মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে হায়দ্রাবাদের দেওয়ান নিয়োগ করেন এবং মনসবদারি দেন। ১৭০০ সালে মহম্মদ হাদিকে আওরঙ্গজেব বাংলার দেওয়ান নিযুক্ত করেন ও ‘করতলব খান’ উপাধি দেন।
বাংলার নবাব হওয়ার কিছুদিন পর তিনি রাজধানী ঢাকা থেকে ভাগীরথীর তীরে মখসুদাবাদে নিয়ে যান ও এর নাম দেন মুর্শিদাবাদ। ১৭০৩ সালে দিল্লির সম্রাট তাকে মুর্শিদকুলি খাঁ উপাধি দেন। ১৭২৭ সালের ৩০ জুন মুর্শিদকুলি খাঁর মৃত্যু হয়।
মুর্শিদাবাদ শহরের উত্তর-পূর্ব দিকে মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধি কাটরা মসজিদ অবস্থিত। মুর্শিদাবাদ রেল স্টেশন থেকে জেলখানার কাছে এসে উত্তরের পথ ধরে কিছুদুর এগোলে রেল লাইনের পূর্ব দিকেই কাটরা মসজিদ দেখতে পাওয়া যাবে।
ঐতিহাসিকদের মতে, মুর্শিদকুলি খাঁ জীবনের শেষ পর্যায়ে মসজিদ সংলগ্ন নিজের একটি সমাধি ভবন নির্মাণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। নবাবের ইচ্ছানুযায়ী কাজও শুরু হয়। মসজিদটি নির্মাণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয় তারই এক বিশ্বস্ত সহচর ফরাস খার ওপর, যিনি ছিলেন একজন দক্ষ কারিগর। তিনি মাত্র দুই বছরে (১৭২৪-২৫) এই মসজিদ নির্মাণের কাজ শেষ করেন।
মসজিদ নির্মাণের কিছুদিন পরেই মুর্শিদকুলি খাঁর মৃত্যু হয়। মসজিদের প্রবেশদ্বারের পরেই একটি সিঁড়ি রয়েছে। এই সিঁড়ি বেয়েই মসজিদে উঠতে হয়। এই সিঁড়ির নিচেই মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধি। নবাব এমন এক স্থানে সমাহিত হতে চেয়েছিলেন, যেখানে তিনি মসজিদে প্রবেশকারী পূন্যবান মুসল্লিদের পদস্পর্শ পাবেন। মৃত্যুর পরে তার ইচ্ছানুসারে কাটরা মসজিদের প্রবেশ সোপানের নিচেই তাকে সমাহিত করা হয়।
মসজিদের দুই প্রান্তে ৭০ ফুট উঁচু গম্বুজ রয়েছে। মসজিদ প্রাঙ্গণের চারদিকে রয়েছে চারটি উঁচু বুরুজ। এ বুরুজগুলো সরু হয়ে উপরে উঠে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে বুরুজের উপর পর্যন্ত ওঠা যায়। এর উপর থেকে মুর্শিদাবাদ শহরের চারদিক দেখা যেতো। মসজিদের ভেতরে চারদিকে অনেক ছোট-ছোট প্রকোষ্ঠ রয়েছে। এগুলো প্রায় ভগ্নাবস্থায় টিকে রয়েছে। মসজিদে বসে কোরান পাঠের জন্যই এই ব্যবস্থা।
মসজিদের একটি কষ্ঠিপাথরের লেখা, ‘আরবের মুহম্মদ (স.) উভয় জগতের গৌরব, যে ব্যক্তি তার দ্বারে ধূলি লয়, তার মাথায় ধূলিবৃষ্টি হউক’। এটি একজন ধর্মভীরু নবাবেরই পরিচয় বহন করে।
