শেয়ার ব্যবসা এমন এক পেশা আছে যা ছেলে বুড়ো সবাই করতে পারেন। শুধু তাই নয়, অন্য পেশায় থেকেও এ পেশায় নিয়োজিত থাকা যায়।
শেয়ার কী
শেয়ার ইংরেজি শব্দ, যার অর্থ হলো অংশ। তবে ব্যবসার ক্ষেত্রে শেয়ার হলো কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিকানার একটা অংশ। অর্থাৎ কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তার ব্যবসাকে চালিয়ে রাখার জন্য অন্য কাউকে যুক্ত করে মালিকানার একটা অংশ প্রদান করে। অথবা সরকার বা বিশেষ কোনো সংস্থা জনসাধারণকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করতে বাধ্য করে শেয়ারের মাধ্যমে।
শেয়ারবাজার
সাধারণ অর্থে যেখানে শেয়ার কেনাবেচা হয় তাকে শেয়ার বাজার বলে। এখান থেকে বিও অ্যাকাউন্টধারী যে কেউ শেয়ার কেনাবেচা করতে পারেন। যদিও শেয়ারকে আমরা একটি পণ্য হিসেবে মনে করি, প্রকৃতপক্ষে এটি দৃশ্যমান কোনো বস্তু নয়। শুধু টাকার বিনিময়ে মালিকানা পরিবর্তনের দৃশ্যই চোখে পড়ে। শেয়ার কেনাবেচার জন্য বাংলাদেশে দুটি বাজার আছে। একটি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, অপরটি চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ। আবার এই দুটি বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রয়েছে একটি সংস্থা, সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বা এসইসি। এসইসির কাজ হলো শেয়ার বাজার পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ; প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন, সংশোধন, পরিমার্জন; বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাসহ অনিয়ম প্রতিরোধ ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্ট
স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর অনুমোদিত বহু এজেন্ট রয়েছে, এগুলো ব্রোকারেজ হাউস নামে পরিচিত। এসব হাউসে আপনি বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট বা বিও অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। যাদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে এবং যাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে তারাই বিও অ্যাকাউন্ট করতে পারবেন। বিও অ্যাকাউন্ট অনেকটা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মতই।
অ্যাকাউন্টকারীর দুই কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি, নমিনির এক কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্র বা ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি অথবা পাসপোর্টের ফটোকপির সঙ্গে ব্রোকারেজ হাউসের নির্ধারিত ফি জমা দিলেই আপনি দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে আপনার বিও অ্যাকাউন্ট নম্বর এবং গ্রাহক পরিচিতি নম্বর পেয়ে যাবেন। গ্রাহক পরিচিতি নম্বর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেয়ার লেনদেন বা কেনাবেচা করতে পারবেন। তবে আপনি যে ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে বিও খুলেছেন সেই হাউসের মাধ্যমেই লেনদেন করতে হবে।
শেয়ারের ধরন
