দৃশ্যটি আদাবর, লুৎফর রহমান লেনের ৬/২ নম্বর বাড়ির একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটের। যে বাড়ি স্থান নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে অনাদর ও অবাঞ্চিত জন্ম নেওয়া ৩৫টি শিশু।
সমাজ ও মায়ের বোঝা এসব শিশুকে নিজের সব সম্বল মানুষের কাছ থেকে পাওয়া সহায়তায় বুকে টেনে নিয়েছে হাজেরা বেগম। হাজেরা নিজেও এক সময় অন্ধকার জগতের মানুষ অর্থাৎ যৌনকর্মী ছিলেন। কাছ থেকে দেখেছেন অন্ধকার জগতে জন্ম হওয়া শিশুর অনাদরের চিত্র।
স্বামী ও সংসারের মুখ না দেখলেও ৩৫টি শিশুর মা হয়েছেন হাজেরা বেগম। তার আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা এসব শিশু; কেউ তাকে মা, আম্মা কেউবা আম্মু বলে ডাকে।
২০১০ সালে নিজের সব সম্বল ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সহায়তা ‘শিশুদের জন্য আমরা’ সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়। যা পরবর্তীতে এক পরিবারে রূপ নেয়। একজন আয়া, একজন বুয়া ও হাজেরা মিলে চালাচ্ছেন এই পরিবার। এখানে বড় হচ্ছে, সোনালি, রুবেল, দুর্জয়, মির্জা, রবিন, স্বপনের মতো অবহেলিত শিশুরা। যারা পাচ্ছে তিন বেলা পেট ভরে খেতে, পড়াশুনা করার সুযোগ।
হাজেরা বেগম এ শিশুদের মধ্যে নিজের অতৃপ্তি ঘোচানোর স্বপ্ন দেখেন। ভাসমান এসব শিশুর নিশ্চিত ভবিষ্যৎ তৈরি করে দেওয়াই তার একমাত্র স্বপ্ন। নয় বছর বয়সে সৎমায়ের অত্যাচারে ঘর ছেড়ে ভাগ্যদোষে হয়েছিলেন যৌনকর্মী। এরপর জীবনের অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বাঁচার আশা এ শিশুরা।
সংগ্রামী জীবনের চিত্র তুলে ধরে হাজেরা বলেন, এক সময় যৌনকর্মী ছিলাম। ১৯৯৬ সালে পেশা ছেড়ে যৌনকর্মীদের সন্তান দেখা-শোনার একটি ‘শিশুনিবাস’ চাইল্ড কেয়ার সেন্টারে কাজ করতাম। কিন্তু সেটি বন্ধ হয়ে যায়। সেই থেকে শিশুদের উপর ভালোবাসা জন্মে। পরে নিজের সব জমানো টাকা দিয়ে যৌনকর্মীদের সন্তানদের দায়িত্ব নিজেই নেন। এ কাজে প্রথমে সহযোগিতা করে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এরপর ব্যক্তিগত অনেকেই তাকে সহযোগিতা করে। ফলে খরচ মোটামুটি চলে যায়। তবে কোনো সংস্থা থেকে সাহায্য আসে না।
এ অবস্থা আসতে তাকে পোড়াতে হয়েছে অনেক কাঠ-খোড়। বাবার পরিচয় না থাকায়, প্রথম প্রথম এসব বাচ্চাদের কেউ স্কুলে নিতে চাইতো না। অনেক চেষ্টা করে ভর্তি করাতে হয়েছে জানালেন হাজেরা।
দুপুর ২টা। স্কুল থেকে ফেরেন সায়েম,সাঈদরা। হাজেরা ছুটে যান তাদের সন্তানদের কাছে। কাঁধ থেকে ব্যাগ নিতে নিতে বলেন, এরা আমার বড় ছেলে। এরা জেএসসি দিবে। আরেকজন গতবার জেএসসি দিয়েছে।
তিনি বলেন, ৩৫টা শিশুর একজনও যদি আমার কাছে না থাকে, ভালো লাগে না। অনেক সময় তাদের মায়েরা নিয়ে যান, আমি ফোন করে নিয়ে আসি। ছেলে শিশুদের এসএসসি পর্যন্ত পড়াব। আর মেয়েরা যতদিন আমার কাছে থাকতে চায়, থাকতে পারবে। মেট্রিক পাসের পর মেয়েদের ভারতেশ্বরী হোমে পাঠিয়ে দিব।
হাজেরার মাতৃকোলে স্থান পেয়েছে শিশু সোনালি। যার আট বছর বয়সী সোনালি জানে না তার আসল পরিচয়। দুই বছর বয়সেই তার মা এক রাতে হাজেরার কাছে দিয়ে যান। এরপর আর কখনও নেয়নি। এখন সোনালি ক্লাস থ্রি-তে পড়ে।
সোনালী জানালো, এখানে খুব ভালো আছে, মা তাদের অনেক আদর করে। এখানে তার অনেক ভাই-বোন।
হাজেরা স্বপ্ন দেখেন এক টুকরা জমির। যখন সে থাকবে না, যেখানে এসব শিশুদের থাকার জায়গা হবে। তার একার পক্ষে কঠিন হলেও, চেষ্টা করছেন জানান এ মমতাময়ী জননী।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৭
এমসি/এসএইচ