ড. আবদুল খালেক দেশে-বিদেশে বিজ্ঞানী হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জৈবরসায়নে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই যোগ দিয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে।
১৯৭৪ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অজর্নের পর ড. খালেক হলোওয়ে কলেজে যোগ দেন শিক্ষক হিসেবে। সেই সময় তিনি জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য একটি ইনজেক্টেবল ওষুধ উদ্ভাবন করে পশ্চিমা বিশ্বে বেশ সাড়া ফেলে দেন। এই উদ্ভাবনের খবরে মুগ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাকে দেশে ফেরার আহ্বান জানান। সেই সূত্র ধরে পরে জিয়াউর রহমানের সরকার তাকে দেশে নিয়ে আসেন।
১৯৭৬ সালে তিনি বাংলাদেশে এলেও এক বছর পর বিভিন্ন কারণে হতাশ হয়ে ফিরে যান লন্ডনে। আবার যোগ দেন রয়েল হলোওয়েতে শিক্ষকতার কাজে। তবে নতুন করে শুরু করেন গাছ ও মাটি নিয়ে গবেষণা।
এরপর, ১৯৮৪ সালে তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে ব্রিটিশ রয়েল সোসাইটির বৃত্তি নিয়ে বাংলাদেশে আসেন কৃষিবিষয়ে গবেষণার কাজে। এবার থেকে যান মাটির টানে, মানুষের টানে।
এখন পর্যন্ত তার নামে পেটেন্ট করা উদ্ভাবন রয়েছে ১৪টি। ড. খালেক এখন একটু বেশি পরিচিত তার উদ্ভাবিত ‘স্বর্ণা সার’-এর জন্য।
এই খ্যাতিমান বিজ্ঞানী গভীর আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, সারা পৃথিবী চরম খাদ্য সঙ্কটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এর কারণ, খাদ্যশস্যের বহুমুখী ব্যবহার, উৎপাদন হ্রাস ও ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠী। ‘আমাদের দেশও গভীরভাবে পড়ে আছে এই সংকটের ভেতর। প্রথমত, দেশে কী পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়, কী পরিমাণ খাদ্যশস্যের প্রয়োজন, সে সংক্রান্ত সঠিক কোনো তথ্য সরকারকেই প্রকাশ করতে হবে সততার সাথে। একদিকে সরকার বলে, খাদ্যে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ, অন্যদিকে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করে। ঘোষণা দিয়ে বছর বছর খাদ্যশস্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে বিভিন্ন অজুহাতে। ’
তার মতে, ‘সঠিকভাবে জমির পরিচর্যা ও দেশি জাতের ফসল ফলিয়ে আমরা অভ্যন্তরীণ চাহিদার তুলনায় বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে পারি। আমাদের দেশে বিভিন্ন জাতের ধান আছে। এগুলো উচ্চফলনশীল ধানের তুলনায় বেশ কম সময়ে ও কম খরচে তুলনামূলকভাবে বেশি ফলন দেয়। অথচ, সরকার কৃষকদের উচ্চফলনশীল ধান চাষে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করে যাচ্ছে। এসব ধান চাষে প্রচুর পরিমাণে সার ও সেচের প্রয়োজন হয়। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। ’
তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন প্রচলিত উৎপাদন ব্যবস্থায় বছরে একরপ্রতি ধান উৎপাদন করা হয় গড়ে ১৮ মণ। অথচ, দেশি জাতের ধান ও গঠনমূলকভাবে জৈবসার ব্যবহার করে আমরা বছরে একর প্রতি গড়ে ৫৫ মণ ধান উৎপাদন করতে পারি। ’
