সোয়া ৪টায় যখন জাতীয় প্রেসকাবে ঢুকছিলাম তখন এক সহকর্মী জানতে চাইলেন, আজ প্রেসকাবের নিজস্ব কোনো প্রোগ্রাম কিনা : ‘নবীন-প্রবীণ সব সাংবাদিক, সম্পাদক ও সাংবাদিক নেতারা দল বেঁধে কেন আসছেন?’
মজা করে বললাম, ‘হয়তো কোনো অ্যাসাইমেন্ট করতে !’
হ্যাঁ, ২৮ ফেব্রুয়ারি সোমবার বিকেলে ইন্ডিপেনডেন্ট সম্পাদক মাহবুবুল আলম, প্রবীণ সাংবাদিক আতাউস সামাদ ও গিয়াস কামাল চৌধুরী, নিউজ টুডে সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, প্রেসকাবেব সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ, সাংবাদিকনেতা আলতাফ মাহমুদ, প্রেসকাবের সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদসহ আরো অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিক প্রেসকাবে আসেন।
দেশের বিশিষ্ট এই সাংবাদিকরা এসেছিলেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতার দিকপাল, বরেণ্য সাংবাদিক এবিএম মূসার (মূসা ভাই) জন্মদিন উদযাপন করতে।
সোমবার জাতীয় প্রেস কাবের আজীবন সদস্য বর্ষীয়ান সাংবাদিক এবিএম মূসার ৮০তম জন্মদিন। এ উপলে প্রেস কাবের উদ্যোগে এ কৃতী সাংবাদিকের জন্মদিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা তাদের প্রিয় এই অগ্রজকে নিয়ে কত কথাই না বললেন। শুরুতেই কেক কাটতে গিয়ে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বললেন, ‘মূসা ভাইকে সবুজ চেরি খাইয়ে দিয়ে গ্রিন করে দিলাম। ’
এ পর্যায়ে দেশবরেণ্য সাংবাদিক ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তিনি কেক কাটেন। সঙ্গে ছিলেন তার জীবনসঙ্গী সিতারা মূসা। ছিলেন এক শ্যালক ও আদরের দুই নাতি-নাতনী।
পরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় বিশিষ্ট এই সাংবাদিককে। প্রেসকাব, কর্মজীবী নারী, যুগান্তর পরিবারের পক্ষে ফুলের মালা পরিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
কীর্তিমান এই গুণী নিজের হাতে ফুলের মালা পরিয়ে দেন স্ত্রী সিতারা মূসাকে। এ সময় দুজনের ভালোবাসার প্রাবল্য সবার নজর কাড়ে। সবাই আমোদিতও হন বেশ। একটু কৌতুক করে সাংবাদিক আতাউস সামাদ বলেই ফেললেন, ‘মূসা ভাই, এই বয়সেও মালাবদল!’
কাকতালীয়ভাবে সোমবার ছিলো সিতারা মূসারও জন্ম দিন।
প্রেসকাবেব পক্ষে এ বি এম মূসাকে বিভিন্ন উপহার সামগ্রী তুলে দেওয়া হয়। ফটোসাংবাদিক খালেদ হায়দার একটি ছবি উপহার দেন তাকে।
এবিএম মূসার জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মাহবুবুল আলম বলেন, ‘৮০ বছরে নতুন জীবন শুরু হয়। মূসা ভাইয়েরও আজ নতুন জীবন শুরু হবে। তিনি আমাদের জন্য আদর্শ। সাংবাদিকদের চলার পথের সারথী,পথপ্রদর্শক। বয়সে তার খুব কাছাকাছি হলেও প্রাপ্তিতে অনেক পিছিয়ে আছি। মূসা ভাই ব্যক্তি হিসেবেও সবার শ্রদ্ধেয়। ’
আতাউস সামাদ বলেন, ‘মূসা ভাই আমাদের জন্য অনেক করেছেন। তার কর্মজীবনের ব্যাপ্তিও অনেক। পাকিস্তান আমল থেকে তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে গেছেন। ’
তিনি আরো বলেন, মূসা ভাইয়ের সঙ্গে যারা কাজ করেছেন তারা ভেতর থেকে দেখেছেন, সরকারি নিষেধাজ্ঞার দেয়াল ডিঙিয়ে কীভাবে সাধারণ মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছে দিতে হয়।
