ঢাকা, শনিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৭ মে ২০২৫, ১৯ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

চিনি ছাড়ুন, এসেছে স্টেভিয়া!

মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫:৩৪, এপ্রিল ২০, ২০১৪
চিনি ছাড়ুন, এসেছে স্টেভিয়া!

অনেকেই হয়তো এখনো জানেন না, চিনির বিকল্প হিসেবে নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে বাড়ির কাছের সুপার মার্কেটের তাক দখল করেছে একটি উপাদান।

অনেক অনুসন্ধান ও গবেষণা করে যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা চিনির বিকল্প হিসেবে জিরো ক্যালোরি, জিরো কার্বোহাইড্রেট ও রক্তে চিনির পরিমাণ বা শর্করার মাত্রা বাড়ায় না এমন এক প্রাকৃতিক উপাদান খুঁজে পেয়েছেন।



এ আশ্চর্য জিনিসটির নাম হচ্ছে ‘স্টেভিয়া’, যা চিনির চেয়ে প্রায় ২৫০-৩০০ গুণ বেশি মিষ্টি এবং খাদ্য ও পানীয়তে ব্যবহার করা হয়। এতে শরীরের ক্যালোরির মাত্রা বহুলাংশে কমে যায়।

যদিও এখন পর্যন্ত স্টেভিয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা এর কোনো খারাপ দিক চিহ্নিত করা  যায়নি, তবু ক্রেতা ও ব্যবহারকারীদের মধ্যে এ ব্যাপারে একটি ভয় কাজ করছে।

কেউ স্টেভিয়ার তৈরি চকলেট বা জেলি জাতীয় পদার্থ না কিনে স্টেভিয়ার গুঁড়ো বা সিরাপ কিনে ব্যবহার করে দেখতে পারেন।

এটা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান। উপাদানটিতে অ্যাসপার্টেম, সেকারিন, সুক্রলস বা কৃত্রিম মিষ্টি জাতীয় কোনো জিনিস নেই।

বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, দ্রব্যটি যে কৃত্রিম ‍উপাদান বর্জিত এ ব্যাপারে একটি লেভেল ও একটি ই-নম্বর সেঁটে দেবে ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও সংশ্লিষ্ট সংস্থা।

বিশ্বের খাদ্য ও পানীয় উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোও দ্রব্যটির ব্যাপারে সতর্ক। চিনির একটি বিকল্প খোঁজার জন্য তারা লাখ লাখ পাউন্ড ব্যয় করছে।

যদিও যুগ যুগ ধরে খাদ্যদ্রব্য মিষ্টি করতে চিনি ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু চিনির ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে আজ আর কারও অজানা নেই। অনেকে আবার সাদা চিনিকে স্লো পয়জন হিসেবেও মনে করেন। কেননা, স্থূলতা ও ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে চিনি মহামারি নিয়ে আসতে পারে। কাজেই চিনির বিকল্প খোঁজার জোর প্রচেষ্টায় এ আবিষ্কার বড় ধরনের আশার বাণীই।   

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিমাত্রায় চিনি খেলে এটা চর্বি আকারে লিভার/যকৃতের চারপাশে জমা হয়, ওজন বাড়াতে কার্যকরী এবং অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সেই  সঙ্গে এটা ডায়াবেটিসের দু’টি ধরনকে বাড়িয়েও দিতে পারে।

অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, চিনি মানুষের মস্তিষ্কে কোকেনের মতো প্রভাব ফেলতে সক্ষম। যার একমাত্র সমাধান চিনির বিকল্প কিছু খুঁজে বের করা।

অনেকের ধারণা, প্রাকৃতিকভাবে চিনির বিকল্প হিসেবে মধু ব্যবহার করা যায় এবং এটা স্বাস্থ্যসম্মতও বটে। ম্যাপল সিরাপ ও অন্য কয়েকটি সিরাপ মধু সিরাপ হিসেবে বিক্রি হয়।

গবেষকরা এই প্রাকৃতিক চিনিকে সাধারণ চিনির চেয়ে ভালো বলে মনে করেন।

ব্রিটিশ নিউট্রিশন ফাউন্ডেশনের বিজ্ঞানী ব্রিগেট বেনেলাম বলেন, ক্যালোরির মাত্রা কমিয়ে দিতে কাজ করে বলে মানুষ এ দ্রব্যটি পছন্দ করবেন, তাছাড়া এটা প্রাকৃতিকও। কিন্তু এর অন্য কোনো উপকারিতা আছে কিনা তা তর্কসাপেক্ষ। আর যাই হোক না কেন, সবশেষ কথা এটা আসলে প্রাকৃতিক উপাদান গাছ থেকে পাওয়া। তবে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো একইভাবে এই চিনিও মানুষের শরীরে চিনির মতো বিপাক ক্রিয়া ঘটায়।

গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপাকীয় মেডিসিনের অধ্যাপক ও ডায়াবেটিস গবেষক নাভেদ সাত্তার বলেন, চিনি হলো চিনি এবং ক্যালোরি হলো ক্যালোরি। এটা মধু, অ্যাগেভ নির্যাস বা সাদা চিনি থেকে এলো কিনা সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, এটা মানুষের শরীরে একইভাবে পরিপাকের কাজ করে।

তবে, এটা চিহ্নিত করা হয়েছে যে, সাধারণ চিনি, মধু, ম্যাপল নির্যাস সমপরিমাণ গ্লুকোজ এবং শর্করা দিয়ে গঠিত এবং অ্যাগেভ সিরাপ প্রাকৃতিক ফলের নির্যাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফল শর্করা থাকে। যা থেকে ফল শর্করা বের করে নিলে এটা ইনস্যুলিন লেভেলকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে।

সাত্তারের মতে, অতিরিক্ত ফল শর্করা গ্রহণ করা উচিত নয়। গবেষণায় উঠে এসেছে, অতিরিক্ত ফল শর্করা গ্রহণ করলে রক্তে চর্বির পরিমাণ বেড়ে যায় যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (হু) মানুষের খাদ্য তালিকা থেকে চিনির পরিমাণ অর্ধেকে নামিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছে।

স্টেভিয়া কি এক্ষেত্রে সমাধান হতে পারে? স্টেভিয়ার আদি নিবাস প্যারাগুয়ে। খাদ্যদ্রব্য মিষ্টি করতে জাপানে ৪০ বছর ধরে স্টেভিয়া ব্যবহার করা হচ্ছে। দক্ষিণ আমেরিকাতেও দীর্ঘদিন ধরে স্টেভিয়া ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০১১ সালে ইউরোপিয় ইউনিয়ন (ইইউ) স্টেভিয়া ব্যবহারের ছাড়পত্র দিয়েছে।

তবে স্টেভিয়ার একটা খারাপ দিক হলো, খাওয়ার পর এক ধরনের তিক্ত ভাব মুখে লেগে থাকে।

এটা এখন আর কোমল পানীয় কোকাকোলায় ব্যবহার করা হয় না, তবে স্প্রাইটে ব্যবহার করা হয়। স্প্রাইটের যে লেমন ফ্লেভার রয়েছে তার সঙ্গে এটি খুব ভালোভাবে মিশে যায়।

স্টেভিয়া সাধারণত চিনির সঙ্গে একযোগে ব্যবহার করা হয়। তার মানে এটি চিনির ২০-৩০ শতাংষ আংশিক প্রতিস্থাপন মাত্র। তবে স্টেভিয়াই একমাত্র সমাধান নয়।

যুক্তরাষ্ট্রে এক ধরনের চীনা ফল থেকে জিরো ক্যালোরির চিনি জাতীয় দ্রব্য উৎপাদন করা হয়, যা চিনি থেকেও ২০০-৩০০ গুণ বেশি মিষ্টি। সেটা কোমল পানীয় ও বিস্কুট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।  

লন্ডন মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির নিউট্রিশন পলিসি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক জ্যাক উইঙ্কলার বিশ্বাস করেন, এর ব্যবহার ব্রিটিশ খাদ্যকে আরও উন্নত করতে পারে।

তিনি বলেন, মানুষের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন করতে হবে। সেই সঙ্গে তারা যে জিনিস পছন্দ করে তা দিয়েই তাদের খাদ্যে পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে হবে।  

যুক্তরাজ্য সরকারের পুষ্টি বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা ডা. মার্গারেট অ্যাশওয়েল গবেষণায় দেখেছেন, প্রাকৃতিক মিষ্টি থেকে কেউ যদি কৃত্রিম মিষ্টিতে নিজের অভ্যাসটা ঘুরিয়ে নিতে পারেন তবে তার ওজন কমতে বাধ্য। প্রতি সপ্তাহে অন্তত গড়ে ২০ গ্রাম ওজন কমবে তার।  

২০১২ সালে ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন নামে একটি আমেরিকান জার্নালের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, যারা খাবার কন্ট্রোল করেন তাদের চেয়ে যারা  ক্যালোরিযুক্ত বা ডায়েট ড্রিংকস পান করেন তাদের ওজন ছয় মাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়।

অপরদিকে যাদের ওজন অতিরিক্ত, ডায়েট সুইটনার বা চিনির বিকল্প তাদের ওজন কমাতে সাহায্য করবে বলে মনে করেন অধ্যাপক নাভেদ সাত্তার। তার মতে, এতে তারা কম ক্যালোরিযুক্ত খাবার গ্রহণে উৎসাহিত হবেন বলেই ওজন কমে যাবে।

