সাধারণ মানুষ সেদিন কাজ থেকে আগেভাবে ঘরে ফিরবেন। উড়োজাহাজগুলোতে পাইলটেরা যাত্রীদের উদ্দেশ্যে তাদের ঘোষণায় রানির মৃত্যুখবর বলবেন।
এমন আরও শত শত বিষয় ঘটবে নবতিপর রানির মৃত্যু পরবর্তিতে। যার একটি নীলনকশা তৈরি করা হয়েছে। বাকিংহাম প্যালেস তার প্রস্তুতিমূলক মহড়াও সম্পন্ন করে নিচ্ছে।
রানির শারীরিক অবস্থা ভালোই আছে, তবে এটাই যে রাজপ্রাসাদের রীতি। সুতরাং এখনই ঠিক হয়ে গেছে রানির মৃত্যুর পর সে খবরটি প্রধানমন্ত্রীকে প্রথম জানাবেন রানির ব্যক্তিগত সচিব সাবেক কূটনীতিক স্যার ক্রিস্টোফার গিট। এবার আর খবরটি প্রথম প্রচার করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না বিবিসিকে। দীর্ঘ মনোপলি ভেঙ্গে খবরটি প্রথম নিউজ ফ্লাশ হিসেবে যাবে প্রেস অ্যাসোসিয়েশনে।
একটু পেছনের তথ্য জানিয়ে রাখা যাক। রাজা পঞ্চম জর্জ যখন মুত্যু পথযাত্রী তখন জাতির সামনে সে কথা ঘোষণা করেছিলেন চিকিৎসক লর্ড ডসন। সময়টি ছিলো ১৯৩৬ সালের ২০ জানুয়ারির রাত সাড়ে ৯টা। সে রাতে ডসন জানালেন রাজার জীবন অতি ধীরে শান্তিময় অন্তের দিকে যাচ্ছে। এর কিছুক্ষণ পরে ৭৫০ মিলিগ্রাম মরফিন আর পুরো এক গ্রাম কোকেইন মিশিয়ে রাজার শরীরে ইনজেক্ট করে দিলেন তিনি। মৃত্যু নিশ্চিতে যতটুকু প্রয়োজন তার দুই গুন বেশিই চেতনানাশক রাজার শরীরের দিলেন এই চিকিৎসক। যাতে কষ্টের সকল অনুভূতি ভুলে তিনি তলিয়ে যেতে পারেন মৃত্যুর গভীরে। আরও একটি হিসেব সে রাতে ছিলো। মধ্যরাতে দ্য টাইমস প্রেসে ওঠার আগেই যেনো মৃত্যুর খবরটি তৈরি হয়ে যায়।
রাজায় আর প্রজায় যে বন্ধন তা বড়ই অদ্ভুত, বড়ই অজানা। কিন্তু এই মৃত্যুর দিনগুলোতে যেনো গোটা বৃটেনের আত্মা, এর মানবের আত্মায় রূপ নেয়, সবার জন্যই হয়ে ওঠে এক দুঃখময় দিন।
এবারেও হয়তো তেমনটাই হবে। রানি এলিজাবেথেরে শারীরিক অবস্থা এখনো বেশ ভালো। এইতো সেদিন তার ৯০তম জন্মবার্ষিকী বেশ জাঁকজমকে উদযাপন করা হলো। কিন্তু বাকিংহাম প্যালেস তার মৃত্যুর প্রস্তুতিও নিচ্ছে ধীরে ধীরে। আর সে কারণেই মৃত্যুর পর কি কি হবে তার নীল-নকশা চূড়ান্ত করে তার কিছু কিছু মহড়াও করে নিচ্ছে।
দ্য গার্ডিয়ান এ নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে বাকিংহাম প্যালেসে এখন এমন কয়েকটি গোপন নীল-নকশা রয়েছে। ব্রিটেন যখন সেই একই বিয়োগান্তক ঘটনার মুখোমুখি হবে তখন সেই নকশামতেই চলবে সবকিছু।
