বেনাপোল থেকে ফিরে: কেউ যদি যশোরের বেনাপোলে যান তাহলে অবধারিতভাবেই শুনবেন পুটখালির নাম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেনাপোলের চেয়ে পুটখালির নাম বেশি আলোচিত।
কি আছে এই গ্রামে! বেনাপোল স্থল বন্দর সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন বললেন, আগে একটু ঘুরে আসেন। তারপর আমরা কিছু বলবো না, আপনিই শুধু বলবেন, আর আমরা শুনবো।
এত রহস্য কেন। একটু তো দেখতেই হয়। তাই সাত সকালেই আমরা দু’জন রওয়ানা দিলাম ব্যাটারি চালিত ইজি বাইকে চড়ে। বেনাপোল বন্দর ছেড়ে পুটখালির রাস্তায় উঠতে বিজিবি’র একটি অস্থায়ী চেকপোস্ট চোখে পড়লো। পথে অসংখ্য মোটর সাইকেল দেখলাম। প্রতিটি মোটরসাইকেলেই তিন চারজন করে যাত্রী। এই গ্রামে যেতে এটিই সবচেয়ে ভালো যান। পুটখালির কাছাকাছি আসতেই বিজিবির একটি স্থায়ী চেকপোস্ট। আমাদের ইজি বাইকে কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই চলে এলো। দু’পাশ দিয়ে সারি সারি গরু যাচ্ছে বেনাপোলের দিকে। ইজি বাইকের চালক আবু সাঈদের কাছে জানতে চাইলাম এত গরু আসছে কোথা থেকে। সাঈদ বললেন, আগে গ্রামের ভেতরে চলেন, তারপর নিজেই টের পাবেন।
পৌছে গেলাম পুটখালি বাজারে। বাজারের পাশ দিয়ে বিশাল গরুর হাট। কয়েকশ গরু এই হাটে। আসলে এটি হাট নয়। বিষয়টি স্পষ্ট করলেন, মোশারফ আলী। মোশারফ জানালেন, গরুগুলো আসে ভারত থেকে। এসব গরু ট্রাকে উঠিয়ে দেওয়ার কাজ করেন তিনি। গরু দিয়ে একটি ট্রাক ভর্তি করলে তার আয় হয় ৫০ টাকা। এভাবে দিনে তার হাজার খানেক টাকা আয়।
এই দূর গ্রামে মাসে তার আয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। এ কারণে শুধু মোশারফই নন, তার অন্য তিন ভাই ইমান আলী, রহমত আলী ও হোসেন আলীও ট্রাকে গরু তোলার কাজ করেন।
গরুর হাট ছেড়ে গ্রামের আরো ভেতরের দিকে রওনা হলাম আমরা। এখানে বিজিবি’র ক্যাম্প রয়েছে। ক্যাম্প ছেড়ে এগিয়ে যেতেই ১০/১১টি গরু নিয়ে ভেজা শরীরে একজন বয়স্ক লোককে এগিয়ে আসছেন। কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম জবাব দিলেন, আইয়ুবুর রহমান। ভারত থেকে গরু আনা-নেওয়াই তার পেশা। ২৫ বছর ধরে তিনি এই কাজ করেন। একটু আগে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পৃথক করা ইছামতি নদী পেরিয়ে নিয়ে এলেন এসব গরু।

ভারত সীমান্তবর্তী সবুজে ঘেরা গ্রাম পুটখালি। এই গ্রামের গাঁ ঘেষেই প্রবাহিত হচ্ছে ইছামতি নদী। নদীর অর্ধেক পর্যন্ত বাংলাদেশের সীমানা। কোনো বাধা ছাড়াই কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে আমরা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ইছামতির নদীর প্রান্তে পৌছে গেলাম। ছবি তুললাম। দেখলাম নদীর তীরে একটি নৌকা পানিতে ডুবিয়ে রাখা। যখন প্রয়োজন হয় পানি ফেলে এই নৌকা দিয়ে আনা-নেওয়া হয় চোরাই পণ্য।
একটু দূরে বিজিবি’র দুই সৈনিক। দেখে আমাদের পরিচয় জানতে চাইলেন। তারা বললেন, সীমান্তবর্তী এই এলাকায় কিভাবে এলেন। আপনাদের কোনো চেকপোস্টে বিজিবি বাধা দেয়নি। বিজিবি’র এই দুই সৈনিককে ঘিরে বেশ কয়েকজন যুবক আড্ডা জমিয়েছেন। তাদেরই একজনের কাছে জানতে চাইলাম আপনাদের বাড়ি কোথায়। তারা বললেন, উত্তর পুটখালি। এখানে কি করছেন। উত্তরে জানালেন, আড্ডা দিচ্ছেন। দিনে দুপুরে সীমান্তে একটি চেকপোস্টে যুবকদের আড্ডা!
এই যুবকদের মতো গ্রামের বেশিরভাগ যুবক বিজিবি সদস্যদের সঙ্গে সখ্য করেই ভারত থেকে গরুসহ চোরাই পণ্য আনা নেওয়ার কাজ করে থাকেন।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের এই অংশে নেই কোনো কাঁটাতারের বেড়া। পুটখালী গ্রাম আর ভারতের মধ্যে ব্যবধান বলতে ইছামতি নদীই। তবে নদী তো আর ধাতুর তৈরি কাঁটাতারের বেড়া নয়। নদী তার উদার বুকে ঠাই দেয় সবাইকে। এমনকি চোরাকারবারিকেও। আর তাই তো আয়ুবুর রহমানের মতো এই গ্রামের অনেকেই সহজেই নদী পার হয়ে নিয়ে। আসেন অসংখ্য গরু।
ইছামতির এমন ‘সরলতা’র সুযোগ নিয়ে অবৈধ পণ্য পাচারের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে স্থানটি। তাই শান্ত ইছামতি নদীই এখন অশান্ত করে তুলেছে সীমান্তের এই গ্রামের যুবকদের। এই নদীপথ দিয়েই প্রতিদিন কোটি টাকার বিভিন্ন ভারতীয় পণ্য অবৈধভাবে ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশে।
একেবারে সীমান্তর্তী গ্রাম হলেও পুটখালীর প্রতিটি বাড়ি ২/৩ তলা বিল্ডিং। বিদ্যুৎ ও অন্যান্য আধুনিক সুবিধাও রয়েছে গ্রামটিতে। এরকম ঝকঝকে একটি গ্রামের রহস্যও এতক্ষণে বুঝতে পারলাম। এই সুদূর গ্রামে বসে ট্রাকে গরু উঠিয়ে দিয়েই যদি কেউ ৩০ হাজার টাকা আয় করতে পারেন তাহলে তো বোঝাই যায়। ভারত থেকে গরু আনতে পারলে আয় হয় আরো বেশি।
চোরাই পণ্য পারাপার করেই জীবিকা নির্বাহ করেন এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ। পরিবারের ইচ্ছেতেই পড়াশোনা না করে এই গ্রামের যুবক ও কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে চোরাই পণ্য পারাপারের কাজে।
দিনের বেলায় আয়ুবুর রহমানের মতো দু’একজনকে দেখলেও সন্ধ্যা নামতেই পণ্য আনা-নেওয়ার ধুম লেগে যায়। গ্রামের যুবক-কিশোররা বাবা-দাদার পেশায় ফিরে পায় কাজের আনন্দ।
পুটখালী গ্রামের আল-আমিন নামের এক যুবক বললেন, আমার বাবা-দাদার পেশা এটা। সবচেয়ে বড় কথা কষ্ট করে খাই, চুরি তো করি না।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪২ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৪