‘বিশ্ববিদ্যালয়-জীবন থেকে মূসা ভাইয়ের স্নেহ পেয়েছি। তিনি আমাদের অভিভাবক। সাংবাদিকতা-জীবনে মূসা ভাই আমার গুরু’ যোগ করলেন আতাউস সামাদ।
রিয়াজউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমি যখন সাংবাদিকতায় আসতে চাই, মূসা ভাই বললেন ‘কেন?’ পরে বিকেলে দেখি অন্য এক চরিত্র। আমার খাপছাড়া একটি প্রতিবেদন পাঁচ মিনিটে সাজিয়ে ছেপে দিলেন তিনি। ’
শওকত মাহমুদ বলেন, ‘মূসা ভাইর ৮০তম জন্ম দিন। কিন্তু ভাবীর কততম? দুজনই শতায়ু হোন। ’
প্রেসকাবের সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ বলেন, ‘মূসা ভাইয়ের সঙ্গে প্রেসকাবের নাড়ির সম্পর্ক। ’
প্রেসকাবের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ বলেন, মূসা ভাই দেশের দিকপাল সাংবাদিক। আজও তার লেখায় আগুন ঝড়ে। প্রেস কাবের পক্ষে তার ও ভাবীর জন্ম দিনের আয়োজন করতে পেরে আমরা আনন্দিত।
যাকে ঘিরে এতো আয়োজন, আবেগঘন এ অনুষ্ঠানের শেষ বক্তাও তিনি, সবার প্রিয় মূসা ভাই।
শুরুতেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন দৃঢ় চরিত্রের এই প্রবীণ সাংবাদিক। কণ্ঠও তার ভারী হয়ে আসে: ‘শান্তি পাব মরলেও। আজ অনুজদের শ্রদ্ধা পেয়েছি। এখন আর মরতে বাধা নেই। জীবনে অনেক পেয়েছি। হারিয়েছিও অনেক। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিটা হলো আজ। আজকের পাওয়াটা অনেক বড়। সাংবাদিকতায় পূর্ণতা। ’
অনুজদের জন্য রাখলেন বিশেষ পরামর্শও। বললেন, ‘তোমরা বিভেদ ভুলে যাও। রেষারেষি ভুলে যাও। এক হয়ে যাও। সাংবাদিকতার জন্য, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। ভালো লাগে না, অমুক দল, তমুক দলের সাংবাদিক শুনতে। রাজনৈতিক বিশ্বাস সাংবাদিকতায় নয়। ’
উল্লেখ্য, এবিএম মূসা দীর্ঘ প্রায় ৬০ বছর ধরে সাংবাদিকতার বিভিন্ন েেত্র অবদান রেখেছেন। ১৯৫০ সালে দৈনিক ইনসাফ থেকে তার সাংবাদিকতার জীবন শুরু হয়। ওই বছর তিনি ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভারে যোগ দেন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান অবজারভারে রিপোর্টার, স্পোর্টস রিপোর্টার, বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তার অবস্থান ছিল পাক সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে।
তিনি ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় বিবিসি, সানডে টাইমস-এ সংবাদদাতা হিসেবে রণাঙ্গন থেকে সংবাদ পাঠাতেন। স্বাধীনতার পর তিনি বিটিভির মহাব্যবস্থাপক ও মর্নিং নিউজের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৮১ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ছিলেন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার মহাব্যবস্থাপক ও প্রধান সম্পাদক ছিলেন। ২০০৪ সালে কিছুদিন দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
এবিএম মূসা জাতীয় প্রেসকাবের চারবার সভাপতি এবং তিনবার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
জনপ্রিয় কলাম লেখক এবিএম মূসা একজন সংবাদ বিশ্লেষক হিসেবে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৪ ঘণ্টা, ফ্রেব্রুয়ারি ২৮, ২০১১