২০০২ সালের ইস্টার সানডের বিকেলে রানিমাতা যখন চলে গেলেন, উইন্ডসরের রয়্যাল লজে সেদিন তিনি খানিকটা সময় পেয়েছিলেন বন্ধুদের টেলিফোন করে করে বিদায় চেয়ে নিতে, আর কিছু ঘোড়া মুক্ত করে দেওয়ারও সুযোগ তার হয়েছিলো। কিন্তু এবারের সময়টি যখন আসবে তখন রানির শয্যাপাশে থাকবেন একজন গ্যাস্ট্রোয়েন্টেরোলোজিস্ট। নাম তার অধ্যাপক হুও থমাস। তারই দায়িত্ব থাকবে চিকিৎসার জন্য। সে সময়ে রানির কক্ষে কার যাওয়ার সুযোগ থাকবে, কার থাকবে না, সে বিষয়গুলোও নিয়ন্ত্রণ করবেন তিনি। আর কতটুকু তথ্য জনসমক্ষে দেওয়া যাবে, কতটুকু যাবে না সে সিদ্ধান্তও থাকবে তার। এরপর যখন রানি তার চক্ষু মুদিবেন, চার্লস হয়ে যাবেন রাজা।
খবরটি জানানোর দায়িত্বে যিনি থাকবেন তিনি স্যার ক্রিস্টোফার গিট। রানির ব্যক্তিগত সচিব ও সাবেক কূটনীতিক। তিনিই যোগাযোগ করবেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে।
এর আগে সবশেষ ব্রিটিশ কোনও রাজার মৃত্যু হয় ৬৫ বছর আগে। সেটি ছিলো রাজা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যু। সেখবর প্রথম বাকিংহাম প্যালেসে আসে ‘হাইড পার্ক কর্নার’ এই কোড শব্দমালায়। যাতে করে সুইচবোর্ড অপারেটর বুঝতেও না পারেন।
দ্বিতীয় এলিজাবেথের জন্য এই কোড থাকবে ‘লন্ডন ব্রিজ ইজ ডাউন’। পররাষ্ট্র দফতরের গ্লোবাল রেসপন্স সেন্টার থেকে সে খবর যাবে যুক্তরাজ্যের বাইরে ১৫টি রাষ্ট্রের সরকার প্রধানদের কাছে। এসব রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান রানি নিজে। এছাড়াও খবর যাবে কমনওয়েলথভূক্ত ৩৬টি রাষ্ট্রের সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে। এই রাষ্ট্রগুলোতেও তিনি কোনও একসময় প্রতিকী প্রধানের দায়িত্বপালন করেছেন।
রানি চলে যাওয়ার পরেও কিছু সময় পার হয়ে যাবে যখন পর্যন্ত সাধারণের কাছে তা অজানা থেকে যাবে। গভর্নর জেনারেল, অ্যাম্বাসেডর ও প্রধানমন্ত্রীরাই তা প্রথম জানবেন।
এরপর তারা নিজেরা যে যার কালো বাজুবন্ধ পরে নেবেন। সোয়া তিন ইঞ্চি করে চওড়া একেকটি বাজুবন্ধ প্রত্যেকে নিজ নিজ বাম বাহুতে পরবেন। এরপর খবরটি প্রথমবারের মতো জনগণের জন্য প্রকাশ করা হবে।
তবে ১৯৫২ সালে রাজা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যুখবর জানতে ঘটনার পর যতটা দেরি হয়েছিলো এবার ততটা হবে না। সেবার রাজা জর্জ সান্ড্রিংহামে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সকাল সাড়ে ৭টায়। আর বিবিসি সে খবর প্রথম প্রচার করে বেলা সোয়া ১১টায়।