শেয়ারবাজারে দুই ধরনের শেয়ার দেখা যায়। প্রাইমারি শেয়ার আর সেকেন্ডারি শেয়ার। প্রাইমারি শেয়ার ইনিশিয়াল পাবলিক অফার বা আইপিও নামে পরিচিত। প্রাইমারি শেয়ার কিনতে আগ্রহীদের পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দরখাস্ত আহ্বান করে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি। বর্তমানে দেখা যায়, কোম্পানির প্রয়োজনীয় শেয়ার লটের চেয়ে প্রায় ৫০-৬০ গুণ এমনি ১০০ গুণ পর্যন্ত বেশি দরখাস্ত জমা পড়ে। সেজন্য সংশ্লিষ্ট কোম্পানি লটারির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় শেয়ার লট সংগ্রহ করে থাকে। যারা লটারির মাধ্যমে প্রাইমারি শেয়ার জয়ী হন, তাদের শেয়ারগুলোই সেকেন্ডারি শেয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রাইমারি শেয়ার বাজারে এলে বিও অ্যাকাউন্টধারী যে কেউ এই শেয়ার কেনাবেচা করতে পারে।
জানা জরুরি
যারা প্রাইমারি শেয়ার জয়ী হন সাধারণত তারাই বেশি লাভবান হয়। এবং ক্ষতির শঙ্কা নেই বললেই চলে। প্রাইমারি শেয়ারজয়ীদের লাভ এমনই বেশি হয় যে ১০ টাকার একটি শেয়ার বাজারে আসার প্রথম দিনেই ১০-২০ গুণও হয়, যেমনটা আমরা গ্রামীণফোনের শেয়ারের ক্ষেত্রে দেখেছি।
প্রাথমিক শেয়ার লটারির মাধ্যমে নির্বাচনের ফলে ভালো-খারাপ বিচার বিবেচনার সুযোগ কম কিন্তু সেকেন্ডারি শেয়ারে এমন সুযোগ না থাকায় কেনাবেচার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় ভালোভাবে জানতে হবে। যেমন- পিই রেশিও, নেট অ্যাসেট ভ্যালু বা প্রকৃত সম্পদ মূল্য, আরনিং পার শেয়ার (ইপিএস), রেকর্ড ডেট, রাইট শেয়ার, অনুমোদিত মূলধন ও পরিশোধিত মূলধন, ইয়ারএন্ড বোনাস ইত্যাদি।
আর্নিং পার শেয়ার
আর্নিং পার শেয়ার হলো একটি শেয়ারের ফেইস ভ্যালু বা প্রাথমিক মূল্য দিয়ে বছরে কত টাকা আয় করে তাকেই বুঝায়। ১০ টাকার একটি শেয়ার দিয়ে বছরে যদি ১০ টাকা আয় করা হয় তবে আয়ের এ ১০ টাকাই হবে ইপিএস বা আর্নিং পার শেয়ার। ইপিএস যত বেশি হয়, ধরে নিতে হবে সেই কোম্পানির অবস্থা তত ভালো।
বোনাস ও লভ্যাংশ
শেয়ারবাজারে আসা প্রতিটি কোম্পানি বছর শেষে তাদের আয়-ব্যয় হিসাব করে। বার্ষিক হিসাবের পর যদি কোম্পানির আয় হয় তাহলে সেই আয়ের একটা অংশ শেয়ারহোল্ডারদেরকে দেয়, তাকেই লভ্যাংশ বলে। কোম্পানি এ লভ্যাংশকে বোনাস শেয়ার হিসেবে অথবা নগদ টাকায় প্রদান করে থাকে। যেমন ধরুন সামিট পাওয়ার কোম্পানিটি বছর শেষে ২৫ শতাংশ বোনাস ঘোষণা করেছে। আর সামিট পাওয়ার যখন বাজারে প্রিমিয়ার ছেড়েছে তখন তার ফেইস ভ্যালু ছিল ১০০ টাকা। তাহলে ১০০ টাকার লভ্যাংশ হিসেবে আপনার শেয়ারের সঙ্গে আরো ২৫ টাকা যুক্ত হবে। তাহলে প্রতিটি শেয়ারের মূল্য দাঁড়ায় ১২৫ টাকা। এক্ষেত্রে আপনি ১০০ প্রিমিয়ারের শেয়ার যদি সেকেন্ডারি বাজার থেকে ১৫০০/২০০০ টাকা দরেও কিনে থাকেন, তাহলেও ১০০ টাকা হারেই আপনি বোনাস পাবেন।
রাইট শেয়ার
কোম্পানি যখন তার মূলধন বাড়াতে চায় তখন সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের অনুমতি নিয়ে বাজারে যে শেয়ার ছাড়ে তাকেই রাইট শেয়ার বলে। এ শেয়ার সবাই কিনতে পারেন না। যেসব শেয়ারহোল্ডার আগেই ওই কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন তারাই শুধু রাইট শেয়ার কিনতে পারেন। শেয়ারহোল্ডারদের কাছে এই শেয়ার অনেক মূল্যবান। কারণ বাজারের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে এই শেয়ারের দাম অনেক কম থাকে।
ইয়ার অ্যান্ড বা বর্ষশেষ
সাধারণত কোম্পানিগুলো তাদের শেয়ারহোল্ডারদের বছর শেষে লভ্যাংশ ও বোনাস দিয়ে থাকে। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সাধারণ অর্থবছর হলেও কোনো কোনো কোম্পানির অর্থবছর শুরু এবং শেষ হয় বছরের বিভিন্ন মাসে। বছরের যে মাস থেকে অর্থবছর গণনা করা হয় তার ঠিক এক মাস পেছনের মাসকেই ইয়ার অ্যান্ড ধরা হয়। যেমন জুলাই মাস থেকে বছর গনণা শুরু হলে শেষ হবে পরবর্তী বছরের জুন মাসে। যে মাসে বর্ষশেষ ঘোষণা করা হয় সে মাসে শেয়ারের দাম তুলনামূলক বেশি থাকে। কোনো কোম্পানি সম্পর্কে জানতে স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে কোম্পানি প্রোফাইলে কিক করতে পারেন।
