ঢাকা, শনিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৭ মে ২০২৫, ১৯ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

প্রশ্নপত্র ফাঁস, হাতেমতায়ীর উত্তর পত্র মূল্যায়ন!

নাগরিক মন্তব্য ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:৪৮, জুন ১, ২০১৪
প্রশ্নপত্র ফাঁস, হাতেমতায়ীর উত্তর পত্র মূল্যায়ন!

ঢাকা: বাংলানিউজের নাগরিক মন্তব্যে লিখিতভাবে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের প্রাক্তন ছাত্র আহসান আহসানুল হাবিব। বর্তমানে থাকেন সিলেট সেনানিবাস এলাকায়।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের পাশাপাশি তিনি লিখেছেন পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন নিয়েও।

তিনি লিখেছেন, " নবীন কিশোর তোমাকে দিলাম ভুবন
ডাঙার মেঘলা আকাশ,
তোমাকে দিলাম বোতাম বিহীন
ছেড়া শার্ট আর ফুসফুস হাসি। " ---উত্তরাধিকার কবিতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিশোরকে বোতাম খোলা শার্টের মত চঞ্চল করে সাজিয়ে তাকে ফুসফুস ভরা হাসি দিতে পারলেও এ যুগে এসে আমরা পরীক্ষা আগের রাতে তাদের হাতে প্রশ্নপত্র
তুলে দিয়েছি, শিক্ষা বোর্ড হাতেমতায়ী হয়ে উত্তরপত্রে নম্বর দিয়েছে।

ফলশ্রুতিতে তারা আমাদের গোটা দেশকে ভাসিয়েছে জিপিএ- ৫ এর বন্যায়, বাবা মার মুখ করেছে উজ্জ্বল, স্বপ্ন দেখেছে ভবিষৎ ক্যারিয়ার নিয়ে আর বরাবরের মত সকল সরকারের মুখে তুলে দিয়েছে একটিই বাণী ‘আমাদের সময়ে দেশে শিক্ষার
বিস্তার সবচেয়ে বেশী হয়েছে। ’

প্রথমেই আসা যাক প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রসঙ্গে। কোথা থেকে ফাঁস হয় প্রশ্ন? প্রথমত বলতে হবে বি.জি প্রেস এর কথা। প্রশ্ন ছাপানোর সময় বি.জি প্রেস এর কিছু অসাধু ব্যক্তির হাত দিয়েই ফাঁস হচ্ছে প্রশ্ন। দ্বিতীয়ত, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকসহ জে.এস.সি, পি.এস.সি পরীক্ষার প্রশ্ন শিক্ষাবোর্ড হতে জেলা প্রশাসক ও থানা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে পাঠানো হয়।

সেখান থেকে জেলা প্রশাসক ও থানা নির্বাহী অফিসারের(ইউএনও) প্রতিনিধিরা পরীক্ষা শুরু হওয়ার ঘণ্টা খানেক আগে পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রশ্ন পৌঁছে দেন। সুতরাং জেলা প্রশাসক ও ইউএনও কার্যালয় থেকে কিছু অসাধু ব্যক্তির হাত দিয়ে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। পরবর্তীতে ফেসবুক ও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে প্রশ্ন।

দুই:
প্রশ্ন পত্র ফাঁস হবার পর সেই ফাঁসকৃত প্রশ্নে পরীক্ষা নিয়ে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিশেষ নজির স্থাপন করেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় বোর্ড কর্তৃক নির্ধারণ করে দেওয়া উত্তর পত্র মূল্যায়ন নীতি। অবশ্য সব সরকার তার আমলে পাসের হার বৃদ্ধি করে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য শিক্ষা বোর্ডকে চাপ দেয়। চাপ এর প্রভাবে শিক্ষা বোর্ড উত্তর পত্র মূল্যায়ন এর যে নীতি প্রণয়ন করেছে তা দেখলে মনে হবে এটি দানবীর হাতেমতায়ীর প্রণীত। এর কয়েকটি নীতি নিম্নরুপ:

১) উত্তর পত্র পড়ে নম্বর দিলে পরীক্ষার্থী নম্বর কম পাবে, তাই না পড়ে নম্বর দিবেন। ভুল শুদ্ধ যাই লিখা থাক, লিখলেই নম্বর দিতে হবে। ২)প্রশ্ন পত্রে লেখা থাকে সাধু ও চলিত মিশ্রণ দূষনীয় তবে উত্তর পত্র মূল্যায়ন নীতি অনুসারে গুরুচণ্ডালী দোষে নম্বর কাটা যাবে না, এমনকি বানান ভুলেও নম্বর কাটা নিষেধ।
৩)ফিগারেটিভ নম্বর দিতে হবে। অর্থাৎ কেউ ২৬ পেলে তাকে ৩০ দিতে হবে। অনুরুপ ৩১ পেলে ৩৫, ৩৬ পেলে ৪০, এভাবে ১০০ পর্যন্ত।