তবে এবার রাজকীয় ঘটনায় বিবিসির সেই মনোপলি ভেঙ্গে দেওয়া হচ্ছে। এবার ঘোষণাটি নিউজ ফ্ল্যাশ আকারে প্রথম যাবে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা প্রেস অ্যাসোসিয়েশনে। এরপর সারাবিশ্বের নিউজ মিডিয়া সে খবর পাবে একযোগে। ১৯৩০’র দশক থেকে বিবিসি সকল রাজকীয় মৃত্যুর খবর প্রথম প্রকাশ করে আসছে। এই প্রথম সেটা হচ্ছে না- তবে কেনো তা রহস্যময়।
তবে মিডিয়া যখন খবরটি প্রচার করতে থাকবে ঠিক সেই সময়টিতেই শোকের পোশাক পরে বাকিংহাম প্যালেসের দরজা গলিয়ে নেমে আসবেন একজন। পায়ে হেঁটে তিনে এগিয়ে গিয়ে প্যালেসের মূল ফটকে কালো বর্ডারের একটি নোটিশ বোর্ড লটকে দেবেন। প্যালেসের ওয়েব সাইটেও তখন প্রকাশ করা হবে একই নোটিশ।
বিবিসি’র রেডিও অ্যালার্ট ট্রান্সমিশন সিস্টেম (র্যাটস) দ্রুত চালু হয়ে যাবে। ব্রিটেনের কমার্সিয়াল রেডিও স্টেশনগুলো মানানসই সঙ্গীত বাজাবে, এরপর যত দ্রুত সম্ভব খবরে চলে যাবে। প্রতিটি স্টেশন, এমনকি হাসপাতাল রেডিও পর্যন্ত তাদের নিজ নিজ সঙ্গীত তালিকা তৈরি করে নেবে যা সবই হবে দুখের সঙ্গীত।
টেলিভিশনে খবরের পাঠক-পাঠিকারা কালো পোশাক, কালো টাই পরবেন। সকল অনুষ্ঠানধর্মী কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যাবে। বিবিসি-ওয়ান, টু ও ফোর একযোগে প্রচার করা হবে। রেডিও ফোর ও রেডিও ফাইভ একটি বিশেষ কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচার করবে। তাতে… ‘দিস ইজ বিবিসি ফ্রম লন্ডন’ এই পরিচিতিতে ঘোষণা করা হবে জাতীয় জরুরি অবস্থা। এসময় টেলিভিশন স্ক্রিনে রাজকীয় লোগো ভেসে উঠবে। আর বাজতে শুরু করবে জাতীয় সঙ্গীত।
ব্রিটেনের মানুষ যখন রাজকীয় কোনও মৃত্যুর কথা চিন্তা করেন তখন তাদের মনোজগতে ভেসে ওঠে প্রিন্সেন্স ডায়ানার মৃত্যুর কথা। কিন্তু রানির মৃত্যু হবে অনেক ভিন্ন কিছু। এটা হয়তো স্রেফ আবেগের ভরপুর থাকবে না, তবে এর প্রভাব থাকবে অনেক বেশি নাটকীয়। এটা হবে মৌলিক কিছু।