রেকর্ড ডেট
কোম্পানি বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম), বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম), বোনাস, লভ্যাংশ ও রাইট শেয়ার যখন ঘোষণা করে সেই সঙ্গে রেকর্ড ডেটকেও নির্ধারণ করা হয়। আর রেকর্ড ডেটের সময় যাদের কাছে উক্ত কোম্পানির শেয়ার থাকে তারাই বোনাস, লভ্যাংশ ও রাইট শেয়ার পান। যেমন ধরুন রেকর্ড ডেটের আগের দিন কেউ উক্ত কম্পানির শেয়ার কিনলেন এবং রেকর্ড ডেটের পরের দিন বিক্রি করে দিলেন। আগের দিন কিনে এবং পরের দিন বিক্রি করে দেওয়ার পরেও ওই ব্যক্তিই কোম্পানির বোনাস, লভ্যাংশ পাবেন এবং রাইট শেয়ার কিনতে পারবেন। তাই কোনো শেয়ার কেনার আগে রেকর্ড ডেট সম্পর্কে জানা জরুরি।
অনুমোদিত ও পরিশোধিত মূলধন
প্রত্যেক কোম্পানির একটি নির্দিষ্ট মূলধন অনুমোদন করতে হয়। কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সভায় এ অনুমোদনের প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং পরে তা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে পাঠানো হয়। এসইসির অনুমোদন পাওয়ার পর তা কার্যকর হয়। এটি অথরাইজড ক্যাপিটাল বা অনুমোদিত মূলধন বলে বিবেচিত হয়। আর এ অনুমোদিত মূলধনের পেছনে বর্তমানে কত টাকা আছে তা-ই হচ্ছে পরিশোধিত মূলধন বা পেইডআপ ক্যাপিটাল।
কোনো কোম্পানির অনুমোদিত মূলধন যদি হয় ৫০০ কোটি টাকা, সেই কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ২০০ কোটি টাকাও হতে পারে। যে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন কম থাকে, সেই কোম্পানির শেয়ার কিনে লাভবান হওয়া যায় বলে মত দিয়েছেন শেয়ারবাজার বিশেজ্ঞরা। কারণ যে কোম্পানির পেইডআপ ক্যাপিটাল কম, সেই কোম্পানি বাজারে বেশি বেশি রাইট শেয়ার ছেড়ে মূলধন বাড়ায়। সেজন্য অনুমোদিত ও পরিশোধিত মূলধন সম্পর্কে জেনে শেয়ার কেনাবেচা করতে হবে।
অনলাইন ট্রেডিং
শেয়ার ব্যবসাকে আরও সহজ করার জন্য এখন চালু হয়েছে অনলাইনে শেয়ার কেনাবেচা। আগের মতো ব্রোকারেস হাউসের নির্দিষ্ট কে বসে শেয়ার কেনাবেচা করতে হবে না। গ্রাহক চাইলেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে শেয়ার কেনাবেচা করতে পারেন। তবে সেজন্য প্রয়োজন হবে একটা নির্দিষ্ট পাসওয়ার্ড। ইন্টারনেটে কেনাবেচার সুবিধা থাকার ফলে আগের মতো ব্রোকার হাউসে অর্ডার দিয়ে কেনাবেচা করতে হয় না।
আপনার প্রয়োজনে
শেয়ার বাজারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত টাকা বা পুঁজি। অনেককেই দেখা গেছে খুব অল্প পুঁজি নিয়ে এই ব্যবসায় নেমে অনেক টাকাকড়ি কামিয়েছেন। আবার অনেক পুঁজি বিনিয়োগ করেও কেউ কেউ ফতুর হয়েছেন। তবে এ ব্যবসার সাফল্য নির্ভর করে বুঝেশুনে ব্যবসা পরিচালনার ওপর। কোনোক্রমেই গুজবে কান দেওয়া যাবে না। পর্যাপ্ত তথ্য, নিজের প্রজ্ঞা এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের সমন্বয়ে শেয়ার ব্যবসা চালিয়ে রাখতে হবে। তা না হলে আপনার পুঁজি হারানোর ভয় তো আছেই, পাশাপাশি শেয়ারবাজারও অস্থিতিশীল হয়ে যেতে পারে। আর এই ঘটনা তো মাত্র কদিন আগেই ঘটল!
বাংলাদেশ সময় ২১৪৫, জানুয়ারি ২৭, ২০১১