মাঝেরচর, মঠবাড়িয়া, পিরোজপুর ঘুরে এসে: এখানে মুমূর্ষু রোগীদের ডাক্তার পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। শিশুরা প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকে উঠতে হিমশিম খায়।
এক প্রান্তে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া, অন্য প্রান্তে বাগেরহাটের শরণখোলা। মাঝখানে সমুদ্র মোহনার ভয়াল বলেশ্বর নদীর বুকে জেগে আছে একখণ্ড বাংলাদেশ, নাম তার মাঝেরচর। এটি মঠবাড়িয়া উপজেলার বেতমোর রাজপাড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড।
সরেজমিনে বাংলানিউজ দেখতে পেয়েছে বছরের অধিকাংশ সময় বিপন্নতায় থাকা এই মাঝেরচরের মানুষের জীবন। ঝুঁকিতে বসবাস, আবার তারই মাঝে জীবিকার লড়াই। জোয়ারের পানিতে বাড়ি-ঘর তলিয়ে যাওয়া জনপদ যেন কেবলই ভাটির অপেক্ষায় থাকে।

পুব আকাশে ভোরের আভা তখনও মিলিয়ে যায়নি। চরের কিছু মানুষের ঘুম ভাঙেনি তখনও। অনেকে আবার কাজে বেরিয়ে পড়েছেন অনেক আগেই। নদীতে মাছ ধরা, মাঠে ফসল আবাদ, বেচা-কেনার আশা নিয়ে দোকানটা খুলে বসা, কত কাজ মানুষের হাতে!
শরণখোলার গাবতলা থেকে মাঝেরচরের পশ্চিম প্রান্তে যাত্রীবাহী ট্রলার ভেড়ে, গন্তব্য মঠবাড়িয়ার মাছুয়া ঘাট। একই পথে ট্রলারটি ফিরবে দুপুরে। চর থেকে যাতায়াতের জন্য এটা অন্যতম বাহন। এমন বাহন রয়েছে আরও কয়েকটি। ছোট্ট এ ট্রলারগুলো ঝড়ের দিনে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করে।
চরের পশ্চিম ঘাটে উঠে এসব বিষয় নিয়েই আলাপ হচ্ছিল ৮০ বছর বয়সী আলী আকবরের সঙ্গে। দেশ স্বাধীনের পর থেকে এই চরের বাসিন্দা তিনি। তার হিসাবে চরটির বয়স অন্তত শত বছর।
এক পাড়া থেকে আরেক পাড়া, এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম। হাঁটাপথে দেখা চরের আরেকজন পুরোনো বাসিন্দা হযরত আলীর স্ত্রী মেরী বেগমের সঙ্গে। নানা সমস্যার কথা জানাতে গিয়ে তিনি বললেন, এখানে মানুষের দুর্ভোগের কথা কেউ দেখতে আসেন না। চরের বাসিন্দারা জোয়ারে ভাসেন, ভাটায় ঘর থেকে বের হন। জরুরি সময়ে ডাক্তার পাওয়া যায় না। এজন্য অনেকে আবার কিছু ওষুধপত্র ঘরে রাখেন। মেম্বার চেয়ারম্যান থাকলেও বিপদে তাদের পাশে পাই না।

সরেজমিন ঘুরে চোখে পড়ে, চরের চারদিকে রয়েছে নিচু একটা রাস্তা। ভাঙনে এ রাস্তা অনেক স্থানে ধসে গেছে। পুরো চর পায়ে হেঁটে ঘুরে আসা এখন কঠিন। বেশ কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকো পারাপার হতে হয়। ক্রমাগত ভাঙনে চরের জমির পরিমাণও কমে যাচ্ছে। দিনের কাজে বের হওয়ার আগে ঘরের দাওয়ায় বসে এসব কথা বলতে বলতেই ৭০ বছর বয়সী চরের বাসিন্দা আবদুস সালাম জমাদ্দার জানাচ্ছিলেন চরে জমির অধিকার নিয়ে লড়াইয়ের কথা। একটি প্রভাবশালী চক্রের চক্রান্তে বহু ভূমিহীন নিজের জমিটুকু ফিরে পাননি।
চরের কাঁচা রাস্তা জোয়ারের পানিতে ডুবে যায়, বর্ষায় রাস্তায় জমে থাকে কাদাপানি। এ রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চরের পূর্ব প্রান্তে গিয়ে খানিক পিচঢালা রাস্তা পাওয়া যায়। প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরের পরে মাঝেরচরের পূর্বপাড়া খেয়াঘাটে কিলোমিটার খানেক রাস্তা পিচ ঢালাই করা হয়েছে। তবে এতোদিনে তাও ভেঙ্গে গেছে। অনেক স্থানে ভেঙ্গে গেছে। অন্য এলাকায় কোনো পাকা রাস্তা নেই।
পূর্বপাড়ার খেয়াঘাটে সব সময়ই ভিড় থাকে মানুষের। এখানে মাছের ট্রলার ভেড়ে। ওপারে মঠবাড়িয়ার সঙ্গে যাতায়াতও এ পথেই। ঘাটে আছে পাকা সিঁড়ি। এ পথে প্রতিদিন যাতায়াত করেন বহু মানুষ। এ ঘাটে আলাপ হলো বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে। সবাই চরের নানা সমস্যার কথা কথা তুলে ধরেন। তারা বলেন, এক দুর্যোগে রাস্তা তৈরি হলে আরেক দুর্যোগে তা ভেঙ্গে যায়। তাদের মতে, ভাঙন চরের সবচেয়ে বড় সমস্যা। সাইক্লোন শেলটারের বেতার চালক আবদুল হালিম, মাছ ব্যবসায়ী আবু জাফর, শাহ আলম মোল্লা, আবুল হোসেসহ আরও অনেকে সার্বিক তথ্য দেন।

চরবাসী জানালেন, এখানে বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট রয়েছে। কখনো কখনো পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া মহামারী আকারে ধারণ করে। অসুখ হলে এখানে ডাক্তার পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। একটি মাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও নেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়। খেয়া পার হয়ে ওপারে উঠে আরও কিছুদূর হেঁটে গেলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়। সেখানে গিয়ে কিছু ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া করতে পারলেও অনেকেই লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়।
দুপুর হতে না হতেই মাঝেরচরে ঢুকতে থাকে জোয়ারের পানি। সকালে চরের পশ্চিম প্রান্তে যে মাঠের ধারে ট্রলার ভিড়েছিল, সে জায়গাটি যেন চেনাই যাচ্ছিল না। যে সাঁকোটা পানির অনেক ওপরে ছিল, সেটি ডুবে গেছে। যে বাড়ি-ঘরগুলোর সামনে ছিল খোলা মাঠ, সে বাড়িগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় বাড়িগুলো পানিতে ভাসছে।
ফিরতি ট্রলার ঘাটে ভেড়ে। কিছু মানুষ এখান থেকে কাজের প্রয়োজনে ছোটেন শরণখোলাসহ বিভিন্ন এলাকায়।
এভাবেই এগিয়ে চলে মাঝেরচরের দ্বীপ জীবন। সমস্যা-সংকটের ভেতর দিয়ে দিন কাটে চরের দু’শতাধিক পরিবারের হাজার দেড়েক মানুষের। তাদের নি:শব্দ আহাজারি যেন চরের বৃত্ত অতিক্রম করতে পারে না কিছুতেই।
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ- উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]
বাংলাদেশ সময়: ১০০৪ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০১৪