ব্রিটিশ কোনও রাজা বা রানির মৃত্যু মানেই হচ্ছে নতুন একজন রাজা কিংবা রানির শুরু। সুতরাং এই সময়ের আনুষ্ঠানিকতা একটি জীবন্ত স্মৃতি। সবশেষ চার প্রধানমন্ত্রীরই জন্ম হয়েছে রানি এলিজাবেথ সিংহাসনে আসার পর। যখন তার মৃত্যু হবে দ্রুত ডাকা হবে সংসদের উভয় কক্ষের অধিবেশন। এই দিন সাধারণ মানুষ কাজ থেকে সকাল সকাল ঘরে ফিরে যাবেন। এয়ারক্র্যাফটগুলোর পাইলটেরা রানির মৃত্যুর খবর জানিয়ে দেবেন তাদের যাত্রীদের। এরপর নয় দিন একের পর এক আসতে থাকবে রাজকীয় এলান। নতুন রাজা একটি চারজাতি সফর কর্মসূচিতে যাবেন। আর লন্ডনে সন্নিবেশ ঘটবে বিশ্ব কূটনীতিকদের। ১৯৬৫ সালে উনস্টন চার্চিলের মৃত্যুর পর এমন কূটনীতিক সমাবেশ আর হয়নি।
এসময় দশ দিনের টানা শোক চলবে।
রানি যদি কোনও কারণে বিদেশে মৃত্যুবরণ করেন, রয়্যাল ফ্লাইটের ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি ১৪৬ জেট ওয়েস্ট লন্ডনের নর্টহল্ট থেকে কফিন নিয়ে উড়াল দেবে। আর রানি যদি স্যানড্রিংহামে মারা যান, কয়েক দিন পর তার মরদেহ গাড়িতে করে লন্ডন আনা হবে।
আরও বিস্তারিত পরিকল্পনায়, রানি যদি বালমোরালে মারা যান তখন কি হবে তারও উল্লেখ রয়েছে।
তেমনটা হলে স্কটিশ আচারে কিছু আনুষ্ঠানিকতা আগেই সারতে হবে। সেখানে এডিনবার্গের হোলিরুডহাউজে রানির মরদেহ শায়িত রাখা হবে। এরপর কফিন রয়্যাল মাইল থেকে সেন্ট গাইলস ক্যাথেড্রালে নিযে যাওয়া হবে। পরে ওভারলে স্টেশন থেকে রাজকীয় ট্রেনে করে ইস্টকোস্ট মেইনলাইনের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। রাস্তার দুইদিকে সাধারন মানুষ দাঁড়িয়ে ট্রেনে ফুল ছুঁড়বে। এসময় পেছন থেকে অনুসরণ করবে আরেকটি লোকোমোটিভ ট্রেন। যার কাজ হবে পড়ে থাকা ফুল পরিষ্কার করে যাওয়া।
তবে যেখানেই মৃত্যু ঘটুক। শেষ পর্যন্ত রানির মরদেহ আনা হবে বাকিংহাম প্যালেসেই। একটি বেদি থাকবে, যা ঢাকা থাকবে রাজকীয় আচ্ছাদনে। আর চারজন গ্রেনাডিয়ার গার্ড তাদের ভল্লুকচর্মে তৈরি টুপি পরে রাইফেলগুলো মেঝের দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে থাকবে, আর চারিদিকে কড়া নজর রাখবে।
বাইরে সংবাদকর্মীরা সমবেত হবেন গ্রিন পার্কে আগে থেকেই নির্ধারিত স্থানে।
সারাদেশে পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে, আর গির্জার ঘণ্টাগুলো টানা বাজতে থাকবে। ১৯৫২ সালে সেন্ট পলের গ্রেট টম’র ঘণ্টাটি প্রতি মিনিটে মিনিটে বেজেছিলো টানা দুই ঘণ্টা।
ওয়েস্টমিন্সটার অ্যাবে ও সেবাস্টোপোলের ঘণ্টা রাজকীয় মৃত্যুতেই বাজানো হয়। রাজা ষষ্ঠ জর্জের জীবদ্দশায় উইন্ডসরে ঘণ্টা মোট ৫৬ বার বেজেছিলো। প্রতিবছর মাত্র একবার করে।