১৯৯৪ সালে পেটেন্ট হওয়া ড. খালেক উদ্ভাবিত পৃথিবীর একমাত্র জৈবসার ‘স্বর্ণা সার’ তাকে পরিচিত করে তুলেছে এ দেশের গণমানুষের কাছেও। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এই জৈবসার সংগ্রহ করার জন্য পৃথিবীর অনেক উন্নত, স্বল্পোন্নত দেশ ব্যাপক আগ্রহী হলেও এ দেশের কৃষি বিভাগ একসময় এই সারটির ব্যবহার ‘নিষিদ্ধ’ করেছিল। ‘বিষয়টি শেষ পর্যন্ত আদালত পর্যন্ত গড়ায়। স্বর্ণার পেটেন্ট থাকায় আদালত সরকারের ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণাকে অযৌক্তিক বলে রায় দেন,’ বলেন ড. খালেক।
‘স্বর্ণাসার’ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘একসময় আমাদের দেশের কৃষকরা জমির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য গোবর, ছাই, পচা কচুরিপানা বা ঘাস-পাতা ইত্যাদি ব্যবহার করতেন। এসব প্রাকৃতিক উপাদান মাটিতে মিশে জমির উর্বরাশক্তি ফিরিয়ে আনত। এমনকি, কোনো কোনো জমি অনাবাদিও রাখা হতো, একে পরবর্তী ফসলের জন্য উপযুক্ত করে তোলার জন্য। ’
একটু ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, একজন অসুস্থ মানুষের সবার আগে প্রয়োজন বিশ্রাম, যাতে শরীর তার জীবনীক্ষমতা প্রাকৃতিকভাবেই ফিরিয়ে আনতে পারে। ওষুধ সেই প্রাকৃতিক অর্জনকে সহযোগিতা করবে। ‘অথচ, এখন আমরা ওষুধ খাই যাতে দ্রুত সুস্থ হয়ে আবার কাজে যোগ দিতে পারি। এর ফলে আমাদের শরীর নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ’ একই চিত্র দেখা যায় জমি ‘অসুস্থ’ হয়ে পড়লে।
এই ব্যস্ততম সময়ে অনাবাদি রেখে জমিকে বিশ্রাম দেওয়া তো দূরের কথা, জমির উর্বরতা প্রাকৃতিকভাবে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয় সময় ও উপাদানও আজ কৃষকের হাতে নেই। এই বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর মতে, ‘এর পেছনেও আছে রাজনীতি। সেই আইয়ুব খানের আমলে যখন তৎকালীন পূর্বপকিন্তানে প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়া গেল, তখন শাসকগোষ্ঠী ভাবল গ্যাস তো আর পশ্চিমে নেওয়া যাবে না, বরং একে ইউরিয়া বানিয়ে সহজেই পশ্চিমে নেওয়া যাবে। ’
‘তখন আইয়ুব সরকার কৃষি-বিপ্লবের নামে দেশের কৃষকদের ইউরিয়া সার ব্যবহারে একরকম বাধ্য করে। ইউরিয়ার ক্ষতি কমানোর জন্য এর সঙ্গে টিএসপি ব্যবহার করতে বলা হয়। সেই ‘ঐতিহ্য’ এখনো চলছে। এখনো এই দেশের আমলাতন্ত্রনির্ভর সরকাররা রাসায়নিক সারের প্রচার-প্রসার চালিয়ে যাচ্ছে। ’
ড. খালেকের ভাষায়, ‘মাটিতে থাকে গাছের খাবার। স্বর্ণা একটি জৈবসার হিসেবে জমিতে প্রাকৃতিকভাবে গাছের খাবার তৈরিতে সাহায্য করে। এই সার উদ্ভাবনে আমি আমাদের ঐতিহ্যগত জ্ঞানের সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের মিশ্রণ ঘটিয়েছি। ’
এই বিজ্ঞানী বলেন, ‘রাসায়নিক সার ব্যবহার করলে মাটিতে থাকা ব্যাকটেরিয়া মারা যায়। মাটি তার স্বাভাবিক উর্বতা হারায়। তাই প্রথমবার যে পরিমাণ রাসায়নিক সার জমিতে ব্যবহার করা হয় দ্বিতীয়বার তার চেয়ে বেশি সার লাগে। নিয়মিত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় একসময় মাটি নষ্ট হয়ে যায়। ’