৪) কেউ ৪৩ পেলে তার গ্রেড বাড়ানোর জন্যে ৫ নম্বর বাড়িয়ে তা ৪৮ করে দিতে হবে। ৫) সৃজনশীল পদ্ধতিতে রচনামূলকে ২০ হলো পাশ নম্বর। কাউকে ২০ এর কম দেওয়া যাবে না। ৬) কাউকে ফেল করানো যাবে না। অবশেষে এসব নীতিতে শিক্ষকদের উত্তর পত্র মূল্যায়ন করতে ৬০০-৭০০ উত্তর পত্র মূল্যায়নের জন্য সময় দেওয়া
হয় মাত্র ৬ থেকে ৭ দিন।

ফলাফলের তিনটি ধাপ, বিবেচনা করলে উত্তম, অতি উত্তম, সর্বোত্তম এই ৩টি ধাপে আসা যায়। যেখানে জিপিএ ৫ কে সর্বোত্তম। আর জিপিএ ৫ যখন পাইকারি দরে দেওয়া হচ্ছে তখন দেশে উত্তম কিংবা অতি উত্তম থেকে সর্বোত্তম এর সংখ্যাই বেশীই।

এরুপ অপমুল্যায়নের ফলে অযোগ্যরাও জিপিএ-৫ পাচ্ছে। যোগ্য ও মেধাবী যখন জিপিএ ৫ পায় আর তার অযোগ্য ফেলুরাম সহপাঠীও যখন মূল্যায়ন নীতি ও প্রশ্ন ফাঁসের প্রভাবে জিপিএ- ৫ পেয়ে একই কাতারে দাঁড়ায় তখন কি যোগ্য মেধাবীকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে না??

সাথে সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে কিছু পরিবারের সাথে। কিভাবে? শুনুন তাহলে, যে ছাত্র স্কুল কলেজের অর্ন্তবর্তী পরীক্ষায় সারা জীবনে জিপিএ ৫এর গণ্ডি পেরোতে পারেনি সে যখন মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পায় তখন তার বাবা মা আশায় বুক বাধেন, স্বপ্ন দেখেন ছেলেকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানানোর।

সেই ছেলে যখন কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হতে পারে না তখন তার অভিভাবক ঐ জিপিএ ৫ নামক ভালো ফলাফলের জন্যে অনেক সময় জমি-জমা বিক্রি করে ব্যয় বহুল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। আদৌও ঐ ছেলের প্রকৌশল বিদ্যা পড়ার মত যোগ্যতা আছে কি?

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার গ্রেড পরবর্তীতে মেডিকেল, বুয়েট, প্রকৌশল এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সময় গণনা করা হয়। এখন, যে স কল শিক্ষার্থী ‘সদা সত্য কথা বলিব, সৎ পথে চলিব’ এই আদর্শ বাক্যে বিশ্বাস করে এসব ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের ধার ধারে নি বরং নিজের মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে পরীক্ষা দিয়েছে তাদের সততার মূল্য কে দিবে?

বস্তুত, পরিশ্রমী ও মেধাবীরা ফাঁস হওয়া প্রশ্নের ধার ধারে না উল্টো ফেলুরাম ও অনিয়মিত ছাত্ররাই এসব ফাঁসকৃত প্রশ্ন দিয়ে ফায়দা লুটে নিচ্ছে। সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এর গ্রেড গণনার সময় মেধাবীদের জন্য কিছুটা হলেও হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

এভাবে ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে হাতেমতায়ীর মতো উত্তর পত্র মূল্যায়ন হওয়ার সুবাদে দুটো জিপিএ ৫ নিয়ে অনেকেই যখন কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পা রাখতে না পারায় ক্যারিয়ার নিয়ে দেখা স্বপ্ন গগনচুম্বি হয়ে দাঁড়ায় এবং সেই ছাত্র ভূপাতিত হয় অবশেষে। আর এভাবেই সুনীলের দেওয়া ফুসফুস ভরা হাসি মিলিয়ে যায়। জিপিএ ৫ এর বদৌলতে পাওয়া ক্ষণিকের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে যায় এবং তারা কড়া নাড়ে এক অনিশ্চিত ভবিষতের দরজায়।

মুক্তি পেতে কেউ পথ হারিয়ে পাড়ি জমিয়েছে নেশার সাগরে, কেউ খুঁজেছে অন্য রাস্তা। আর দুই একজন যারা ব্যতিক্রম তারা ঘুরে দাঁড়ানোর জন্যে এখনো লড়াই করছে। বন্ধ হোক প্রশ্নপত্র ফাঁস, সঠিকভাবে মূল্যায়ন হোক উত্তর পত্র আর চির সবুজ থেকেই আমাদের কিশোর হয়ে উঠুক তরুণ ডাক্তার, ব্যাংকার, বিজ্ঞানী, আইনজীবী কিংবা প্রকৌশলী। ,

বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, জুন ০১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।