এসবের দায়িত্বে থাকবেন নোরফোকের অষ্টম ডিউক আর্ল মার্শাল। ১৬৭২ সাল থেকে সকল অন্তেষ্ট্যিক্রিয়ার দায়িত্ব পালন করে আসছে নোরফোক। প্রাসাদে লর্ড চেম্বারলিনের অফিস থেকে এসব দায়িত্ব পালন করবেন মার্শাল। আর পুলিশ, নিরাপত্তাবিভাগ, পরিবহন ও সশস্ত্রবাহিনীর সমন্বয়ে সরকারের টিমটি সংস্কৃতি বিষয়ক দফতরকে ঘিরে কাজের সমন্বয় করবে।
বিভিন্ন ইভেন্টে ভিআইপিদের স্থান দিতে ১০ হাজার টিকিট ছাপা হবে। তার অন্যতমটি হবে রাজা চার্লসের সিংহাসনে আরোহনের অনুষ্ঠান। যা রানির মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সম্পন্ন হবে। মায়ের মৃত্যুর পর প্রথম সন্ধ্যায় তিনি রাজা হিসেবে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন।
সারা দেশে স্বাভাবিক কাজকর্মগুলো যেনো ঠিক ঠিক চলে তার একটি নির্দেশনা থাকবে। তবে তেমনটা যে হবে না তা আগে থেকেই অনুমিত।
রয়্যাল অ্যাসকটের সময়টাতে যদি রানি মারা যান, সে সমাবেশ ভেঙ্গে দেওয়া হবে। লর্ডসে যদি তখন কোনও টেস্ট ম্যাচ চলে তা বাতিল করা হবে। এজন্য আগে থেকেই একটি বীমা করে রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাববে।
খবর যদি বিকেল চারটা আগেই পৌঁছে যায় ন্যাশনাল থিয়েটার বন্ধ ঘোষণা করা হবে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষগুলোকে সকল টাউনহল, লাইব্রেরি ও জাদুঘরে বিশেষ শোকবই খোলার নির্দেশনাও দিয়ে রাখা রয়েছে।
নগরপিতারা তাদের নগরের সাজ-সজ্জা সব ঢেকে রাখবেন। সকল পতাকা, এমনকি সমুদ্র সৈকতের নিশানগুলোও অর্ধনমিত রাখা হবে।
সবচেয়ে বড় মাথাব্যাথার বিষয়টি হবে বিদেশি অভ্যাগতদের নিয়ে। গত ক্রিসমাসের আগে লন্ডনের দূতাবাসগুলোতে সবশেষ যে নির্দেশনাটি গেছে তাতে বলা হয়েছে রানির মৃত্যুর পর সেখানে আসা ইউরোপীয় রাজপরিবারের সদস্যদের স্থান হবে রাজ প্রাসাদে। বাদিবাকিরা থাকবেন ক্লারিজে।
রানির মৃত্যুর সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ের মধ্যেই অধিবেশনে বসবে সংসদের উভয় কক্ষ।
রানির মৃত্যুর দ্বিতীয় দিনে, সকল পতাকা আবার উর্ধ্বে তোলা হবে এবং সকাল ১১টায় চার্লসকে রাজা ঘোষণা করা হবে।
সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রিচার্ড টিলব্রুক, একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন। সেটি হবে এমন- ‘সর্বশক্তিমান ইশ্বর আনন্দের সাথে আমাদের মহামান্যা রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে তার কাছে ডেকে নিয়েছেন….’
