ঢাকা, শুক্রবার, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৬ মে ২০২৫, ১৮ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

অভাবে পালালেন সাপখামারি তোতা মিয়ার স্ত্রী!

মাহাবুর আলম সোহাগ, রোভিং করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:১৪, আগস্ট ৯, ২০১৪
অভাবে পালালেন সাপখামারি তোতা মিয়ার স্ত্রী! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঠাকুরগাঁও থেকে: এক সময় যাকে দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন এসে বাড়িতে ভিড় করেছিলেন; যাকে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন সময় তার বাড়িতে লোকজন বিভিন্ন প্রস্তাব দিতেন; কিন্তু দেশের স্বার্থে দেশত্যাগ করতে রাজি হননি তিনি।

অথচ এখন সেই তিনি নেই।

অভাবের কারণে তার স্ত্রীসহ দুই সন্তান বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।

এতক্ষণ যেই মানুষটির বর্ণনা দেওয়া হচ্ছিল, তিনি দেশের একমাত্র সাপখামারি তোতা মিয়া। বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার চৌরঙ্গী বাজারে।

তোতা মিয়া তার বাড়িতে প্রায় পাঁচ হাজার গোখরা সাপ নিয়ে একটি খামার গড়ে তুলেছেন। তার এই খামারের কথা প্রথম অবস্থায় লোকমুখে ছড়িয়ে পড়লে দেশের বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তা প্রচার করা হয়। তখন সারাদেশে তিনিই একমাত্র সাপের খামারি ছিলেন।

তোতা মিয়া বাইরে থেকে সাপ ধরে নিয়ে এসে তার বাড়িতে বাচ্চা প্রসব করাতেন। সেই সঙ্গে তিনি সাপের বিষও সংগ্রহ করতেন।

গণমাধ্যমে তার এ সব খবর প্রচারের পর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন ছুটে আসতেন তার বাড়িতে সাপের খামার দেখতে। তখন সারাদেশে পরিচিত একটি নাম তোতা মিয়া। দূর-দূরান্ত থেকে আসা লোকজন তার সাপের খামার দেখে বকশিস হিসেবে আর্থিক সহযোগিতা করতেন।

তাদের সেই টাকা দিয়ে তোতা মিয়ার সংসার স্বচ্ছলতার সঙ্গেই চলতে শুরু করে।

এক সময় তার এই সাপের খামারের খবর দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে যায় বিদেশেও। খবর পেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিছু লোক আসেন তার বাড়িতে সাপের বিষ কেনার জন্য। সেই সঙ্গে তাকে প্রস্তাব দেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তাদের প্রস্তাবে রাজি না হয়ে নিজ দেশেই সাপের খামারটি বড় করার স্বপ্ন দেখেন তোতা মিয়া।

এরপর ২০০৭ সালে নিজ বাড়িতে তার গলায় সব সময় পেঁচিয়ে রাখা সাপটির দংশনেই মৃত্যু হয় তোতা মিয়ার।

এরপর দিশেহারা হয়ে পড়ে তোতা মিয়ার পরিবার। এদিকে, খামারের শতাধিক সাপ খাবারের অভাবে তার মৃত্যুর এক সপ্তাহের মধ্যেই মারা যায়।

তোতার মিয়ার স্ত্রী নূর জাহানের সাপ নিয়ে কোনো প্রশিক্ষণ না থাকায় সাপগুলোকে দেখাশুনা করতে তিনি ভয় পেলে এ অবস্থা হয়।

এদিকে, তোতা মিয়ার মৃত্যুর পর খাবারের অভাবে সাপ মারা যাচ্ছে এ রকম খবর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হলে বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ, এলাকাবাসীসহ সারাদেশের মানুষের মধ্যে বিষয়টি আলোড়ন সৃষ্টি করে।

এ সব সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় তোতা মিয়ার মৃত্যুর পর কিছু সাপ চিড়িয়াখানায় স্থানান্তর ও অবশিষ্ট সাপ হত্যা করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

এ সময় সরকার তার খামারের কিছু সাপ সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়। বিশেষজ্ঞরা সরকারের সাপ সংরক্ষণের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে, বাকি সাপগুলোকে উপযুক্ত পরিবেশে সংক্ষণের আহ্বান জানান।

ওই সময় বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে অনেক প্রজাতির সাপ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, এ সাপগুলোকে সংরক্ষণ করা হলে এগুলো প্রাকৃতির সম্পদ হবে। পাশাপাশি এ ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদকে ধ্বংস না করে তারা সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ করা প্রয়োজন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।

তখন পরিবেশ বিশেষজ্ঞেরা জানান, বন্যপ্রাণীর খামার তৈরির অনুমোদন দেওয়া হলে বন্যপ্রাণী ধ্বংস হতে পারে। তারা বন্যপ্রাণীর খাবার স্থাপনের অনুমোদন না দেওয়ারও আহ্বান জানান।

অন্যদিকে, তোতা মিয়ার মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর তার বড় ছেলে জসিম পানিতে ডুবে মারা যায়। এতে আরো হতাশ হয়ে পড়েন তোতা মিয়ার স্ত্রী। বর্তমানে তার এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।

এখন তোতা মিয়া আর নেই। নেই তার সাপের খামার। নেই তার পরিবার। আছে শুধু তার ভিটে বাড়িটি।

তোতা মিয়ার মৃত্যুর পর তার পরিবারে অভাব-অনটন দেখা দেয়। ২০০৭ সাল থেকে কোনোমতে সংসারের হাল ধরে থাকলেও শেষ পর্যন্ত আর পেরে ওঠেননি তার স্ত্রী নুর জাহান।

গত তিন মাস আগে তোতা মিয়ার স্ত্রী তার দুই সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন অজানার উদ্দেশে।

সম্প্রতি, তোতা মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির দরজায় তালা ঝুলছে।

এ সময় তোতা মিয়ার প্রতিবেশী জুলেখা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, অভাবের কারণে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন তোতা মিয়ার স্ত্রী। তিনি কোথায় আছেন, তা আমরা কেউ-ই জানিনা। এখন শুধু তার ভিটে-বাড়িটা পড়ে আছে।

তিনি বলেন, তোতা মিয়া মারা যাওয়ার কয়েকদিন পরেই সন্তানদের নিয়ে খুব অভাবে যান তার স্ত্রী। খেয়ে না খেয়ে বেশ কিছুদিন সংসার চালালেও কেউ তাকে সহযোগিতা করতে আসেনি। অভাবের কারণে কিছুদিন ভিক্ষাও করেছেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, সরকার ইচ্ছে করলেই তার স্ত্রী-সন্তানদের একটা ভালো ব্যবস্থা করে দিতে পারতো!

বাংলাদেশ সময়: ১৯০০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।