দেবী সিংহ তাই তদবীরের পথ ধরলেন। তিনি মুর্শিদকুলি খাঁর রাজস্ব-দফতরের এক প্রাক্তন কর্মচারী রেজা খাঁর অধীনে একটি চাকরিও জুটিয়ে ফেললেন।
ডাকাতি করে তার উত্তরোত্তর সাফল্য আসতে থাকে। এভাবে সম্পদশালী হওয়ায় খুব দ্রুতই তিনি ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন।
জানা যায়, দেবী সিংহ পলাশী যুদ্ধে ইংরেজদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। সেজন্য তিনি ব্রিটিশদের কাছ থেকে ইনামও পান। ব্রিটিশ সরকার তাকে রাজস্ব বিভাগের উচ্চপদে বসান। দীর্ঘ দিন তিনি ওই পদেই থেকেছেন।
বেইমানের দোসর লর্ড ক্লাইভ তাকে মহারাজা বাহাদুর উপাধি দান করেন। তখন ভারতবর্ষের মোসাহেবরা ব্রিটিশরাজ থেকে ক্ষেতাবপ্রাপ্ত হতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতেন। রাজা, নবাব, রায়বাহাদুর এসব খেতাব ছিলা ইংরেজদের একেকটি টোপ।
দেবী সিংহ পরে ব্রিটিশরাজের মুর্শিদাবাদের দেওয়ানের দায়িত্ব পালন করতেন। সে কাজ করতে গিয়ে তিনি এতোটাই কঠোরতা প্রদর্শন করতেন যে প্রজারা তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।
মুর্শিদাবাদের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর বেশিরভাগই লালবাগে অবস্থিত। লালবাগ এলাকার কাঠগোলা প্রাসাদের কাছেই রয়েছে দেবী সিংহের প্রাসাদ। এই এলাকার নাম নসীপুর। তাই এই প্রাসাদের নামও নসীপুর প্রাসাদ।
দেবী সিংহ এ প্রাসাদ নির্মাণ করেন ১৭৭৬ সালে। এরপর রাজা কীর্তি চন্দ্র সিংহ বর্তমান এই প্রাসাদ পুনঃনির্মাণ করেন ১৯০০ সালে। তিনি দেবী সিংহেরই উত্তর পুরুষ।
এই প্রাসাদে হিন্দুদের অনেক দেব-দেবীর প্রতিমা স্থাপন করা হয়েছে। এ রাজবাড়িতে রয়েছে ঠাকুরবাড়ি। এই ঠাকুরবাড়িতে পারিবারিক দেবতা রামচন্দ্র দেব ঠাকুর অবস্থান করেন। এর অন্যতম আকর্ষণ হলো বিশালাকার চওড়া সিঁড়ি। প্রতিবছর এখানে ঝুলন উৎসব হয়।
এই প্রাসাদটিকে হাজার দুয়ারির ছোট সংস্করণও বলা হয়।
এ প্রাসাদে রয়েছে প্রাচীন গ্রন্থাগার, আর্ট গ্যালারি, মোগল যুগের ভাস্কর্য, মার্বেলের জাফরি বা জাল, অষ্টধাতু, কষ্টিপাথর ও শ্বেতপাথরের মূর্তি, টেস্টিং জার ও রাজপ্রাসাদের বিভিন্ন ব্যবহার্য দ্রব্য।
মূল সড়কের পাশেই প্রাসাদটি অবস্থিত। প্রাসাদে ওঠার সিঁড়ির দুই পাশে দুই সিংহ-মূর্তি। সিড়ির সামনেই রয়েছে চার স্তর বিশিষ্ট একটি পানির ফোয়ারা। দুইতলা বিশিষ্ট এ প্রাসাদের মাঝখানে রয়েছে প্রশস্ত খালি জায়গা ও চারপাশে বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি।
এখানে দেবী সিংহের উত্তরপুরুষদের পেইন্টিং রয়েছে। প্রাসাদের সামনের অংশটি মোটামুট সংরক্ষিত রয়েছে, কিন্তু ভেতরের দিকে পুরোটাই ভগ্নদশা। প্রায় পুরো প্রাসাদেই পলেস্তারা খসে গেছে। লোহার বিম দিয়ে কোনো মতে ছাদগুলোকে পতন থেকে রক্ষা করা হয়েছে।
দরজা-জানালার পাল্লা খুলে গেছে অনেক আগেই। একটি কক্ষে এই প্রাসাদের মতোই একটি মডেল রাখা আছে, তার অবস্থাও প্রাসাদের মতোই।