মিষ্টি জাতীয় খাদ্য গ্রহণের ফলে অধিকাংশ লোকের শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমা হয়। যদি তারা ডায়েট ড্রিংকস পান করেন তবে তাদের সেই চর্বি সহজেই কাটা যাবে। এতে তাদের অতিরিক্ত ক্যালোরি কমে যাবে। কিন্তু সবাই নকল মিষ্টি বা চিনি জাতীয় জিনিসে আকৃষ্ট হন না।

অনেকে আবার ডায়েটের ক্ষেত্রে ‘ওভার কম্প্রোমাইজ’ করেন। কিন্তু এটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। কেননা, এটা মানুষকে দুর্বল করে ফেলতে পারে এবং পরে মানুষকে আরও মুটিয়ে যেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।  

এ ডায়েটিং কখনোই আপনার ওজন কমাবে না যদি না আপনি আপনার খাদ্যাভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এটা কোনো রুপোর কাঠি নয়, যে ছোঁয়ালেই কাজ হয়ে যাবে।

প্রকৃতপক্ষে গবেষণায় দেখা গেছে, চিনির বিকল্প হিসেবে যা ব্যবহার করা হয় তাতে ওজন কমে। যেমনটা ডা. অ্যাশওয়েল তার গবেষণায় দেখেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পারডু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগের শিক্ষক সুসারের মতে, চিনির মতো অন্য মিষ্টি জাতীয় (কৃত্রিম) খাদ্য শরীরের স্বাভাবিক ক্যলোরিগুলোর ব্যবস্থাপনা গুলিয়ে ফেলে। যাতে করে হিতে বিপরীত হতে পারে। প্রতিক্রিয়ায় শরীরের ওজন অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দিতে পারে।

সাধারণত আমরা যখন মিষ্টি জাতীয় কিছু খাই তখন আমাদের মস্তিষ্ক শর্করা এবং ক্যালোরি গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হয় এবং ইনস্যুলিনের নিঃসরণ ঘটায়।

প্রফেসর সুইটার বলেন, যখন আমরা কৃত্রিম চিনি মেশানো মিষ্টি জাতীয় কিছু খাই তখন আমাদের মস্তিষ্ক শর্করা এবং ক্যালোরি পাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়, কিন্তু আদতে কিছু খুঁজে পায় না।

কাজেই আপনার শরীর তখন ওই বিষয়টির সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং তখন তারা অতিরিক্ত ক্যালোরি এবং হরমোনের নিঃসরণ ঘটায় না।

তিনি পরামর্শ দেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্যালোরি মস্তিষ্কের কেন্দ্র সক্রিয় থাকে না, আপনি যতোটা চান সে হিসেবে সে আপনাকে সন্তুষ্ট করতে পারে না, তখন আপনি বেশি খাওয়া কমিয়ে দেন।

ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির এন্ড্রোকায়নোলজিস্ট এবং ‘ফ্যাট চান্স: দ্য হিডেন ট্রুথ অ্যাবাউট সুগার’র লেখক রবার্ট লুসিং বলেন, প্রকৃত সত্য এটা যে, কৃত্রিম চিনির সমস্যা হলো মানুষ ভাবেন, অন্য যাই হোক না কেন, তিনি খাদ্য তালিকা মেনেই খাচ্ছেন। কিন্তু আসলে তিনি খাচ্ছে যতোটা প্রয়োজন তার চেয়ে কম। কিন্তু দেখা যায়, এটা মানসিক সমস্যা নাও হতে পারে। প্রাণরসায়ন শক্তি সঞ্চয়ের পরিচালনাকারী হতে পারে এবং  স্টেভিয়ার মতো প্রাকৃতিক চিনির ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটতে পারে।

কিন্তু অধ্যাপক নাভেদ সাত্তার কৃত্রিম চিনির এ ধরণের সমস্যায় ঠিক বিশ্বাসী নন। তিনি বলেন, যেসব মানুষ চিনিযুক্ত পানীয় বেশি পান করে তারা ডায়াবেটিসের মতো রোগের ঝুঁকিতে পড়েন।

সেই সঙ্গে তিনি একটি সহজ পথও বাতলে দেন, চিনি জাতীয় খাদ্য কম খাওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে যাদের মিষ্টির প্রতি আসক্তি আছে তাদের এ অভ্যাসটা পরিমিত করা‌।

সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, মানুষ চাইলেই তার ‍অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারে। যেমন, চিনি ছাড়া চা পানের কথাই ধরুন না কেন।

তিনি বলেন, সব শেষে আমি চিনির পরিবর্তে মানুষকে অন্য মিষ্টি জাতীয় জিনিস খেতে পরামর্শ দেই। তবে সবচেয়ে ভালো হয়, কেউ যদি মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়া বাদ দিয়ে দেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৫৩৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।