এক সময় যখন এ দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ পর্যাপ্ত ছিলো না, তখন গরমের দিনে শীতল পাটির জুড়ি মেলা ভার ছিলো। বর্তমানে সবখানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও সুবিধার কারণে বিছানায় শীতল পাটি বিছানোর সংস্কৃতি তেমন একটা চোখেই পড়ে না।
মৌলভীবাজারে রাজনগর থানার তোলপুর গ্রামের বাসিন্দা কারুশিল্পী গিতেশের সঙ্গে আলাপকালে এমনটাই জানা যায়। নারায়ণঞ্জের সোনারগাঁওয়ে গত ১৪ জানুয়ারি মাসব্যাপী শুরু হয়েছে লোককারু শিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব-২০১৭। যা চলবে ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
সম্প্রতি এ মেলায় ঘুরতে এসে গিতেশ চন্দ্র দাসের সঙ্গে কথা বলে কারুশিল্পীদের দুর্দিন ও শীতল পাটির কারিগরদের দুর্দশার কথা জানা যায়। গিতেশের অধীনে কাজ করেন হরেন্দ্র দাস, অজিত দাস, জগদীশ দাস ও বিধয় দাস। তাদের জীবনেও এখন নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা।
মেলা উপলক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে গিতেশ ও হরেন্দ্রকে ডেকে এনে একমাসের জন্য ভ্রাম্যমাণ দোকানে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে বেচা-বিক্রি করে যা পাবেন সেটা, আর সরকার দেবে ৩০ হাজার টাকা। বছরে মোটা অঙ্কের আয় বলতে এটাই। আর সারাবছর তেমন পাটি বিক্রি হয় না।
ফুল, ফল, বাঘ-হরিণ, শাপলা, শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধসহ নিপুণ হাতে অনিন্দ্য শৈল্পিক বাহারি নকশায় সজ্জিত বেতের তৈরি শীতল পাটি কিনতে মানুষের আগ্রহ কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে গিতেশ ও হরেন্দ্র বাংলানিউজকে বলেন, ‘এখন মানুষ শুধু সস্তা খুঁজে। সস্তা দামের জিনিসপত্রে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নেয়। তাই আমাদের পাটির কদর নাই। ’
তাদের দোকানে টাঙানো ৭ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৫ ফুট প্রস্থের নান্দনিক শীতল পাটির দাম ১০ হাজার টাকা। যা একজন কারিগরের তৈরি করতে সময় লাগে ২০-২২ দিন।
অপর একটি ৫ হাত লম্বা, ৪ হাত চওড়া পাটির দাম পড়বে ১৬ হাজার টাকা। যা তৈরি করতে দুইজন কারিগরের সময় লেগেছে ১৫ দিনের বেশি।
গিতেশের বয়স বর্তমানে ৬৮ বছর। কিশোর গিতেশের বয়স যখন ১৩ বছর, তখন থেকেই শীতল পাটি বুননের কাজ শুরু তার। গত ৫৫ বছর থেকে শীতল পাটি গেঁথেই চলছে তার জীবন-জীবিকা।
কী পেলেন এতগুলো বছরে? এমন প্রশ্নের জবাবে গিতেশ জানান, দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে কালাচান দাস গ্রাজুয়েশন শেষে সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে জয়েন করেছেন। জীবনে আর কী আছে পাওয়ার বাবা!
ছেলের সরকারি চাকরির সুবাদে হয়তো গিতেশের আর পাটি না গাঁথলেও চলবে। তবে সহকর্মীদের করুণ দশা আর কারুশিল্পের সংকুচিত ভবিষ্যত দেখে ভীষণ ব্যথিত তিনি। এ শিল্পের এমন ভগ্নদশায় তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এ পেশায় আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
তবে কী হারিয়ে যেতে বসেছে শত-শত বছরের ঐতিহ্যবাহী শীতল পাটি তৈরির সমৃদ্ধ কারুশিল্প? অবশ্য তেমন আশঙ্কায় অনেক কষ্ট ও ভালোবাসায় মাখা নেশা-পেশা ও জীবন-জীবিকার শীতল পাটির এ শিল্পকে বাঁচাতে গিতেশ ও হরেন্দ্রের চোখে-মুখে কেবলই সরকারি সহযোগিতার আকুল আবেদন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৭
টিআই/এমজেএফ