এই প্রাসাদ হলো এক অত্যাচারী রাজকর্মচারী ও ইংরেজ বশংবদ লোকের প্রাসাদ। তাই এর দেয়ালে কান পেতে শোনা যায় অত্যাচারিত প্রজাদের আর্তনাদ। এখানে লোহার গরাদ দেওয়া কুঠুরি রয়েছে। বলা হয়, প্রজারা খাজনা দিতে না পারলে এই কুঠুরিতে বন্দি করে রাখা হতো। প্রয়োজন হলে ফাঁসিও দেওয়া হতো। গারদ ঘরের কাছেই রয়েছে ফাঁসি ঘর। এমনকি ৭৬ সালের মন্বন্তরের সময়ও প্রজারা দেবী সিংহের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পেতো না।
এদিকে দেবী সিংহের ধীরে ধীরে আরও উন্নতি হতে থাকে। ১৭৮১ সালে কোম্পানি তাকে পুণির্য়া, রংপুর ও দিনাজপুরের লিজ দেয়। বাংলা, বিহার ও ওড়িষ্যার পুতুল নবাব তখন সুজাউদ্দৌলা।
বাংলার দেওয়ানি লাভের পরও তার অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। তার অত্যাচারে রংপুর, দিনাজপুরসহ বাংলার মানুষ দুর্বিসহ অবস্থায় নিপতিত হয়। ফলে, প্রজাদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে।
দেবী সিংহের অত্যাচারে এক বছরের মাথায়ই প্রজারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। কৃষক-প্রজারা বাধ্য হয়েই রংপুরের কালেক্টরের কাছে দেবী সিংহের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। কিন্তু কালেক্টর প্রজাদের দাবি মানলেন না। ওদিকে প্রজারাও দমার পাত্র নন।
এদিকে কৃষকরা সবাই নুরুলউদ্দিন (নূরলদীন) নামে এক ব্যক্তিকে তাদের পরিচালক নির্বাচিত করে তাকে নবাব বলে ঘোষণা করলো। নুরুলউদ্দিন বাংলার এ কৃষকদের বিদ্রোহ পরিচালনার ভার নিয়ে এক প্রবীণ কৃষককে তার দেওয়ান নিযুক্ত করলেন।
এভাবেই বাংলার প্রথম মুকুটহীন নবাব হলেন নুরুলউদ্দিন। তিনি দেবী সিংহকে কোনোরকম কর না দিতে আদেশ দেন। এভাবে বাংলার সব হিন্দু-মুসলমানরা দেবী সিংহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। ১৭৮৩ সালে রংপুরে বিদ্রোহ শুরু হয়। এতে বহুলোক হতাহত হয়।
এদিকে দেবী সিংহ প্রাণভয়ে রংপুরের কালেক্টর গুডল্যান্ডের শরণাপন্ন হন। প্রতিশোধ নিতে ব্রিটিশ সহায়তায় সৈন্যরা কৃষকদের ওপর পাল্টা আক্রমণ করেন। এতে নুরুলউদ্দিন গ্রেফতার অবস্থায় নিহত হন। বলা হয়, এ যুদ্ধে প্রায় ৬০ জন বিদ্রোহী নিহত হয় ও আহত হয় কয়েকশো।
ভিডিও: নসীপুর প্রাসাদ
এভাবে বাংলার প্রথম বিদ্রোহী ও মুকুটহীন নবাব নূরলউদ্দিন (নূরলদীন) দেবী সিংহ তথা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রক্ত দিয়ে প্রমাণ করেন যে সিরাজ তখনও মরেনি। সিরাজ এখনও মরেনি। সিরাজের রক্ত আজো স্বাধীনতার ডাক দিয়ে যায় কখনও ‘জাগো বাহে’ আবার কখনও-বা ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ অভিধায়। নসীপুরের দেবী সিংহের প্রাসাদে অত্যাচারিত-নির্যাতিত কৃষক-প্রজাদের আর্তনাদের আওয়াজ যেমন শুনেছি, সমধিক উচ্চ রবে শুনেছি নুরলদীনের ‘জাগো বাহে’ ডাক।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৭
এসএনএস
আগের পর্ব পড়ুন-
** ১ম পর্ব: এক যে ছিলো মুর্শিদাবাদ
** ২য় পর্ব: কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ
** ৩য় পর্ব: মানুষ যে হায় ভুলে গেছে চির মধুর ভালোবাসা
** ৪র্থ পর্ব: চার ভাইয়ের বাগান বিলাস ও একটি গুপ্তপথ
** ৫ম পর্ব: জগৎশেঠকে সপরিবারে হত্যা করা হয় যে প্রাসাদে