এসময় চার্লস রাজা হিসেবে তার প্রথম আনুষ্ঠানিক দায়িত্বটি পালন করবেন, শপথ নেবেন স্কটল্যান্ডের গির্জাগুলোর সকল সুরক্ষা দেওয়ার প্রতিজ্ঞায়। নতুন কোনও রাজা কিংবা রানির ওপরই যার গুরু দায়িত্ব বর্তায়।
এরপর নিরাপত্তা রক্ষীদের কয়েকজন প্রাসাদের বারান্দায় এগিয়ে যাবেন ও তিনটি বাজি ফোটাবেন। এরপর থমাস উডকক নামের এক জিনিলোজিস্ট যার মাইনে মোটে ৪৯.০৭ পাউন্ড আর যা ১৮৩০ সাল থেকেই একই রয়েছে, সেই গার্টার কিং অব আর্মস ব্যালকনিতে দাঁড়াবেন আর রাজা তৃতীয় চার্লসকে রাজা হিসেবে ঘোষণা পাঠ করবেন।
গার্টার কিং অব আর্মস এবং আরও আধাডজন সওয়ার মিলে একটি বাহনে চড়ে ট্রাফালগার স্কয়ারে রাজা প্রথম চার্লসের মূর্তির কাছে যাবেন। সেখানে গিয়েও তিনি নতুন রাজার ঘোষণা পাঠ করবেন। এর পর হাইড পার্ক থেকে প্রায় সাত মিনিট ধরে ৪১বার তোপধ্বনি তুলবেন পদাতিক বাহিনীর সদস্যরা। সিটি অব লন্ডনের পুরোনো সীমানা দেয়াল থেকে সড়কের ওপর দিয়ে একটি লাল ফিতা ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। সিটি মার্শাল, সাবেক গোয়েন্দা প্রধান ফিলিপ জর্ডান তখন ঘোড়ার পীঠে বসে অপেক্ষায় থাকবেন।
সেখানে তার সঙ্গে আরও রাজ অশ্বারোহীরা যোগ দিলে আনুষ্ঠানিকভাবে নগরে প্রবেশ করবেন আর রাজ সিংহাসনে আসা নতুন পরিবর্তনের খবর নগরময় ছড়িয়ে দেবেন। সেখবর রাজ অশ্বারোহী ঘোষক পাঠিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হবে গোটা দেশে।
সেন্ট জেমসে ঘোষণার পর রাজা চার্লস রাজ্য সফরে বের হবেন। একে একে তিনি ঘুরবেন এডিনবার্গ, বেলফাস্ট ও কার্ডিফ। এসব স্থানে মায়ের অন্তেষ্ট্যিক্রিয়া-কর্মে অংশ নেবেন তিনি। একই সঙ্গে সরকারের উর্ধ্বতনদের সঙ্গেও দেখা করবেন। আর প্রথম দিন থেকে সাধারণ মানুষই হবে রাজ প্রক্রিয়ার অংশ। নতুন রাজা অনেক ক্ষেত্রেই গাড়ি চড়বেন না, পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াবেন।
রাজ পরিবারে এই পরিবর্তনের সময়ে আরও একটি বিষয় ঘটে যাবে, যা অনেকের কাছেই স্বস্তির কিছু নাও হতে পারে কিন্তু করার কিছুই নেই। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রানি খেতাব পেতে যাচ্ছেন ক্যামিলা পার্কার।
২০০৫ সালে প্রিন্স চার্লসকে বিয়ে করার পর তাকে এতদিন আনুষ্ঠানিকভাবে ডাকা হতো প্রিন্সেস কনসর্ট বলে। যার আসলে ঐতিহাসিক কিংবা আইনগত কোনও মানেও নেই। কিন্তু সে গল্পের সমাপ্তি ঘটে যাবে রানি এলিজাবেথ চক্ষু মোদার সাথে সাথেই। কারণ চার্লস যখন রাজা হবেন, তিনিই হবেন রানি। তা তাকে যে নামেই ডাকা হোন না কেনো।
এরই মধ্যে রানির শববাহীদেরও নির্বাচনের বিষয় রয়েছে। ব্রিটিশ রয়্যালদের সমাধি স্থলে কফিন বহন করে নিতে হবে। আর এই কফিনের ওজনও হয় অনেক। প্রিন্সেস ডায়ানার ওজন ছিলো প্রায় পোয়া টন।
