ঢাকা: কেউ কেউ সুখ খোঁজেন গাদা গাদা টাকাকড়িতে, কারও বা সুখ আকাশচুম্বি অট্টালিকার সোনারঙা খাটে। আবার কেউ এসব বিলাসিতাকে চিরতরে মন থেকে ঝেড়ে দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে প্রিয় আঙিনায় প্রাণের টানেন ঘুরে-ফিরে থাকেন দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর, যুগ কিংবা তারও বেশি দীর্ঘকাল ধরে।
জবির শিক্ষক, শিক্ষার্থী কিংবা কর্মচারী না হলেও দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। ভোরে ঘুম থেকে উঠে এই ক্যাম্পাসে এসে দেখেছেন ভোরের সূর্য, আর গৌধূলি লগ্নে সূর্যকে বিদায় দিয়ে ফিরেছেন নিজের ঘুম পাড়ানি বিছানায়।
পুরো নাম আবু বকর সিদ্দিক হলেও জবির শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে সিদু মামা নামেই পরিচিত তিনি। চা বিক্রি করতে করতে এই দীর্ঘ সময়ে কলেজ থেকে এই প্রতিষ্ঠানের বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হওয়া যেমন দেখেছেন। তেমনি জবিতে গমন করা কিংবা প্রস্থান করা লাখো মুখের সঙ্গে সঙ্গে চিনে নিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি ইট কিংবা ধূলিকণা।
তার ফ্ল্যাক্সের গরম লেবু-চা যেমন ক্যাম্পাসের আড্ডাবাজদের কাছে খুব জনপ্রিয় তেমনিই ভালোবাসার মানুষ এই সিদু মামা। সন্তান বা নাতিতুল্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সিদু মামার বন্ধুত্ব যেন আজন্মকালের, চির অকৃত্রিম। চা পানের সঙ্গে সঙ্গে সিদু মামা শোনেন প্রিয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুখ-দুঃখের গল্প। কখনো যোগান সান্ত্বনা, কখনো দেন সাধুবাদ বা এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।

সদা হাসিমুখ সিদু মামার বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলার শ্রীনগর ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামে। দুই ছেলে ও চার মেয়ের জনক তিনি। ভাগ্যের ফেরে দুই ছেলেই ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাদাম বিক্রি করে। বড় দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। মেঝ মেয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। আর সর্বকনিষ্ঠ মেয়েটি পড়ছে সপ্তম শ্রেণীতে। উচ্চাভিলাসী সংসার না হলেও মোটামুটি সুখের সংসার ছেড়ে প্রিয়তমা স্ত্রী না ফেরার দেশে চলে গেছেন ২০০৭ সালে।
সিদু মামা জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকায় আসেন আশির দশকে। প্রথম দিকে তিনি আদালত চত্বরে বাদাম বিক্রি করতেন। একটানা তিন বছর সেখানে কাজ করেন তিনি। এরপর তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের লাইব্রেরিয়ান তাকে একটা চায়ের ফ্ল্যাক্স কিনে দেন। সেই ফ্ল্যাক্স নিয়ে জগন্নাথেই শুরু হয় সিদু মামার চা বিক্রি পর্ব।
নিজের জীবনের দুঃখের গল্প আড়াল করলেও দুঃখ প্রকাশ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি মনে করে। রাজনৈতিক কারণে হোক বা অধিকার আদায়ের কারণে হোক, এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের রক্ত ঝরা দেখেছেন খুব কাছ থেকে। নিজের সন্তানের মতো শিক্ষার্থীদের অকাল মৃত্যু কিংবা পঙ্গুত্ব বরণ অথবা অভিশাপ বয়ে বেড়ানো তাকে ঘুমের ঘোরেও তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।
সিদু মামা নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানকে। জীবিত থাকতে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বারকয়েক দেখা করেছেন তিনি। তবে, রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে কোনো উপঢৌকন নেননি সিদু মামা। প্রয়াত রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে অঝোর ধারায় কেঁদেছিলেন তিনি। রাষ্ট্রপতির কবরে নিজ হাতে মাটি দেওয়াটাই এখন তার একমাত্র স্মৃতি।
জবিকে কেন এতো ভালবাসেন সিদু মামা? বলছেন তিনিই, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আমি যে ভালোবাসা পেয়েছি, সেটা আর কারও কাছ থেকে পাইনি। এখানকার মানুষগুলো আমার পরিবারের আপনজনের মতো।
সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ক্যাম্পাসে কাটানো সিদু মামা রাত কাটান বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে পাটুয়াটুলীতে বাবু মিয়া নামে এক ব্যবসায়ীর লেপ-তোষকের দোকানে।
শেষ জীবনে মামার কী লক্ষ্য? তার সহজ-সরল উত্তর, জগন্নাথ আমার ঘরবাড়ি, যতোদিন বাঁচি এই ক্যাম্পাসেই কাটিয়ে দিতে চাই।
জবির পাশ দিয়ে আবহমানকাল ধরে বইছে বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গার স্রোতের মতো সময়ের দৌঁড়ে এই ক্যাম্পাসে কেউ আসেন-কেউ যান। কিন্তু সিদু মামা থেকে যান, প্রাণের টানে, অকৃত্রিম ভালোবাসার টানে।
বাংলাদেশ সময়: ০৫৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৪