ঢাকা, শনিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৭ মে ২০২৫, ১৯ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

উপকূল থেকে উপকূল

যে স্কুলে তথ্যপ্রযুক্তি খুলে দিয়েছে আনন্দের জগৎ

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫:৩৪, মে ২৯, ২০১৪
যে স্কুলে তথ্যপ্রযুক্তি খুলে দিয়েছে আনন্দের জগৎ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

এনাম নাহার, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম ঘুরে এসে: তথ্যপ্রযুক্তির ক্লাস চলছে। শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষের মেঝেতে বসেই শিক্ষকের কথা শুনছে।

এই ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মনযোগ খুব বেশি। কম্পিউটার, ইন্টারনেট, অনলাইন মিডিয়াসহ তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে স্কুলের সর্বকনিষ্ঠ ষষ্ঠশ্রেণির শিক্ষার্থীদের ধারণাও অনেক পরিষ্কার। ওদের সঙ্গে আলাপ করে সেটাই বোঝা গেল।

এ-যেন উপকূলের দ্বীপে চারিদিকে গাঢ় অন্ধকারের মাঝে এক টুকরো আলো। যেখানে প্রত্যন্ত এলাকার অধিকাংশ বিদ্যালয়ের কম্পিউটার শিক্ষায় নানান প্রতিবন্ধকতা, শিক্ষার্থীরা জানেই না তথ্যপ্রযুক্তি কী জিনিস, সেখানে সন্দ্বীপের একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের এই চিত্র আশার আলো জাগায় সংশ্লিষ্টদের মনে।

বিচ্ছিন্ন দ্বীপ সন্দ্বীপের প্রাণকেন্দ্র এনাম নাহার নামক স্থানে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পূর্ব সন্দ্বীপ বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয়। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বরাবরই পাঠ্যবইয়ের প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বিশেষ দক্ষতা অর্জনের ওপর জোর দিচ্ছে। বইপড়া, লেখালেখি করা, দেয়ালিকা প্রকাশ, নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি এই অঞ্চলে এই প্রতিষ্ঠানই ধরে রেখেছে। আর এসবের ধারাবাহিকতায় বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রবেশ করছে তথ্যপ্রযুক্তির জগতে।

বিদ্যালয় ঘুরে এর প্রমাণই মেলে। তথ্যপ্রযুক্তি ক্লাসের জন্য বিদ্যালয়ের একটি কক্ষ নির্ধারিত। মেঝেতে বসেই শিক্ষার্থীরা স্যারের কথা শোনে। এই ক্লাসটিতে দেখা গেলো অনেক শিক্ষার্থী। ক্লাসের পড়ায় মনযোগও আছে যথেষ্ট। প্রশ্ন করলে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থী তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়ক প্রশ্নের জবাব দিল। আলাপে বোঝা গেল, ইন্টারনেটের ধারণা ওদের কাছে বেশ পরিষ্কার।

তথ্যপ্রযুক্তি ক্লাসের শিক্ষক সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, অন্যান্য ক্লাসের চেয়ে কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্লাস নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ বেশি। কম্পিউটার ক্লাসে তাদের বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। অন্য কোনো ক্লাস মিস করলেও এই ক্লাসটি তারা মিস করে না।

তথ্যপ্রযুক্তি ক্লাসের এই কক্ষে ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। তবে ৭টি কম্পিউটারের মধ্যে ২টি অকেজো। রয়েছে একটি কম্পিউটার ল্যাবও। এছাড়া কয়েকজনের শিক্ষকের ব্যক্তিগত ল্যাপটপও বিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তির ক্লাসের জন্য বেশ সহায়ক। কয়েকজন শিক্ষকের কম্পিউটার ক্লাসের উপর প্রশিক্ষণও আছে। কম্পিউটার চালানোর জন্য রয়েছে বিদ্যুতের ব্যবস্থা। আবার বিকল্প হিসাবে রয়েছে সৌর বিদ্যুত।               

এতো গেলো তথ্যপ্রযুক্তির ক্লাসের কথা। বড়পর্দায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের জন্য বিদ্যালয়ের প্রত্যেক শ্রেণিকক্ষে ব্যবস্থা রয়েছে। মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস নেওয়া হয়। এর ফলে ছবিতে বইয়ের পড়া সহজেই বুঝতে পারছে শিক্ষার্থীরা। এমনই একটি ক্লাসে উপস্থিত থেকে বাংলানিউজ জানতে পেরেছে শিক্ষার্থীদের অনুভূতি। ওরা জানালো, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস আমাদের লেখাপড়া সহজ করে দিয়েছে।

মাল্টিমিডিয়া ক্লাস পরিচালনাকারী শিক্ষক আফজাল হোসেন জানালেন, এই ক্লাসের মাধ্যমে একদিকে শিক্ষার্থীদের কাছে পড়াটা সহজ হচ্ছে, অন্যদিকে ওরা তথ্যপ্রযুক্তির জগতে প্রবেশ করছে। আর এ বিষয়ে ওদের আগ্রহও বাড়ছে। দ্বীপের অনেক এলাকা তথ্যপ্রযুক্তি-জ্ঞান সম্পর্কে পিছিয়ে থাকলেও এই বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা জোরকদমে এগিয়ে।

বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেলো, বিদ্যালয়ে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার রয়েছে। শিক্ষার্থীরা এখান থেকে বই বাড়িতে নিয়ে পড়তে পারে। অন্যদিকে রয়েছে লেখালেখির চর্চা। বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে শিক্ষার্থীরা বের করে দেয়ালপত্রিকা। নাটক, গান, ছবি আঁকা, সব ক্ষেত্রেই এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে।

শিক্ষার্থীদের এইসব বিষয়ে উৎসাহদাতা শিক্ষক মো. আবুল কাশেম শিল্পী বলেন, প্রত্যন্ত এই এলাকার শিক্ষার্থীরা অনেক দিক থেকেই পিছিয়। ওদেরকে কিছুটা এগিয়ে নিতে, ওদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতেই আমাদের এই উদ্যোগ। বেশ সাড়াও মিলছে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল মান্নান বলেন, তথ্যপ্রযুক্তিসহ অন্যান্য বিষয়ে ছেলেমেয়েদের আগ্রহ দেখে আমরাও উৎসাহিত। ছেলেমেয়েরা বিদ্যালয়ে তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান নিয়েই বসে থাকছে না। অনেকে নিজের বাড়িতেও চর্চা করছে। অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপ কিনে নিয়েছে।

তিনি বলেন, এই পর্যায়ে আসতে আমাদেরকে অনেক প্রতিবন্ধক পেরোতে হয়েছে। এক সময় সন্দ্বীপে বিদ্যুৎ ছিল না। কম্পিউটার চালাতে ছিল না দক্ষ জনবল। দ্বীপে আমরা ইন্টারনেট সংযোগ পেতাম না। এখনও কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। আমরা চাই সব সমস্যা কাটিয়ে বিদ্যালয়ের প্রতিটি ছেলেমেয়ে তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত হোক।

সূত্র বলছে, পূর্ব সন্দ্বীপ বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয়টি সন্দ্বীপের অনেক পুরনো স্কুল। ১৯০৮ সালের আগে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত এটি চালু ছিল। এরপর থেকে এটি মুছাপুর এম.ই স্কুল হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৩৭ সালে মুছাপুর জুনিয়র স্কুল হিসেবে উন্নীত হয়। ১৯৬৭ সালের পহেলা জানুয়ারি এটি বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয় হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়।     
  
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখাবেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।