মৃত্যুর চতূর্থ দিনে কফিন বয়ে নেওয়া হবে ওয়েস্টমিন্সটার হলে সেখানে চার দিন শায়িত রাখা হবে রানিকে। বাকিংহাম প্যালেস থেকে বের হওয়া শবযাত্রা হবে প্রথম বৃহৎ সামরিক যাত্রা। ২০০২ সালে রানিমাতার শবযাত্রায় ১৬০০ সেনার সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছিলো যা আধা মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। আর ধারণা করা হচ্ছে যে পথে এই শবযাত্রা হবে তার দুই ধারে স্থান নিতে পারবে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ।
শবযাত্রা যতক্ষণে ওয়েস্টমিন্সটার হলে পৌঁছাবে ততক্ষণে বিগ বেনের কাঁটা ঘণ্টাধ্বনি বাজাতে শুরু করবে।
হলের ভেতরে একটি শবমঞ্চে রাখা হবে রানির কফিন। নিজ রাজ্যগুলো ঘুরে রাজা চার্লস তখন যোগ দেবেন অন্তেষ্ট্যিক্রিয়ায়। আর তাতে নেতৃত্ব দেবেন।
পুরোপুরি প্রস্তুতি নেওয়ার পর দরজা খুলে দেওয়া হবে সকলের জন্য।
রাজা ষষ্ঠ জর্জের সময় তিন লাখ ৫ হাজার প্রজা এসেছিলেন। রানির জন্য লাখ পাঁচেক প্রজার উপস্থিতির ধারনা করা হচ্ছে। নবম দিনের সূর্যোদয়ের আগে কফিন থেকে সকল অলঙ্কারাদি তুলে নেওয়া হবে এবং পুরো পরিষ্কার করে ফেলা হবে।
অধিভূক্ত অধিকাংশ রাষ্ট্রেই ছুটি ঘোষণা করা হবে। শেয়ার বাজার বন্ধ থাকবে। প্রয়োজন হলে ফুটবল স্টেডিয়ামগুলো খুলে দেয়া হবে শোকার্ত মানুষের জন্য।
বিগবেন যখন সকাল ৯টার ঘণ্টা বাজাবে, ঘণ্টার হাতুড়িটি চামড়ার মোটা থলেতে পুরে ফেলা হবে। ফলে এরপর ঘণ্টাধ্বনি হবে চাপা।
সকাল ১১টায় যখন কফিন অ্যাবের দরজায় পৌঁছুবে তখন গোটা দেশে নেবে আসবে নিরবতা। তারই মাঝে ভেতর থেকে আর্চ বিশপ কথা বলে উঠবেন। শুরু হবে প্রার্থনা।
এরপর শববাহীরা কফিনটি একটি সবুজ বাহনের ওপর রাখবেন। এই বাহনটি ব্যবহার করা হয়েছিলো রানির বাবার জন্য, তারা বাবা এবং তারও বাবার জন্য।
এরপর ১৩৮ জন নাবিক তাদের মস্তক বুকে ছুইয়ে রেখে সে বাহনটি টেনে নিতে শুরু করবেন। ১৯০১ সালে ভিক্টোরিয়ার অন্তেষ্ট্যিক্রিয়া থেকে এই পদ্ধতি চালু করা হয়, কারণ সেবার শববাহী শকটের ঘোড়াগুলো উইন্ডসর স্টেশনের কাছে বেয়ারা হয়ে উঠেছিলো। পরে সে পদ্ধতির পরিবর্তন আনা হয়।
হাইড পার্কের পাশ দিয়ে শুরু হবে এই শবযাত্রা ২৩ মাইল পারি দিয়ে উইন্ডসর ক্যাসল-এ যাবে। এখানেই রয়েছে ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যদের সমাধি।
রাজ পরিবারের সদস্যরা সেখানে ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকবেন। বেদীর ভেতরে রাজকীয় সমাধির ভল্ট খুলে ফেলা হবে, আর রাজা চার্লস একটি রুপোর পাত্র থেকে মুঠোভর্তি লাল মাটি তার মধ্যে ফেলবেন।
এরপর ভস্ম থেকে ভস্মে, ধুলো থেকে ধুলোয় মিশে যাবে সবকিছু।
বাংলাদেশ সময় ১৫৪৯ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৭
এমএমকে