‘অন্যদিকে জৈবসার মাটিতে ব্যকটেরিয়া জন্ম নিতে সাহায্য করে। ফলে, মাটি প্রাকৃতিকভাবে তার উর্বরতাশক্তি অর্জন করতে পারে। প্রতি কিউবিক মিটার উর্বর মাটিতে ব্যাকটেরিয়া থাকে সাত থেকে আট মিলিয়ন। আমাদের দেশে এর পরিমাণ গড়পড়তায় ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন। আমাদের জমি ভয়াবহ অনুর্বরতার দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে। এ থেকে মুক্তির একমাত্র রাস্তা প্রাকৃতিকভাবে জমির উর্বরতা ফিরিয়ে আনা। ’
‘আমাদের দেশে বেশি বেশি রাসায়নিক সার ব্যবহার করার কারণ, আমরা উচ্চ ফলনশীল জাতের বা এইচওয়াইভি ফসল আবাদ করি। এ ধরনের ফসলের খাবার বেশি লাগে। তারা মাটি থেকে খাবার নিয়ে মাটিকে দ্রুত অসার করে ফেলে। এই অবস্থা চলতে থাকলে এমন একটি সময় আসবে, যখন এই অসার জমিতে আর কোনো ফসল ফলানো সম্ভব হবে না। ’
ড. খালেকের মতে, ‘যদি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে ৭০ কেজি রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় তাহলে জৈবসার হিসেবে ‘স্বর্ণা’র প্রয়োজন হবে মাত্র ৩ কেজি। এর দাম রাসায়নিক সারের তুলনায় খুবই কম। ’
তিনি আরো জানান, ‘উন্নত ও অধিকাংশ কৃষিপ্রধান দেশে সার হিসেবে ইউরিয়ার ব্যবহার খুবই কম। সেটাও আবার মাটির জন্য উপযোগী করে নেওয়ার পর জমিতে দেওয়া হয়। অথচ, এটা চাপিয়ে দেওয়া হয় দরিদ্র দেশগুলোতে, যেখানে বৈজ্ঞানিক গবেষণা নেই বললেই চলে। ’
তিনি দেশে উদ্ভাবনী গবেষণার ওপর জোর দেন এবং আশা করেন, এ বিষয়ে সরকার প্রথমে প্রয়োজনীয় ও স্বাধীন অবকাঠামো গড়ে তুলবে। তিনি আবারো মনে করিয়ে দেন যে, খাদ্য সংকটের এই কঠিন সময়ে সরকারের হাতে যদি সঠিক তথ্য থাকে তাহলে সেই তথ্যের ভিত্তিতে তাকেই খুঁজে বের করতে এ থেকে উত্তরণের সঠিক পথ।
কৃষি উন্নয়নের জন্য এই কৃষিপ্রধান দেশের বিজ্ঞানী জৈবসার ছাড়াও উদ্ভাবন করেছেন আলু সংরক্ষণের জৈব উপায়, যার ফলে কৃষকরা সারা বছর আলু নিজেদের ঘরেই সংরক্ষণ করতে পারবেন।
তার পেটেন্ট করা উদ্ভাবনের ভেতর আরো আছে হাইড্রোপনিক সার, যার মাধ্যমে পানিতেই চাষ করা যাবে টমেটো ও মটরশুঁটি। শীতকালে মাছের মড়ক রোধের একটি প্রতিষেধকও আছে তার উদ্ভাবনের তালিকায়।
জৈববিজ্ঞানে ড. খালেকের আরেকটি বিশিষ্ট উদ্ভাবন হলো মরুকরণ রোধের জন্য জৈব উপকরণ।
বর্তমানে এই বিজ্ঞানী খাদ্য ফসলের জীবনচক্রের ওপর কাজ করছেন। ‘আমি বারবার ভবিষ্যৎ খাদ্যশস্যের চরম সংকটের আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছি। সেই ভাবনা থেকেই চেষ্টা করছি ফসলের উৎপাদন ঠিক রেখে এর জীবনচক্রের সময়টাকে কীভাবে কমিয়ে আনা যায়। ’ তিনি আশা করেন, এই কাজে সফল হলে অল্প সময়ে ভালো ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে, যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত দরকারি।
বাংলাদেশ সময় ১৬৫০, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১১