বয়সে ছোট হলে কী হবে, কাজে কোনোমতেই হারার পাত্র নয় সোহেল! অভাবে পড়ে অল্প বয়সেই ঝুঁকিপূর্ণ এ-কাজে নেমেছে সে। গত দেড় বছর ধরে এ-কাজ করছে সোহেল।
তবে শুধু সোহেলই নয়, তার মত আরও কয়েকশ শিশু রাজধানী ঢাকাতে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িত। পরিবারের চাপে ও পেটের দায়ে তারা প্রতিনিয়তই এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করে যাচ্ছে। এই কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় দুর্ঘটনারও শিকার হচ্ছে এই কোমলমতি শিশুরা।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, লেগুনা বা থ্রি-হুইলার নামে পরিচিত এই গাড়িটিতে যারা সহকারী (হেলপার) হিসেবে কাজ করছে তাদের বেশিরভাগই ১০ থেকে ১২ বছরের শিশু। লেগুনা গাড়িতে সর্বমোট আসন থাকে ১৪টি। রাজধানীতে গাড়ির তুলনায় যাত্রীসংখ্যা বেশি হওয়ায় লেগুনার সিটেই শুধু না, হেলপারের দাঁড়ানোর জায়গাটিতেও ৩-৪ জন যাত্রী দাঁড়িয়ে যাতায়াত করে। এর ফলে গাড়িতে থাকা শিশু-হেলপারটিকে খুব কষ্ট করে কখনো ওপরে বা গাড়িতে লাগানো লোহার সিঁড়িটিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়ে। অনেক সময় চলন্ত অবস্থাও তাদেরকে যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নিতে হয়। আর এ সব কারণে ঢাকার মত একটি যানজটপূর্ণ শহরে তারা অনেক সময় মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হয়।
লেগুনা গাড়ির এই শিশু-হেলপারদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় নিজেদের ইচ্ছা না থাকার পরও পরিবারের ইচ্ছায় তাদের এ-কাজ করতে হয়।
মোহাম্মদপুর থেকে বাড্ডা লিংক রোডে যাতায়াতকারী গ্রিন মোটরস পরিবহনের একটি লেগুনায় গত ৩ বছর ধরে কাজ করছে দশ বছর বয়সের মুজিবর।
এ-কাজে আসার কারণ জানতে চাইলে মুজিবর বাংলানিউজকে বলে, ‘‘আমার আব্বা কইছে ডেলি তিনশ টাকা দিতে অইব। নাইলে ঘরে জাগা দিব না। আর আমি এই কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ পারি না। তাই লিগা আমি এই কাজ করি। ’’
প্রতিদিন কত টাকা এই কাজ করে সে পায় জানতে চাইলে মুজিবর বলে, ‘‘আমরা ছোট দেইখা আমাগো কম টাকা দেয়। কোনো দিন ৪০০ টাকা আবার কোনো দিন ৩০০ টাকা পাই। যা পাই তা সব আব্বার হাতে দিয়া দেই। ’’
শিশুদের দিয়ে এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানোর বিষয়টি নিয়ে শিশুদের-নিয়ে-কাজ-করে-এমন কয়কটি সংগঠনে সঙ্গে কথা বলি। তারা জানায়, শিশুদের অল্প বয়সে কাজ করালে তারা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে যেমন বঞ্চিত হয়, তেম্নি তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এই সংগঠনগুলোর মধ্যে আবার অনেকেই বলছে এই কাজের কারণে অনেক শিশু মাদকাসক্তও হচ্ছে।
পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে ‘সম্ভাবনা’ নামের একটি সংগঠন। এ-বিষয়ে এই সংগঠনের অন্যতম সদস্য মুসফিকা নিশাত বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘লেগুনার সহকারীর কাজটি শিশুদের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলোর একটি। সঠিক প্রশিক্ষণ ও শারীরিকভাবে দক্ষ না হওয়ার কারণে শিশুরা এ কাজটি করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। ফলে তারা অল্প বয়সে নানা রকম শারীরিক সমস্যায় পড়ছে। তাছাড়া ১০-১২ বছরের এই শিশুরা প্রতিদিন ১০-১২ ঘণ্টা করে কাজ করার কারণে মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ’’
বাংলাদেশের শিশুশ্রম আইনে বলা আছে, ‘‘কোনো শিশুশ্রমিককে ৪-৫ ঘণ্টার বেশি কাজে লাগানো যাবে না। এক্ষেত্রে ১৪ বছররে কম বয়সের শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করা যাবে না। ’’
এদিকে শিশুশ্রম নিরসনে ২০১০ সালের নীতিমালায় বলা হয়েছে, সরকার ৩৮টি কাজকে শিশুশ্রমিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে বাস ও টেম্পোতে শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করা যাবে না বলেও উল্লেখ আছে। এছাড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, ঝুঁকিপূর্ণ ও নিকৃষ্ট ধরনের শিশুশ্রমসহ সকল প্রকার শ্রম থেকে শিশুদের প্রত্যাহার করতে হবে।
তবে আইন ও নীতিমালা করা হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সারাদেশে ১৪ বছরের নিচে ৭৪ লাখের বেশি শিশু বিভিন্ন ধরনের শ্রমে নিয়োজিত।
এ বিষয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, ‘‘শিশুদের দিয়ে যেন কেউ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ না করাতে পারে সে বিষয়ে আমরা বরাবরই কাজ করে যাচ্ছি। যারা শিশুদের দিয়ে কাজ করায় তাদের বিরুদ্ধে আমরা বরাবরই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, তাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের সম্মুখীন করা হচ্ছে। তবে এই শিশুশ্রম বন্ধ করতে শুধু সরকারের একার প্রচেষ্টা যথেষ্ট হবে না। এক্ষেত্রে অভিভাবক ও মালিকপক্ষকেও এগিয়ে আসতে হবে। ’’
তিনি বলেন, ‘‘সুবিধাবঞ্চিত ও যে শিশুদের দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ কাজ করানো হয়ে তাদের পুনর্বাসনের জন্য আমরার নানান উদ্যোগ গ্রহণ করছি। তাদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে ফিরিয়ে এনে লেখাপড়ার ব্যবস্থাও গ্রহণ করছি। এতো এতো মানুষের দেশ। তাই খুব দ্রুতই সব সমস্যার সমাধান হবে না। তবে সবার মিলিত চেষ্টায় একদিন বাংলাদেশে শিশুশ্রম বন্ধ হয়ে যাবে। ’’
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৭
এমএ/জেএম