মুর্শিদাবাদের কাটরা মসজিদটি ঢাকার করতলব খান মসজিদের অনুকরণেই নির্মিত। এ মসজিদটি ঢাকার বেগম বাজারে অবস্থিত। এই মসজিদটিও নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ তৈরি করান। তার প্রথম উপাধি ছিলো করতলব খান। এই মসজিদের প্লাটফর্মের খিলানাকৃতির অংশটির মাঝ বরবার কেটে একটি সমাধির জন্য জায়গা রাখা হয়েছে। যা আমরা মুর্শিদাবাদের কাটরা মসজিদেও পাই। কাটরা মসজিদেও একইভাবে সমাধির জন্য জায়গা রাখা হয়েছে। এ থেকে কাটরা মসজিদ নির্মাণে মুর্শিদকুলি খাঁ বা এর নির্মাতা কারিগর ফরাস খাঁ সম্পর্কে যে বানোয়াট গল্প বলা হয় তার অসারতাই প্রমাণ হয়। কারণ, কাটরা মসজিদ নির্মাণের আগেই একই নকশায় করতলব খাঁ মসজিদ নির্মাণ করা হয়।
মুর্শিদকুলি খাঁকে সমাহিত করা হয় মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রবেশ সোপানের নিচে। তার মেয়ে আজিমুন্নেসার সমাধিও একই কায়দায় নির্মিত।
মসজিদের মোট আয়তন ১৯.৫ একর। এখানে একসঙ্গে দুই হাজার মুসল্লি নামাজ পড়তে পারেন। এর মেঝেতে দুই হাজারটি চর্তুভূজাকৃতি মাদুরের নকশা চিত্রিত রয়েছে।
এর দুই কোণায় দুইটি উঁচু টাওয়ারে নবাবি আমলে প্রহরীরা পাহারা দিতেন।
১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মসজিদটি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর পাঁচটি গম্বুজের তিনটিই ভেঙে গেছে। মসজিদের ভেতরে একসঙ্গে ৭শ জন কোরআন তেলওয়াতকারী বাস করতেন।
কাটরা মসজিদ ও মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধি
নবাবি আমলে এখানে একটি সবজি বাজার ছিলো। কাটরা শব্দের অর্থ বাজার। সে অনুযায়ী এই মসজিদের নাম রাখা হয় কাটরা মসজিদ।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৭
এসএনএস
আরও পড়ুন
** ১ম পর্ব: এক যে ছিলো মুর্শিদাবাদ
** ২য় পর্ব: কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ
** ৩য় পর্ব: মানুষ যে হায় ভুলে গেছে চির মধুর ভালোবাসা
** ৪র্থ পর্ব: চার ভাইয়ের বাগান বিলাস ও একটি গুপ্তপথ
** ৫ম পর্ব: জগৎশেঠকে সপরিবারে হত্যা করা হয় যে প্রাসাদে
** ৬ষ্ঠ পর্ব: নুরলদীনের ‘জাগো বাহে’ শোনা যায় নসীপুর প্রাসাদে
** ৭ম পর্ব: কিরীটেশ্বরী মন্দির ও জগদ্বন্ধু সুন্দরের আশ্রম
** ৮ম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর কলিজাখেকো মেয়ের সমাধি!
** ৯ম পর্ব: হেস্টিংসের স্ত্রী, মেয়ের সমাধি ও একটি আর্মেনিয়ান চার্চ
** ১০ম পর্ব: মুজিবনগর ও পলাশী: বাংলার ইতিহাসের দুই আম্রকানন
** ১১তম পর্ব: ৩শ বছরের ডাচ সিমেট্রি ও যোগেন্দ্র নারায়ণের মন্দির
** ১২তম পর্ব: সতীদাহ ঘাটের পাতালেশ্বর মন্দির
** ১৩তম পর্ব : আশি টাকার গাড়ি ও সোনার রথ
** ১৪তম পর্ব : ষড়যন্ত্রের গ্রিনরুম ছিল কাসিম বাজার
** ১৫তম পর্ব: কাসিম বাজার ছোট রাজবাড়ির বড় আয়োজন
** ১৬তম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর জগৎজয়ী কামান