখন দেশে-বিদেশে সুপরিচিত। তার প্রচারিত শান্তির বাণী আজ আশা জাগিয়ে তুলছে আফগাস্তিান-পাকিস্তানের ধ্বংস-বিধ্বস্ত অঞ্চলগুলোতে।

সূত্র : বিবিসি ও অন্যান্য

বাংলাদেশ সময় ২০২৫, জানুয়ারি ২৩, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।