১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্র স্বাধীনতার শপথ নেয় ও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় নিশান উড়িয়ে বিশ্ব দরবারে তার অস্তিত্ব জানান দেয়। সময়টি মাত্র নয় মাসের, কিন্তু এর রক্তমূল্য সীমাহীন।
সরকার গঠন করতে ম্যান্ডেট লাগে। ১৯৭১ সালে সেই ম্যান্ডেটের জোরেই সরকার গঠন করা হয়েছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব বাংলার মানুষ সরকারকে সে ম্যান্ডেট দিয়েছিল। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমেই অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। এ ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘যেহেতু ১৯৭০ সালের ০৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল; এবং যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল; এবং যেহেতু সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি’।
কোনো রাজনৈতিক, সামরিক ও বাস্তব পরিস্থিতিতে এ সরকার গঠন করা হয় তারও ব্যাখ্যা দেওয়া হয় এ ঘোষণাপত্রে। আমরা বিশ্বের বুকে শুধু একটি পৃথক মানচিত্রের দাবিতে বা পাকিস্তান থেকে মুক্তির জন্যই লড়াই করিনি। সরকার ও রাষ্ট্রগঠনের পেছনে আমাদের মূল আদর্শিক ও দার্শনিক ভিত্তি ছিলো জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হলেও এ যুদ্ধকে পরিচালনা, সমন্বয় ও বিশ্বের অপরাপর রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন আদায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন এ অস্থায়ী সরকারের ভূমিকা সর্বাধিক। যেহেতু এ অস্থায়ী সরকার সীমান্ত অতিক্রম করে প্রতিবেশী ভারতের মাটিতে থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখেছে তাই একে প্রবাসী সরকারও বলা হয়।
বৈদ্যনাথ তলা আম্রকানন। এ গ্রাম বাংলাদেশের আর দশটা গ্রামের মতোই সবুজ শ্যামল একটি গ্রাম। মেহেরপুর জেলার বাগোয়ন ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি গ্রাম এ বৈদ্যনাথ তলা। এ গ্রামের আম্রকাননেই সেদিন শপথ নিয়েছিল বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার। উদিত হয়েছিল অস্তমিত স্বাধীনতার সূর্য। এই গ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একটি জাতির জন্মকথা। স্বাধীনতার বিজয় পতাকা উড়িয়েছিল এই গ্রামেরই কতিপয় লোক- শূন্যহাতে, নগ্নপদে। সেই মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী হয়েছিল ইতিহাসের সূর্যসন্তানেরা।
পলাশীর আম্রকানন নদীয়া জেলার একটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা। কৃষ্ণনগর ও মুর্শিদাবাদের প্রায় মাঝামাঝি এ পলাশী গ্রাম। পাশেই ভাগীরথী নদী। বৈদ্যনাথ তলা আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য উদিত হলো ১৯৭১-এ, সেই সূর্য অস্তমিত হয়েছিল এখান থেকে মাত্র ৭০ কিমি দূরের আরেকটি আম্রকাননে ২১৪ বছর আগে। পলাশীর আম্রকাননেই স্বাধীনতার সূর্য আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল ২০০ বছরের জন্য। হারিয়ে যায় পরাধীনতার অন্ধকারে।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলার ইতিহাসে সেই ট্রাজেডির দিন যেদিন মঞ্চস্থ হয়েছিল একটি যুদ্ধনাটক। কতিপয় ইংরেজ ও রবার্ট ক্লাইভ, মীরজাফর, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, উমিচাঁদ, নন্দকুমার চক্র সেদিনের সেই যুদ্ধনাটকে অংশ নিয়েছিলেন। মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কাছে সেদিন পরাজয় মেনেছিল সিরাজের স্বাধীন তরবারি। বাংলা হলো পরাধীন। স্বাধীনতার জন্য আমৃত্যু লড়াই করে ট্র্যাজেডির শিকার হলেন মীরমদন, মোহনলালরা।
তাই পরাধীনতা ও স্বাধীনতার এতো বছর পরও ফিরে আসে পলাশী, ফিরে আসে মুজিবনগর।
পলাশীর সেই আম্রকানন আজ আর নেই। আছে শুধু একটি মনুমেন্ট। তাও একটি বাংলাদেশি সংগঠন উদ্যোগ নিয়ে তৈরি করেছে। মনুমেন্টের পাশে সিরাজের একটি আবক্ষ মূর্তি, চারপাশে ঢেউখেলানো লাল দেয়াল দিয়ে ঘেরা একটি স্তম্ভই এখন পলাশী যুদ্ধের স্বারক।
বাংলাদেশ সময়: ০৭১৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১৭
এসএনএস
আগের পর্ব পড়ুন-
** ১ম পর্ব: এক যে ছিলো মুর্শিদাবাদ
** ২য় পর্ব: কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ
** ৩য় পর্ব: মানুষ যে হায় ভুলে গেছে চির মধুর ভালোবাসা
** ৪র্থ পর্ব: চার ভাইয়ের বাগান বিলাস ও একটি গুপ্তপথ
** ৫ম পর্ব: জগৎশেঠকে সপরিবারে হত্যা করা হয় যে প্রাসাদে
** ৬ষ্ঠ পর্ব: নুরলদীনের ‘জাগো বাহে’ শোনা যায় নসীপুর প্রাসাদে
** ৭ম পর্ব: কিরীটেশ্বরী মন্দির ও জগদ্বন্ধু সুন্দরের আশ্রম
** ৮ম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর কলিজাখেকো মেয়ের সমাধি!
** হেস্টিংসের স্ত্রী, মেয়ের সমাধি ও একটি আর্মেনিয়ান চার্চ